চারদিক-বনে বনে চাঁদের হাসি by আকমল হোসেন
চা-বাগানের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ গেছে পাকা। কিন্তু সব পথ পাকা নয়। কাঁচা উঁচুনিচু টিলার পাহাড়ি পথ। আমরা যাচ্ছি জিপে করে। এ রকম জিপ শুধু পাহাড়ি এলাকায়ই চলে। অন্য কোনো গাড়ি নিয়ে এ পথে যাওয়া মুশকিল। গাড়ি একবার উঁচুতে ওঠে তো আরেকবার যেন শিখর থেকে শিকড়ে নামে।
আর আমরা ‘জাম জোকা’ অর্থাৎ গাড়ির পেটের ভেতর ঘুঁটা হতে থাকি। তবে খারাপ লাগে না। দুই পাশে চা-বাগান, বনের গাছ-লতা দেখতে ভালো লাগে। আমরা যাচ্ছি শ্রীমঙ্গল উপজেলার নাহারপুঞ্জিতে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই বুঝি গাড়ি আটকে গেল। কিন্তু না, ঠিকই এগিয়ে চলে। ভাবছিলাম, এ রকম দুর্গম পথ দিয়ে নগরসভ্যতার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রক্ষা করে একদল আদিবাসী মানুষ! যদিও এই দুর্গমতা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। বরং এই জঙ্গলের গভীরে যদি তারা নিরাপদ থাকে, শান্তিতে থাকতে পারে—তাতেই তাদের সুখ।
একসময় গাড়িচালক ব্রেক কষলে গাড়ি থামল। বোঝা গেল, আমরা গন্তব্যে পৌঁছেছি। টিলার ওপর সুন্দর ছিমছাম ঘর। ঝকঝকে নিকানো উঠোন। গাড়িচালক নিজ থেকেই জানালেন, এ রকম পথে সব চালক গাড়ি নিয়ে আসতে সাহস পায় না। কখন যে ইঞ্জিন বিগড়ে যায়। এখানে আদিবাসী খাসি, স্থানীয়ভাবে যাদের ‘খাসিয়া’ নামে সবাই চেনে—তাদের বাস। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস ‘খাসিয়া পান’ চাষ। টিলার ওপর উঠেই চমক। ছোট এক শিশুকন্যা, বয়স কত হবে! সাত-আট! পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা আরেকটি শিশু। সেই শিশুকন্যাটি আরেক শিশুকে নিয়ে টিলার এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভবিষ্যতের এক মা যেন এভাবেই বেড়ে উঠছে সবার অলক্ষ্যে। বাইরের লোকজনকে দেখে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে ঘরের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণীমাতা, কোলে তাঁর ফুটফুটে শিশু। সেই মায়ের মুখটিতে মৃদু সরল হাসি। এত সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত হাসি যে, চট করে ‘চাঁদের হাসি’ কথাটি মনে পড়ে যায়। মা ও শিশুর সরলতা যেন একে অপরকে জড়িয়ে জীবনকে অর্থময়, সুন্দর করেছে।
জানা গেল, এখানে দুটি পুঞ্জি আছে। নাহার খাসিয়াপুঞ্জি-১ ও নাহার খাসিয়াপুঞ্জি-২। প্রায় তিন দশক ধরে দুটি পুঞ্জিতে খাসিয়ারা বসবাস করছে। নাহার চা-বাগানের আগের মালিকের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে আদিবাসীরা দুটি পুঞ্জিতে প্রায় সাড়ে চার শ একর জমিতে পান, সুপারি, ফলদ ও বনজ গাছগাছড়া রোপণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে এক নম্বর খাসিয়াপুঞ্জিতে ২৮টি পরিবারের প্রায় ২০০ এবং দুই নম্বর খাসিয়াপুঞ্জিতে ৩৫টি পরিবারের আড়াই শ লোক বাস করছে। তবে কিছুদিন ধরে নাহার চা-বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাদের মধ্যে উচ্ছেদ আতঙ্ক কাজ করছে। অনেকের কথার মধ্যেই সেই আতঙ্কের আভাস পাওয়া গেল। হয়তো ভয়ের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। তাদের ভয়, পুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হলে তারা যাবে কোথায়। পান চাষ ছাড়া আর কোনো পেশায়ও এই সরল আদিবাসীরা অভ্যস্ত নয়। তারা কী করবে, কী খাবে! হয়তো এ কারণেই পুঞ্জি এলাকায় চা-বাগান কর্তৃপক্ষের গাছ কাটা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। আমরা পুঞ্জির বিভিন্ন টিলায় ঘুরতে থাকি। উঁচু এক টিলা থেকে আরেক টিলায় যেতে বেশ ধকল যায়। তবু ভালোই লাগে। চোখে পড়ে বেশ কিছু ঘরের চালে সোলার প্যানেল, সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। দু-একটি ঘর থেকে টেলিভিশনের কথা ভেসে আসে। আমাদের দেখানো হলো সীমান্তের ওপার। এক ডাকের দূরত্বে ওপার বাংলা। একই ভাষার, একই সংস্কৃতির মানুষ। একে অপরের মুখ দেখার মতো দূরত্ব। তবু কেউ কারও প্রতিবেশী নয়। কাঁটাতারের বেড়া ভাগ করে রেখেছে সবাইকে।
হঠাৎ দু-একটা পাখি ডেকে ওঠে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য পংকজ কন্দ বললেন, ‘আগে খাসিয়াপুঞ্জি এলাকায় অনেক পাখি ছিল। এখন আর সেই সব পাখি দেখা যায় না। বড় গাছ না থাকায় পাখি বাসা করতে পারে না। পাখি পোকা খেত। এখন পাখি না থাকায় পোকা পানগাছকে আক্রমণ করছে। পান পাতা খেয়ে ফেলছে।’ আদিবাসীরা জানান, বছর কয়েক আগেও ধনেশ, ময়না, বুলবুলি, টিয়ে, ঘুঘু, হরিকল, বনমোরগ ইত্যাদি প্রকাশ্যেই দেখা যেত। এখন এসব চোখে পড়ে না। নাহারপুঞ্জিতেই দেখা বৃহত্তর সিলেট খাসি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি এন্ড্রু সলোমার বলেন, ‘আমরা চাই খাসিয়ারা যেভাবে ছিল, সে রকম শান্তিতে ও নিরাপদে থাকুক। তাদের জায়গাজমি, জুমপান থেকে যেন তারা উচ্ছেদ না হয়। কোনো কিছু করা হলে আদিবাসীদের সঙ্গে যেন আলোচনা সাপেক্ষে হয়। আমরা আদিবাসীরা পরিবেশ নষ্ট করি না। বন ধংস করি না। নিজের জীবিকার স্বার্থে গাছ টিকিয়ে রাখি।’
ফেরার পথে বারবার সেই সরল চাঁদের হাসিমুখটিই মনে পড়ছিল। এত সারল্যধরা মুখ সহসা চোখে পড়ে না। জীবন কত জটিল, সংকীর্ণ, স্বার্থপরতায় রুগ্ণ। কেন এ রকম হাসি সবার মুখে নেই! কিন্তু ভয়, এই হাসিটি অক্ষুণ্ন থাকবে তো! প্রত্যাশা করি, বনে বনে অনন্তকাল যেন এই হাসি অম্লান থাকে। ছড়িয়ে যায় সবখানে।
আকমল হোসেন: প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি।
একসময় গাড়িচালক ব্রেক কষলে গাড়ি থামল। বোঝা গেল, আমরা গন্তব্যে পৌঁছেছি। টিলার ওপর সুন্দর ছিমছাম ঘর। ঝকঝকে নিকানো উঠোন। গাড়িচালক নিজ থেকেই জানালেন, এ রকম পথে সব চালক গাড়ি নিয়ে আসতে সাহস পায় না। কখন যে ইঞ্জিন বিগড়ে যায়। এখানে আদিবাসী খাসি, স্থানীয়ভাবে যাদের ‘খাসিয়া’ নামে সবাই চেনে—তাদের বাস। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস ‘খাসিয়া পান’ চাষ। টিলার ওপর উঠেই চমক। ছোট এক শিশুকন্যা, বয়স কত হবে! সাত-আট! পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা আরেকটি শিশু। সেই শিশুকন্যাটি আরেক শিশুকে নিয়ে টিলার এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভবিষ্যতের এক মা যেন এভাবেই বেড়ে উঠছে সবার অলক্ষ্যে। বাইরের লোকজনকে দেখে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে ঘরের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণীমাতা, কোলে তাঁর ফুটফুটে শিশু। সেই মায়ের মুখটিতে মৃদু সরল হাসি। এত সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত হাসি যে, চট করে ‘চাঁদের হাসি’ কথাটি মনে পড়ে যায়। মা ও শিশুর সরলতা যেন একে অপরকে জড়িয়ে জীবনকে অর্থময়, সুন্দর করেছে।
