এই দিনে-কী নির্মম-নির্দয় স্মৃতিপট by এম আর আলম
খাদিজা বেগমের স্বামী ছিলেন নাটকপাগল একজন মানুষ। নাটকে বাঙালি চেতনাকে উজ্জীবিত করে, এমন সংলাপ আওড়াতেন তিনি। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল তাঁর উচ্চারণে। হাসির নটরাজ নূর মোহাম্মদের এসব বিদ্রূপাত্মক সংলাপ যেন বিষাক্ত তিরের মতো বিঁধত বিহারিদের মনে।
ওই বিহারিরা নূর মোহাম্মদকে বাঁচতে দেয়নি। নির্মম-নিষ্ঠুরতায় মস্ত বড় রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
এমন কাহিনি শুনিয়ে যাচ্ছেন খাদিজা ৪১ বছর ধরে। মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য স্বামীর ওই আত্মত্যাগী অবদানকে তিনি স্মৃতিতে ভাস্বর রাখতে চান।
মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের ১০ সদস্যকে হারানো আবদুর রশিদ ও তাঁর মর্মবেদনার কথা বারবার শুনিয়েছেন বিভিন্ন সভামঞ্চে। যা শুনে কেঁদেছে উপস্থিত তাবত মানুষ। রশিদের স্মৃতিতে আজও মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তখন তাঁর বয়স কত আর হবে? হয়তো ১০ বছর। ওই শিশুটির চোখের সামনেই তাঁর নববিবাহিতা বোনকে ধর্ষণ করা হয়। রশিদ দেখেছে একে একে মানুষরূপী জল্লাদেরা মা-বোন, ভাই ও প্রাণপ্রিয় দাদুকে কী নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিল! ওই হত্যাযজ্ঞের হোতাদের এখনো রশিদ চোখের সামনে বুক চিতিয়ে হাঁটতে দেখে, তখন কষ্টে-বেদনায় নীল হয়ে ওঠে তাঁর অবয়ব।
মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর শহরের চার হাজারেরও বেশি মুক্তিপাগল মানুষকে অকাতরে জীবন দিতে হয়েছে। দেশের জন্য তাঁদের এই উৎসর্গের ইতিহাস কেউ জানেন না সেভাবে। তবুও নীরবে এ শহরের মানুষ ১২ এপ্রিল স্থানীয়ভাবে শহীদ দিবস পালন করে আসছে ৪১ বছর ধরে।
কী ঘটেছিল ১২ এপ্রিল: বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের স্বাধীনতার ডাক শুনে উজ্জীবিত হয় নিজভূমে পরবাসীর মতো সৈয়দপুরের বাঙালিরা। সত্যি সত্যিই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়।
প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতা শমসের আলী বসুনিয়া তাঁর স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রেরণার উৎস। দিনাজপুর থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন এনে আমরা “তিরন্দাজ”-এর প্রশিক্ষণ নিতে থাকি। কেউ কেউ জোগাড় করেন বাঁশের লাঠি, বল্লম, তলোয়ার। এসব নিয়ে আমরা সৈয়দপুরে পাকিস্তানিদের ক্যান্টনমেন্টে হামলার পরিকল্পনা করতে থাকি।’
সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর সৈয়দপুর শহরে ভারত থেকে আসা বিহারিরা জড়ো হয়। বিভিন্ন সময় ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধলেই মুসলমান বিহারিরা সৈয়দপুরে এসে গড়ে তোলে বসতি।
তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের রেলওয়ে কারখানার অবস্থান সৈয়দপুরে হওয়ায় অনেক আগে থেকেই বিহারি কারিগরেরা চাকরিসূত্রে এ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিল। তাদের ঘিরেই ভারত থেকে আসা বিহারিরা সৈয়দপুরকে তাদের নিজেদের শহর মনে করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় নিজ দেশে এখানে বাঙালিরাই হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু।
১৯ মার্চ সৈয়দপুর শহরের লিবার্টি সিনেমা হলে বাংলা চলচ্চিত্র আপন পর মুক্তি পায়। তবে অন্য হলগুলোতে চলছিল পাকিস্তানি উর্দু ছবি। বাংলা ছবি কেন চলবে? এর প্রতিবাদে শহরের বিহারিরা ফেটে পড়ে। সিনেমা হলে হামলা চালায় তারা। প্রতিবাদে কাঁপে বাঙালিরাও। তারা বেরিয়ে আসে রাজপথে। যেন সংস্কৃতির জন্য বাঙালির বিপ্লব। সেদিন দাঙ্গা বেধে যায় বাঙালি-বিহারির মধ্যে।
২৩ মার্চ ছিল ঢাকায় পতাকা দিবস। সেদিন বাঙালিরা তাদের বাসায়, দোকানপাটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা ওড়ায়। বিহারিরা সেদিন পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে যাচ্ছিল।
