সত্তুর লাখ কালো বিড়ালের মালিক কোথায়? by মাহবুব মিঠু
আবারো একটা গল্প। পাতালপুরীর কাহিনী। পৃথিবীর সব সম্পদ চুরি হয়ে যাচ্ছে। এর হোতা হচ্ছে পাতালপুরীর ভয়ংকর এক রাক্ষস। তাকে এবং তার সম্পদ পাহারা দিয়ে রেখেছে হাজারো অস্ত্রধারী সৈন্য। পাতালপুরীর রাক্ষসকে যেই মারতে গিয়েছে, সেই রাক্ষসের সর্বনাশা যাদুতে সব স্মৃতি ভুলে তার অবৈধ, লুণ্ঠিত সম্পদের পাহারাদার বনে গিয়েছে।
চারিদেকে কান্নার রোল। পাতালপুরীর রাক্ষস তার যাদু দিয়ে অগণিত মানুষকে বশীভূত করে রেখেছে। এরই মধ্যে দ্বিগ্বিজয়ী এক বীর ঘোষণা দিল, এবার আমিই যাচ্ছি পাতালপুরীর রাক্ষসকে বধ করে পৃথিবীর সব সম্পদ ফিরিয়ে আনতে। সে ছুটলো একাই। সবার অপেক্ষা। এবার কী হয়! কী হয়!
দিন যায়, মাস যায়। রাজকুমার আর ফেরে না। আবারো কান্নার রোল। হঠাৎ চারিদিকে ধুলোর ঝড় তুলে টগবগ টগবগ ঘোড়া চালিয়ে রাজকুমার ফিরে এলো বিজয়ীর বেশে। সঙ্গে তার থলেভর্তি অগণিত মোহর। ঘোষণা দিয়ে রাজকুমার লুণ্ঠিত মাল সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলেন।
এটা গল্পেই সম্ভব হয়েছে। বাস্তবের রাজকুমারেরা প্রায়শই শুধু রাক্ষসের প্রহরী নয়, বরং নিজেরাই একেকটা ভয়ংকর রক্তচোষা রাক্ষস হয়ে যায়। আমাদের কথা গল্পের মাঝখান পর্যন্ত, যেখানে জনগণের সম্পদ চুরি হয়ে যায় এবং একে একে রক্ষক, ভক্ষকের ভূমিকায় নামে। এর পরেরটুকু শুধুই স্বপ্ন।
বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত কোনো বিভাগ চেরাগ জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘রেলের সেই কালো বিড়ালটা’ ধরবেন বলে। মন্ত্রিত্ব পাবার পরে তাই অনেকেই টিপ্পনি কেটেছিল: এবার দেখা যাবে দাদা, আপনি কতোখানি সাদা। কিন্তু ওমা! কালো বিড়ালেরা দেখি এতোদিন তার সাথে একই গাড়িতে চলাফেরা করেছেন।
এবার মূল ঘটনায় নজর দেয়া যাক। গত সোমবার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমার ফারুক তালুকদার কথিত ঘুষের ৭০ লাখ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা খেয়েছেন। এ সময় তার সংগে ছিলেন রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। তাদের গন্তব্য নাকি ছিল রেলমন্ত্রীর জিগাতলার বাসা। ঘটনার তদন্তে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটির প্রধান করা হয় স্বয়ং মন্ত্রীরই ব্যক্তিগত সচিবকে এবং অপরটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। এরই মধ্যে বাতাসে কানাঘুষা চলছে যে, রেলের পূর্বঞ্চলের নিয়োগ বাণিজ্যের অবৈধ ইনকামের একটা বড় অংশ মন্ত্রীকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই গাড়ি জিগাতলামুখী ছিল। এই নিয়োগবাণিজ্যে মন্ত্রণালয়ের উপর মহলের অনেকেই নাকি জড়িত।
কোনোটাই প্রমাণিত নয়। মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার পরম্পরায় সন্দেহগুলোকে উড়িয়ে দেবারও উপায় নেই। এই প্রেক্ষাপটে তদন্ত কমিটিতে স্বচ্ছতা না এনে যাদের জড়িয়ে এই ব্যাপক অর্থকেলেংকারীর গুজব উঠেছে তাদের কিংবা তাদের সহকর্মী-সহযোগীদেরই করা হলো তদন্ত কমিটির প্রধান। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হোল যে, সরকার গা বাঁচাতে এই কমিটি করেছে এবং যার মূল উদ্দেশ্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া। এর আগেও জনগণ অনেক তদন্ত কমিটি দেখেছে। এরই মধ্যে স্বয়ং মন্ত্রীর কিছু কাজে এবং কথাবার্তা থেকে তদন্তের ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানা হয়ে গিয়েছে।
