রাজনৈতিক এপিএসের দায়িত্ব মন্ত্রীরই by আশরাফুল হক রাজীব

'আমার এপিএস একটা সময় পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকার পর কোথায় যায়, তা জানার দায়িত্ব আমার নয়'- রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ কথা বলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করলেও জনপ্রশাসন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন অন্য কথা। তাঁদের মতে, মন্ত্রীরা সাধারণত নিজের পছন্দ অনুযায়ী এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) নিয়োগ


দেন। তাই তাঁদের দায়িত্ব বা কৃতকর্মের দায় মন্ত্রীদের ওপরই বর্তায়। গত মঙ্গলবার নিজের এপিএস ওমর ফারুক বিপুল টাকাসহ ধরা পড়লে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সাংবাদিকদের বলেন, 'আমার এপিএস একটা সময় পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকে। আমার সঙ্গে থাকার পর সে কোথায় যায়, তা জানার দায়িত্ব আমার নয়। সে খোঁজ রাখাও সম্ভব নয়।'
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এম হাফিজউদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব অবশ্যই মন্ত্রীর ওপর বর্তায়। কারণ মন্ত্রীর ইচ্ছায় এবং সুপারিশে এপিএস নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই এপিএসের কৃতকর্মের দায়িত্ব তাঁকে নিতেই হবে।' তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার সময় তদন্ত করা হয়। মন্ত্রীর ইচ্ছায় এপিএস নিয়োগ দেওয়ার সময় কোনো তদন্ত হয় না। শুধু একটা বায়োডাটার মাধ্যমে চাকরি হয়ে যায়। অথচ তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
রেলমন্ত্রীর এপিএসের বিপুল টাকা নিয়ে ধরা পড়া প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় এনে বিচার করা উচিত।'
গত ডিসেম্বরে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ওমর ফারুককে এপিএস নিয়োগ দেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ডিও লেটার (উপ-আনুষ্ঠানিক পত্র) দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর ডিও লেটারের ভিত্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিব নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করে। এপিএস নিয়োগের বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রীরও নজরে নেওয়া হয় না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, 'এপিএস নিয়োগের জন্য কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা নেই। বায়োডাটার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। তবে আমরা চাই নূ্যনতম স্নাতক পাস। কারণ এপিএস মন্ত্রীর খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন। অবস্থানগত কারণে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এপিএস যেকোনো সময় যেকোনো তথ্য পাচার করে দিতে পারেন। এর ফলে মন্ত্রী নিজে বিপদে পড়েন। অনেক সময় পুরো সরকারই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। আস্থাহীনতার কারণে গত তিন বছরে একাধিক মন্ত্রী একাধিকবার তাঁদের এপিএস বদল করেছেন।'
ওই কর্মকর্তা বলেন, এপিএস নিয়োগ দেওয়া হয় মন্ত্রীর ইচ্ছায়। এপিএসের নিয়োগপত্রেই উল্লেখ করা থাকে যত দিন পর্যন্ত মন্ত্রী চাইবেন, তত দিন পর্যন্ত তিনি এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অথবা মন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী মন্ত্রীর মেয়াদকাল পর্যন্ত তিনি এপিএস থাকতে পারবেন।
জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, মন্ত্রীর ইচ্ছায় এপিএস নিয়োগ দেওয়ার সময় কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। 'দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্ট্যাট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেম্যুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেজ) অ্যাক্ট, ১৯৭৩' অনুযায়ী মন্ত্রী তাঁর পছন্দে ৯ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ পান। এর মধ্যে পিএস এবং এপিএস রয়েছেন। পিএস মন্ত্রীর ইচ্ছায় হলেও তাঁকে অবশ্যই উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা হতে হবে। মন্ত্রীর এপিএসের পদমর্যাদা সিনিয়র সহকারী সচিব। সরকারি কর্মচারীদেরও এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর এপিএস রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও তাঁর পরিচিত ওমর ফারুককে এপিএস নিয়োগ দেন।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় পিএস ও এপিএস নিয়োগ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা তাঁর পছন্দের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বাধ্য করেছিলেন। অনেক মন্ত্রী উপদেষ্টার কথা আমলে নেননি। উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের কারণে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী প্রায় এক বছর পিএস ও এপিএস ছাড়াই কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা পিএসের কাজ চালিয়ে নেন। পরে ওই কর্মকর্তাকে মন্ত্রী পিএস নিয়োগ দিতে চেয়েছেন; কিন্তু বাদ সাধেন উপদেষ্টা। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জোট সরকারের সময় বিশেষ সুবিধা নেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছাত্রদলের অনুসারী ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, এপিএসদের মাধ্যমেই অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দুর্নীতি করেন। আবার অনেক সময় এপিএস মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে নিজেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন। এসব জটিলতার কারণেই বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী এপিএস পদে তাঁর ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.