স্বাধীন বাংলার পতাকা দেখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বিহারিরা। সৈয়দপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তথা নেজামে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিন হাশমির নেতৃত্বে বাঙালি নিধনে পরিকল্পনা আঁটে তারা। বাঙালি পরিবারগুলোকে শহরে অবরুদ্ধ করা হয়। ওই অবরুদ্ধ বাঙালিদের পরদিন উদ্ধার করতে আসেন পার্শ্ববর্তী দিনাজপুরের আলোকডিহি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মীর্জা মাহতাব বেগ। শত শত গ্রামবাসীর হাতে লাঠিসোঁটা, বল্লম, দুটি রাইফেল, একটি বন্দুক আর একটি রিভলভার ছিল অস্ত্র। বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ২৪ মার্চ। আর ওই প্রতিরোধে শহীদ হন বীর বাঙালি মাহতাব বেগ।
তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হক অবরুদ্ধ বাঙালিকে সান্ত্বনা দেন। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, মরলে এক সঙ্গে, বাঁচলেও এক সঙ্গে। তবে এ দেশ থেকে পাকিস্তানিদের হটতেই হবে। গোটা শহরটাই বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। বন্দী করা হয় ডা. জিকরুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ন্যাপ নেতা ডা. এস এম ইয়াকুব, রেলওয়ে কর্মকর্তা আয়েজ উদ্দিন, আইয়ুব হোসেন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাসহ দেড় শতাধিক নেতৃস্থানীয় বাঙালিকে বন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার গার্ডে। তাদের ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের নিসবেতগঞ্জ বালাখাল বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
দিবসটি স্মরণীয় রাখতে প্রজন্ম ’৭১ সৈয়দপুর জেলা শাখার পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন। তিনি বলেন, গোলাহাট ট্রেন ট্র্যাজেডি, টাটিয়া জুট প্রেস হত্যাকাণ্ড, রেলওয়ে কারখানায় বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিধনসহ প্রতিটি নির্মম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস বর্ণনা করা হবে ১২ এপ্রিল স্থানীয় শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানমালায়।
এম আর আলম
এমন কাহিনি শুনিয়ে যাচ্ছেন খাদিজা ৪১ বছর ধরে। মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য স্বামীর ওই আত্মত্যাগী অবদানকে তিনি স্মৃতিতে ভাস্বর রাখতে চান।
মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের ১০ সদস্যকে হারানো আবদুর রশিদ ও তাঁর মর্মবেদনার কথা বারবার শুনিয়েছেন বিভিন্ন সভামঞ্চে। যা শুনে কেঁদেছে উপস্থিত তাবত মানুষ। রশিদের স্মৃতিতে আজও মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তখন তাঁর বয়স কত আর হবে? হয়তো ১০ বছর। ওই শিশুটির চোখের সামনেই তাঁর নববিবাহিতা বোনকে ধর্ষণ করা হয়। রশিদ দেখেছে একে একে মানুষরূপী জল্লাদেরা মা-বোন, ভাই ও প্রাণপ্রিয় দাদুকে কী নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিল! ওই হত্যাযজ্ঞের হোতাদের এখনো রশিদ চোখের সামনে বুক চিতিয়ে হাঁটতে দেখে, তখন কষ্টে-বেদনায় নীল হয়ে ওঠে তাঁর অবয়ব।
মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর শহরের চার হাজারেরও বেশি মুক্তিপাগল মানুষকে অকাতরে জীবন দিতে হয়েছে। দেশের জন্য তাঁদের এই উৎসর্গের ইতিহাস কেউ জানেন না সেভাবে। তবুও নীরবে এ শহরের মানুষ ১২ এপ্রিল স্থানীয়ভাবে শহীদ দিবস পালন করে আসছে ৪১ বছর ধরে।
কী ঘটেছিল ১২ এপ্রিল: বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের স্বাধীনতার ডাক শুনে উজ্জীবিত হয় নিজভূমে পরবাসীর মতো সৈয়দপুরের বাঙালিরা। সত্যি সত্যিই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়।