মন্ত্রী বলেছেন, “কিসের টাকা তা আমি জানি না। তবে ওই টাকার মালিক এপিএস ওমর ফারুক। নিজের টাকা নিজের সংগে রাখার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ তার টাকা তিনি কোথায় রাখবেন, নিজের সংগে রাখবেন নাকি বাসায় রাখবেন, তা তার ব্যাপার” (রেলভবনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত)। এবং তিনি ঘটনার পরপরই মন্ত্রিত্বের জোর খাটিয়ে তার এপিএসকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রী যখন তদন্তের আগে বলেই দিয়েছেন যে, এটা তার ব্যক্তিগত টাকা, সেখানে তার পিএসের (যিনি কিনা একটা কমিটির প্রধান) ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে, উল্টোটা বলেন!
মন্ত্রী সাহেব, আপনার এপিএস কতো বড়লোক ছিলেন যে, গাড়িতেই ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করেন? তাহলে তার ব্যাংকে কি পরিমাণ টাকা জমানো আছে সেটার হিসেবই কি কখনো দেখা হবে? বিভিন্ন পত্রিকায় পড়লাম আপনার এপিএস নাকি খুবই সাদাসিধে পরিবার থেকে এসেছেন। হঠাৎ করে এতো টাকা কিভাবে উড়ে এসে গাড়িতে জুড়ে বসল? এপিএসের ব্যক্তিগত টাকা যেখানে খুশি সেখানে রাখা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি হয়, তবে পরবর্তী সময়ে তাকে কেন সাময়িক বহিষ্কার করলেন?
জানি, এই ঘটনায় রাঘব বোয়াল জড়িত থাকলে এ আমলে নিশ্চয়ই তারা থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য বরাবরই একই রকম। ক্ষমতায় এলে ব্যক্তির দায়ভার দল নিজ ঘাড়ে নিয়ে দলকেই ডুবিয়ে ছাড়ে। এর কারণ হতে পারে বহুবিধ। প্রথমত: দল এবং ব্যক্তিকে এক করে ঘুলিয়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত: পুরো দলই কোনো না কোনোভাবে একই কাজে যুক্ত। তাই ঠগ বাছতে গ্রাম উজাড় না করে বরং ঠগকেই শেল্টার দিতে হয়।
সমালোচনার সুনামি সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে বিরোধীদলসহ সবারই রয়েছে প্রবল আপত্তি। বিরোধী দল থেকে দাবি উঠেছে যে, শুধু এপিএস নন, স্বয়ং মন্ত্রীও এর সংগে জড়িত।
তদন্তের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যেমন ঠিক না; ঠিক তেমনি সন্দেহের যথাযথ কারণ থাকলে তদন্তের সময় সেগুলো আমলে নেওয়াও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েকটি বিষয়ের কারণে সন্দেহের তীর মন্ত্রীর দিকে যায়। পৃথিবীর সব দেশেই উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কারো অধীনস্ত কেউ বা কোনো্ নিকট আত্মীয়ের অপকর্মের সমালোচনা প্রথমভাগে সেই ব্যক্তিকেও পোহাতে হয়, যতোদিন না প্রমাণিত হয় ঘটনার সংগে তিনি জড়িত নন। এক্ষেত্রে যিনি টাকাসহ ধরা খেয়েছেন তিনি মন্ত্রীর এপিএস। আমাদের মতো দেশে মন্ত্রীদের টাকা খাওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া টাকাসহ গাড়ির গন্তব্যস্থল নাকি ছিল জিগাতলার মন্ত্রীর বাড়ি। টাকা এবং গাড়িসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়ার