জানা গেল, এখানে দুটি পুঞ্জি আছে। নাহার খাসিয়াপুঞ্জি-১ ও নাহার খাসিয়াপুঞ্জি-২। প্রায় তিন দশক ধরে দুটি পুঞ্জিতে খাসিয়ারা বসবাস করছে। নাহার চা-বাগানের আগের মালিকের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে আদিবাসীরা দুটি পুঞ্জিতে প্রায় সাড়ে চার শ একর জমিতে পান, সুপারি, ফলদ ও বনজ গাছগাছড়া রোপণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে এক নম্বর খাসিয়াপুঞ্জিতে ২৮টি পরিবারের প্রায় ২০০ এবং দুই নম্বর খাসিয়াপুঞ্জিতে ৩৫টি পরিবারের আড়াই শ লোক বাস করছে। তবে কিছুদিন ধরে নাহার চা-বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাদের মধ্যে উচ্ছেদ আতঙ্ক কাজ করছে। অনেকের কথার মধ্যেই সেই আতঙ্কের আভাস পাওয়া গেল। হয়তো ভয়ের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। তাদের ভয়, পুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হলে তারা যাবে কোথায়। পান চাষ ছাড়া আর কোনো পেশায়ও এই সরল আদিবাসীরা অভ্যস্ত নয়। তারা কী করবে, কী খাবে! হয়তো এ কারণেই পুঞ্জি এলাকায় চা-বাগান কর্তৃপক্ষের গাছ কাটা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। আমরা পুঞ্জির বিভিন্ন টিলায় ঘুরতে থাকি। উঁচু এক টিলা থেকে আরেক টিলায় যেতে বেশ ধকল যায়। তবু ভালোই লাগে। চোখে পড়ে বেশ কিছু ঘরের চালে সোলার প্যানেল, সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। দু-একটি ঘর থেকে টেলিভিশনের কথা ভেসে আসে। আমাদের দেখানো হলো সীমান্তের ওপার। এক ডাকের দূরত্বে ওপার বাংলা। একই ভাষার, একই সংস্কৃতির মানুষ। একে অপরের মুখ দেখার মতো দূরত্ব। তবু কেউ কারও প্রতিবেশী নয়। কাঁটাতারের বেড়া ভাগ করে রেখেছে সবাইকে।
হঠাৎ দু-একটা পাখি ডেকে ওঠে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য পংকজ কন্দ বললেন, ‘আগে খাসিয়াপুঞ্জি এলাকায় অনেক পাখি ছিল। এখন আর সেই সব পাখি দেখা যায় না। বড় গাছ না থাকায় পাখি বাসা করতে পারে না। পাখি পোকা খেত। এখন পাখি না থাকায় পোকা পানগাছকে আক্রমণ করছে। পান পাতা খেয়ে ফেলছে।’ আদিবাসীরা জানান, বছর কয়েক আগেও ধনেশ, ময়না, বুলবুলি, টিয়ে, ঘুঘু, হরিকল, বনমোরগ ইত্যাদি প্রকাশ্যেই দেখা যেত। এখন এসব চোখে পড়ে না। নাহারপুঞ্জিতেই দেখা বৃহত্তর সিলেট খাসি ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি এন্ড্রু সলোমার বলেন, ‘আমরা চাই খাসিয়ারা যেভাবে ছিল, সে রকম শান্তিতে ও নিরাপদে থাকুক। তাদের জায়গাজমি, জুমপান থেকে যেন তারা উচ্ছেদ না হয়। কোনো কিছু করা হলে আদিবাসীদের সঙ্গে যেন আলোচনা সাপেক্ষে হয়। আমরা আদিবাসীরা পরিবেশ নষ্ট করি না। বন ধংস করি না। নিজের জীবিকার স্বার্থে গাছ টিকিয়ে রাখি।’
ফেরার পথে বারবার সেই সরল চাঁদের হাসিমুখটিই মনে পড়ছিল। এত সারল্যধরা মুখ সহসা চোখে পড়ে না। জীবন কত জটিল, সংকীর্ণ, স্বার্থপরতায় রুগ্ণ। কেন এ রকম হাসি সবার মুখে নেই! কিন্তু ভয়, এই হাসিটি অক্ষুণ্ন থাকবে তো! প্রত্যাশা করি, বনে বনে অনন্তকাল যেন এই হাসি অম্লান থাকে। ছড়িয়ে যায় সবখানে।
আকমল হোসেন: প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি।
No comments