প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতা শমসের আলী বসুনিয়া তাঁর স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রেরণার উৎস। দিনাজপুর থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন এনে আমরা “তিরন্দাজ”-এর প্রশিক্ষণ নিতে থাকি। কেউ কেউ জোগাড় করেন বাঁশের লাঠি, বল্লম, তলোয়ার। এসব নিয়ে আমরা সৈয়দপুরে পাকিস্তানিদের ক্যান্টনমেন্টে হামলার পরিকল্পনা করতে থাকি।’
সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর সৈয়দপুর শহরে ভারত থেকে আসা বিহারিরা জড়ো হয়। বিভিন্ন সময় ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধলেই মুসলমান বিহারিরা সৈয়দপুরে এসে গড়ে তোলে বসতি।
তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের রেলওয়ে কারখানার অবস্থান সৈয়দপুরে হওয়ায় অনেক আগে থেকেই বিহারি কারিগরেরা চাকরিসূত্রে এ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিল। তাদের ঘিরেই ভারত থেকে আসা বিহারিরা সৈয়দপুরকে তাদের নিজেদের শহর মনে করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় নিজ দেশে এখানে বাঙালিরাই হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু।
১৯ মার্চ সৈয়দপুর শহরের লিবার্টি সিনেমা হলে বাংলা চলচ্চিত্র আপন পর মুক্তি পায়। তবে অন্য হলগুলোতে চলছিল পাকিস্তানি উর্দু ছবি। বাংলা ছবি কেন চলবে? এর প্রতিবাদে শহরের বিহারিরা ফেটে পড়ে। সিনেমা হলে হামলা চালায় তারা। প্রতিবাদে কাঁপে বাঙালিরাও। তারা বেরিয়ে আসে রাজপথে। যেন সংস্কৃতির জন্য বাঙালির বিপ্লব। সেদিন দাঙ্গা বেধে যায় বাঙালি-বিহারির মধ্যে।
২৩ মার্চ ছিল ঢাকায় পতাকা দিবস। সেদিন বাঙালিরা তাদের বাসায়, দোকানপাটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা ওড়ায়। বিহারিরা সেদিন পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে যাচ্ছিল।
স্বাধীন বাংলার পতাকা দেখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বিহারিরা। সৈয়দপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তথা নেজামে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিন হাশমির নেতৃত্বে বাঙালি নিধনে পরিকল্পনা আঁটে তারা। বাঙালি পরিবারগুলোকে শহরে অবরুদ্ধ করা হয়। ওই অবরুদ্ধ বাঙালিদের পরদিন উদ্ধার করতে আসেন পার্শ্ববর্তী দিনাজপুরের আলোকডিহি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মীর্জা মাহতাব বেগ। শত শত গ্রামবাসীর হাতে লাঠিসোঁটা, বল্লম, দুটি রাইফেল, একটি বন্দুক আর একটি রিভলভার ছিল অস্ত্র। বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ২৪ মার্চ। আর ওই প্রতিরোধে শহীদ হন বীর বাঙালি মাহতাব বেগ।
তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হক অবরুদ্ধ বাঙালিকে সান্ত্বনা দেন। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, মরলে এক সঙ্গে, বাঁচলেও এক সঙ্গে। তবে এ দেশ থেকে পাকিস্তানিদের হটতেই হবে। গোটা শহরটাই বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। বন্দী করা হয় ডা. জিকরুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ন্যাপ নেতা ডা. এস এম ইয়াকুব, রেলওয়ে কর্মকর্তা আয়েজ উদ্দিন, আইয়ুব হোসেন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাসহ দেড় শতাধিক নেতৃস্থানীয় বাঙালিকে বন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার গার্ডে। তাদের ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের নিসবেতগঞ্জ বালাখাল বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
দিবসটি স্মরণীয় রাখতে প্রজন্ম ’৭১ সৈয়দপুর জেলা শাখার পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন। তিনি বলেন, গোলাহাট ট্রেন ট্র্যাজেডি, টাটিয়া জুট প্রেস হত্যাকাণ্ড, রেলওয়ে কারখানায় বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিধনসহ প্রতিটি নির্মম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস বর্ণনা করা হবে ১২ এপ্রিল স্থানীয় শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানমালায়।
এম আর আলম
No comments