জায়গাটাই বলে দেয় কথাটা সত্য। এতো টাকাসহ মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার কারণ কী? আরো গুজব আছে, পূর্ব অঞ্চলের রেল বিভাগের চাকরীর জন্য নাকি প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে। তদন্তের আগেই মন্ত্রী কেন এপিএসের পক্ষে সাফাই গাইলেন এবং তাকে ছাড়িয়ে নিলেন? এই গোটা বিষয় আলোচনা করলে মন্ত্রীকে প্রাথমিক সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না।
ক্ষমতাবানদের অপকর্মের সাজা না হলেও যে প্রক্রিয়ায় অপকর্মগুলোকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চালানো হয়, তাতে মধ্যিখানে কিছু অসহায় মানুষকে সারা জীবনের জন্য চরমভাবে নাস্তানাবুদ হতে হয়। সেই সাগর-রুনীর হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হলেও বলির পাঁঠা বানানোর অপচেষ্টার যে খবর পাওয়া গেছে তাতে, স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে এ পর্যন্ত নিদেনপক্ষে দুই ডজনেরও বেশি মানুষ ঘৃণ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যেখানে লন্ড্রির স্লিপের সূত্র ধরে লন্ড্রিম্যানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, সেখানে টাকার সাথে মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ আরো কতিপয় লোককে ঘিরে যে গুঞ্জন চলছে, পুলিশ কি পারবে তাদের সঙ্গেও একই আচরণ করতে? মাঝখানে টাকার কথা বিজিবিকে বলে দেওয়াতে এবং গাড়িতে বাগড়া দেবার কারণে ড্রাইভার যে নিশ্চিতভাবে ফাঁসতে যাচ্ছে সেটা না বললেও চলে। অপরাধীদের সাদা করতে রিমান্ডে নিয়ে আর কতো মানুষের শার্ট যে নির্যাতনে লাল হবে কে জানে!
কথা উঠতে পারে, ড্রাইভারের সাথে এমন কি ঘটেছিল যে, এপিএস বিজিবির শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেন? নাকি ড্রাইভারই বিজিবিকে কোনো কারণে ডেকে এনেছিল? হতে পারে এপিএসের কথা আংশিক সত্য--- যে, ড্রাইভার টাকা ছিনতাই করতে গিয়েছিল। কিন্তু কেন? তাছাড়া ব্যক্তিগত টাকা হলে ড্রাইভার সেটা জানল কী করে? বরং এক্ষেত্রে বাতাসে ভেসে বেড়ানো গুঞ্জনই বেশি সত্য বলে মনে হয়। ডিপার্টমেন্টের ঘুষের ভাগ বাটোয়ারার টাকা বলেই ড্রাইভার সেটা জানতো। সে এটাও হয়তো দেখেছে যে, অবৈধ টাকার লেনদেন করে বড় সাহেবরা কিভাবে রাতারাতি কোটিপতি বনে গিয়েছেন। এভাবে এক সময় লোভটা তার ভিতরেও সংক্রমিত হওয়াতে সে ছিনতাইয়ে উদ্যোগী হয়। ড্রাইভারের লোভই হয়তো সাহায্য করেছে এতো টাকার উপস্থিতি মানুষকে জানাতে। এপিএসও ভেবেছিলেন, একবার বিজিবির কাছে গেলে মন্ত্রীর কথা বললে সেখানেও বাড়তি কদর পাওয়া যাবে।
এপিএস আরো বলেছেন, ড্রাইভার দীর্ঘদিন মাদকাসক্ত ছিল। ড্রাইভার মাদকাসক্ত ছিল কিনা বা তাকে পরিস্থিতির শিকার করে মাদকাসক্ত বানানো হচ্ছ--দুটোই ভিন্ন বিষয়। টাকার সংগে এটাকে ঘুলিয়ে ফেলা যাবে না। এখানে আসল কথাটা হলো, টাকা কোত্থেকে এলো এবং কোথায় যাচ্ছিল? ড্রাইভারকে মাদকাসক্ত বলে বাঁচতে গিয়ে বরং আরেকটি অপরাধ প্রকাশ হয়ে গেল। ড্রাইভার যদি মাদকাসক্ত হয়, তবে এতোদিন কেন তাকে চাকরীতে বহাল রাখা হলো? সরকারী গাড়ি চালানোর মতো একটা স্পর্শকাতর কাজের সংগে জেনেশুনে কি করে একজন মাদকাসক্তকে রাখা হলো?
দাদা তার ঘোষণা মোতাবেক রেলের বিড়াল ধরতে না পারলেও বিড়ালের বংশ কিন্তু ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিড়ালের প্রজনন রেল মন্ত্রণালয়ে এতোটাই গতিশীল ছিল যে, দাদা বিড়াল ধরার আগেই থলের ভিতর বিড়াল ডেকে উঠল: ‘ম্যাও’!
ওরে বাবা! একটা নয়, দুইটা নয়, ৭০ লাখ কালো বিড়াল!
দ্যাখেন তো দাদা, ঐগুলো সেই বিড়াল কিনা! যেটা আপনি খুঁজছিলেন!
আর বিড়ালের মালিক বা মালিকেরা? তারা কোথায়? জনগণ কোনোদিন সেটা জানতে পারবে কি?
তবে এখনো বলা যাচ্ছে না যে, বিড়ালটা সাদা নাকি কালো। অবশ্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যও অপেক্ষা করছি না। জানি তো সেই রিপোর্টে কি থাকবে! বড়জোর এপিএস বলির পাঁঠা হবে, নয়তো এযাত্রা সে-ও বেঁচে যাবে। ঘুষখোর ধরলে যেমনটি হয়: ‘’বাড়িটা আসলে ঘুষের টাকায় কেনা নয়। দয়ালু শ্বশুর দিয়েছিলেন।‘’
কিন্তু দয়াল বাবা, শ্বশুর-আব্বা টাকাটা কোথায় পেলেন ততোদূর আর যাওয়া হয় না কখনো।
mahalom72@yahoo.com
দিন যায়, মাস যায়। রাজকুমার আর ফেরে না। আবারো কান্নার রোল। হঠাৎ চারিদিকে ধুলোর ঝড় তুলে টগবগ টগবগ ঘোড়া চালিয়ে রাজকুমার ফিরে এলো বিজয়ীর বেশে। সঙ্গে তার থলেভর্তি অগণিত মোহর। ঘোষণা দিয়ে রাজকুমার লুণ্ঠিত মাল সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলেন।
এটা গল্পেই সম্ভব হয়েছে। বাস্তবের রাজকুমারেরা প্রায়শই শুধু রাক্ষসের প্রহরী নয়, বরং নিজেরাই একেকটা ভয়ংকর রক্তচোষা রাক্ষস হয়ে যায়। আমাদের কথা গল্পের মাঝখান পর্যন্ত, যেখানে জনগণের সম্পদ চুরি হয়ে যায় এবং একে একে রক্ষক, ভক্ষকের ভূমিকায় নামে। এর পরেরটুকু শুধুই স্বপ্ন।
বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত কোনো বিভাগ চেরাগ জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘রেলের সেই কালো বিড়ালটা’ ধরবেন বলে। মন্ত্রিত্ব পাবার পরে তাই অনেকেই টিপ্পনি কেটেছিল: এবার দেখা যাবে দাদা, আপনি কতোখানি সাদা। কিন্তু ওমা! কালো বিড়ালেরা দেখি এতোদিন তার সাথে একই গাড়িতে চলাফেরা করেছেন।
এবার মূল ঘটনায় নজর দেয়া যাক। গত সোমবার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমার ফারুক তালুকদার কথিত ঘুষের ৭০ লাখ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা খেয়েছেন। এ সময় তার সংগে ছিলেন রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। তাদের গন্তব্য নাকি ছিল রেলমন্ত্রীর জিগাতলার বাসা। ঘটনার তদন্তে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটির প্রধান করা হয় স্বয়ং মন্ত্রীরই ব্যক্তিগত সচিবকে এবং অপরটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। এরই মধ্যে বাতাসে কানাঘুষা চলছে যে, রেলের পূর্বঞ্চলের নিয়োগ বাণিজ্যের অবৈধ ইনকামের একটা বড় অংশ মন্ত্রীকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই গাড়ি জিগাতলামুখী ছিল। এই নিয়োগবাণিজ্যে মন্ত্রণালয়ের উপর মহলের অনেকেই নাকি জড়িত।
কোনোটাই প্রমাণিত নয়। মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার পরম্পরায় সন্দেহগুলোকে উড়িয়ে দেবারও উপায় নেই। এই প্রেক্ষাপটে তদন্ত কমিটিতে স্বচ্ছতা না এনে যাদের জড়িয়ে এই ব্যাপক অর্থকেলেংকারীর গুজব উঠেছে তাদের কিংবা তাদের সহকর্মী-সহযোগীদেরই করা হলো তদন্ত কমিটির প্রধান। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হোল যে, সরকার গা বাঁচাতে এই কমিটি করেছে এবং যার মূল উদ্দেশ্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া। এর আগেও জনগণ অনেক তদন্ত কমিটি দেখেছে। এরই মধ্যে স্বয়ং মন্ত্রীর কিছু কাজে এবং কথাবার্তা থেকে তদন্তের ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানা হয়ে গিয়েছে।
মন্ত্রী বলেছেন, “কিসের টাকা তা আমি জানি না। তবে ওই টাকার মালিক এপিএস ওমর ফারুক। নিজের টাকা নিজের সংগে রাখার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ তার টাকা তিনি কোথায় রাখবেন, নিজের সংগে রাখবেন নাকি বাসায় রাখবেন, তা তার ব্যাপার” (রেলভবনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত)। এবং তিনি ঘটনার পরপরই মন্ত্রিত্বের জোর খাটিয়ে তার এপিএসকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রী যখন তদন্তের আগে বলেই দিয়েছেন যে, এটা তার ব্যক্তিগত টাকা, সেখানে তার পিএসের (যিনি কিনা একটা কমিটির প্রধান) ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে, উল্টোটা বলেন!
মন্ত্রী সাহেব, আপনার এপিএস কতো বড়লোক ছিলেন যে, গাড়িতেই ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করেন? তাহলে তার ব্যাংকে কি পরিমাণ টাকা জমানো আছে সেটার হিসেবই কি কখনো দেখা হবে? বিভিন্ন পত্রিকায় পড়লাম আপনার এপিএস নাকি খুবই সাদাসিধে পরিবার থেকে এসেছেন। হঠাৎ করে এতো টাকা কিভাবে উড়ে এসে গাড়িতে জুড়ে বসল? এপিএসের ব্যক্তিগত টাকা যেখানে খুশি সেখানে রাখা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি হয়, তবে পরবর্তী সময়ে তাকে কেন সাময়িক বহিষ্কার করলেন?
জানি, এই ঘটনায় রাঘব বোয়াল জড়িত থাকলে এ আমলে নিশ্চয়ই তারা থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য বরাবরই একই রকম। ক্ষমতায় এলে ব্যক্তির দায়ভার দল নিজ ঘাড়ে নিয়ে দলকেই ডুবিয়ে ছাড়ে। এর কারণ হতে পারে বহুবিধ। প্রথমত: দল এবং ব্যক্তিকে এক করে ঘুলিয়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত: পুরো দলই কোনো না কোনোভাবে একই কাজে যুক্ত। তাই ঠগ বাছতে গ্রাম উজাড় না করে বরং ঠগকেই শেল্টার দিতে হয়।
সমালোচনার সুনামি সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে বিরোধীদলসহ সবারই রয়েছে প্রবল আপত্তি। বিরোধী দল থেকে দাবি উঠেছে যে, শুধু এপিএস নন, স্বয়ং মন্ত্রীও এর সংগে জড়িত।
তদন্তের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যেমন ঠিক না; ঠিক তেমনি সন্দেহের যথাযথ কারণ থাকলে তদন্তের সময় সেগুলো আমলে নেওয়াও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েকটি বিষয়ের কারণে সন্দেহের তীর মন্ত্রীর দিকে যায়। পৃথিবীর সব দেশেই উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কারো অধীনস্ত কেউ বা কোনো্ নিকট আত্মীয়ের অপকর্মের সমালোচনা প্রথমভাগে সেই ব্যক্তিকেও পোহাতে হয়, যতোদিন না প্রমাণিত হয় ঘটনার সংগে তিনি জড়িত নন। এক্ষেত্রে যিনি টাকাসহ ধরা খেয়েছেন তিনি মন্ত্রীর এপিএস। আমাদের মতো দেশে মন্ত্রীদের টাকা খাওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া টাকাসহ গাড়ির গন্তব্যস্থল নাকি ছিল জিগাতলার মন্ত্রীর বাড়ি। টাকা এবং গাড়িসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়ার জায়গাটাই বলে দেয় কথাটা সত্য। এতো টাকাসহ মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার কারণ কী? আরো গুজব আছে, পূর্ব অঞ্চলের রেল বিভাগের চাকরীর জন্য নাকি প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে। তদন্তের আগেই মন্ত্রী কেন এপিএসের পক্ষে সাফাই গাইলেন এবং তাকে ছাড়িয়ে নিলেন? এই গোটা বিষয় আলোচনা করলে মন্ত্রীকে প্রাথমিক সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না।
ক্ষমতাবানদের অপকর্মের সাজা না হলেও যে প্রক্রিয়ায় অপকর্মগুলোকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চালানো হয়, তাতে মধ্যিখানে কিছু অসহায় মানুষকে সারা জীবনের জন্য চরমভাবে নাস্তানাবুদ হতে হয়। সেই সাগর-রুনীর হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হলেও বলির পাঁঠা বানানোর অপচেষ্টার যে খবর পাওয়া গেছে তাতে, স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে এ পর্যন্ত নিদেনপক্ষে দুই ডজনেরও বেশি মানুষ ঘৃণ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যেখানে লন্ড্রির স্লিপের সূত্র ধরে লন্ড্রিম্যানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, সেখানে টাকার সাথে মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ আরো কতিপয় লোককে ঘিরে যে গুঞ্জন চলছে, পুলিশ কি পারবে তাদের সঙ্গেও একই আচরণ করতে? মাঝখানে টাকার কথা বিজিবিকে বলে দেওয়াতে এবং গাড়িতে বাগড়া দেবার কারণে ড্রাইভার যে নিশ্চিতভাবে ফাঁসতে যাচ্ছে সেটা না বললেও চলে। অপরাধীদের সাদা করতে রিমান্ডে নিয়ে আর কতো মানুষের শার্ট যে নির্যাতনে লাল হবে কে জানে!
কথা উঠতে পারে, ড্রাইভারের সাথে এমন কি ঘটেছিল যে, এপিএস বিজিবির শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেন? নাকি ড্রাইভারই বিজিবিকে কোনো কারণে ডেকে এনেছিল? হতে পারে এপিএসের কথা আংশিক সত্য--- যে, ড্রাইভার টাকা ছিনতাই করতে গিয়েছিল। কিন্তু কেন? তাছাড়া ব্যক্তিগত টাকা হলে ড্রাইভার সেটা জানল কী করে? বরং এক্ষেত্রে বাতাসে ভেসে বেড়ানো গুঞ্জনই বেশি সত্য বলে মনে হয়। ডিপার্টমেন্টের ঘুষের ভাগ বাটোয়ারার টাকা বলেই ড্রাইভার সেটা জানতো। সে এটাও হয়তো দেখেছে যে, অবৈধ টাকার লেনদেন করে বড় সাহেবরা কিভাবে রাতারাতি কোটিপতি বনে গিয়েছেন। এভাবে এক সময় লোভটা তার ভিতরেও সংক্রমিত হওয়াতে সে ছিনতাইয়ে উদ্যোগী হয়। ড্রাইভারের লোভই হয়তো সাহায্য করেছে এতো টাকার উপস্থিতি মানুষকে জানাতে। এপিএসও ভেবেছিলেন, একবার বিজিবির কাছে গেলে মন্ত্রীর কথা বললে সেখানেও বাড়তি কদর পাওয়া যাবে।
এপিএস আরো বলেছেন, ড্রাইভার দীর্ঘদিন মাদকাসক্ত ছিল। ড্রাইভার মাদকাসক্ত ছিল কিনা বা তাকে পরিস্থিতির শিকার করে মাদকাসক্ত বানানো হচ্ছ--দুটোই ভিন্ন বিষয়। টাকার সংগে এটাকে ঘুলিয়ে ফেলা যাবে না। এখানে আসল কথাটা হলো, টাকা কোত্থেকে এলো এবং কোথায় যাচ্ছিল? ড্রাইভারকে মাদকাসক্ত বলে বাঁচতে গিয়ে বরং আরেকটি অপরাধ প্রকাশ হয়ে গেল। ড্রাইভার যদি মাদকাসক্ত হয়, তবে এতোদিন কেন তাকে চাকরীতে বহাল রাখা হলো? সরকারী গাড়ি চালানোর মতো একটা স্পর্শকাতর কাজের সংগে জেনেশুনে কি করে একজন মাদকাসক্তকে রাখা হলো?
দাদা তার ঘোষণা মোতাবেক রেলের বিড়াল ধরতে না পারলেও বিড়ালের বংশ কিন্তু ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিড়ালের প্রজনন রেল মন্ত্রণালয়ে এতোটাই গতিশীল ছিল যে, দাদা বিড়াল ধরার আগেই থলের ভিতর বিড়াল ডেকে উঠল: ‘ম্যাও’!
ওরে বাবা! একটা নয়, দুইটা নয়, ৭০ লাখ কালো বিড়াল!
দ্যাখেন তো দাদা, ঐগুলো সেই বিড়াল কিনা! যেটা আপনি খুঁজছিলেন!
আর বিড়ালের মালিক বা মালিকেরা? তারা কোথায়? জনগণ কোনোদিন সেটা জানতে পারবে কি?
তবে এখনো বলা যাচ্ছে না যে, বিড়ালটা সাদা নাকি কালো। অবশ্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যও অপেক্ষা করছি না। জানি তো সেই রিপোর্টে কি থাকবে! বড়জোর এপিএস বলির পাঁঠা হবে, নয়তো এযাত্রা সে-ও বেঁচে যাবে। ঘুষখোর ধরলে যেমনটি হয়: ‘’বাড়িটা আসলে ঘুষের টাকায় কেনা নয়। দয়ালু শ্বশুর দিয়েছিলেন।‘’
কিন্তু দয়াল বাবা, শ্বশুর-আব্বা টাকাটা কোথায় পেলেন ততোদূর আর যাওয়া হয় না কখনো।
mahalom72@yahoo.com
No comments