উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদী মরছে by আখলাক হুসেইন খান
একে একে মরছে নদী। হারিয়ে যাচ্ছে নদী সভ্যতা। জলবায়ু পরিবর্তন আর প্রকৃতির বিরূপ আচরণে হাওর ও নদ-নদীর এ মরণদশা। একে রক্ষা করা আধুনিক প্রযুক্তিও অকার্যকর। জোরজবরদস্তি চালালেও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীকে ব্যবস্থাপনায় রাখলেই কেবল রক্ষা।
কিন্তু এই ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমটি বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। যার ফলে চোখের সামনেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী ও এর সঙ্গে গড়ে ওঠা কৃষি সভ্যতা। নদীর এই ক্রান্তিলগ্নে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সুরমা-কুশিয়ারা ও এর শাখা-প্রশাখা নদ-নদী বর্তমান বিপন্ন অবস্থা একটু পর্যালোচনা করলেই (ড্যাম নির্মাণোত্তর) ভবিষ্যতের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নাগা-মণিপুর সীমান্তের জাভো পাহাড়ের ঝরনাধারার দক্ষিণ ঢালে জলবিভাজিকর থেকে উৎপন্ন বরাক নদ মণিপুর, মিজোরাম ও আসামের ভাটিতে বয়ে টিপাই (গিরিখাদ) হয়ে ১০০ কিলোমিটার ভাটিতে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত গ্রাম অমলশীদের কাছে দুই ভাগে ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে হাওরের বুক চিরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে। ২৮৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সুরমার পশ্চিমে বয়ে সিলেট নগরীর মধ্য দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর পাশ ঘেঁষে আবার দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি হয়ে ভাটিতে কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিটামইন উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে বয়ে ভৈরবের উজানে দিলালপুরের কাছে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। সিলেটে প্রবাহিত অভিন্ন নদী ধলা, পিয়াইন, সারি-গোয়াইন, ডাউকি ও সোনাই-বরদল, সুনামগঞ্জের অভিন্ন নদী যাদুকাটা, ধামালিয়া, জালুখালি, নওয়াগাং, উমিয়াম এবং নেত্রকোনার অভিন্ন নদী সোমেশ্বরী (কংস, মগড়া, ধেনু, গুনাই নদী হয়ে) সুরমা নদীতে পানি দেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সুরমায় প্রতিবছর পানি আসে ১৫ হাজার মিলিয়ন কিউসেক। এ নদীর মূল প্রবাহে বিয়ানীবাজার, ছাতক, দোয়ারাবাজারসহ কয়েকটি স্থানে চর গজিয়ে ওঠাসহ গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখার অংশ এখন প্রায় মৃত ও মুমূর্ষু। সুনামগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ভাটিতে পৈন্দা ও নীলপুরের কাছে সুরমার একটি ভাগ অপেক্ষাকৃত পূর্ব-দক্ষিণে জামালগঞ্জ ও দিরাই উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হবিগঞ্জের মার্কুলী (কাদিরগঞ্জ) বাজারের কাছে উত্তর পাড়ে কুশিয়ারা-কালনী নদীর সঙ্গে মিশেছিল। উজানে পুরান সুরমা ও ভাটিতে উজান কালনী নামে পরিচিত প্রায় ৮০-৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদীটির মার্কুলী সংলগ্ন মিলন মোহনায় (টুকেরগাঁয়ের কাছে) ১৯৭৮ সালে ক্রসবাঁধ (Enbankment) দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্যার কবল থেকে দিরাইয়ের ভাটিধল ও কুলঞ্জ হাওরের বোরো ফসল রক্ষার জন্য। পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় পলি-বালি জমে বাঁধের উজানে নদীর চার-পাঁচ কিলোমিটার মরে গেছে। এ ছাড়া পুরান সুরমার অপর একটি অংশ দিরাইয়ের ভাটি থেকে দক্ষিণে শাল্লা উপজেলার অভ্যন্তরে বয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার উত্তর পাশ ঘেঁষে পূর্বদিকে বয়ে আজমিরীগঞ্জ নদীবন্দর বাজারের কাছে কুশিয়ারা-কালনী নদীর উত্তর পাড়ে মিলিত হয়েছিল। শাল্লা ও শ্রীহাইল হাওরের বোরো ফসল রক্ষার জন্য প্রায় ২৫ বছর আগে মিলন মোহনায় ক্রসবাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেয় কুশিয়ারা-কালনী নদীর পানি উল্টো প্রবেশ করত বলে। ফলে বাঁধের উজানে পলি-বালি জমে গোদী, ভেড়ামোহনা, দাড়াইন, ধেনু নদী প্রায় মৃত ও একেবারেই মুমূর্ষু। বর্তমানে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় সুরমা শাখা-প্রশাখার প্রায় ৩০টি নদী শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়। শুধু নদীগুলোর খাঁড়ি বা ডহরগুলোতে যৎসামান্য পানির দেখা মেলে, যা সেচের একমাত্র শেষ ভরসা।
সুরমা ও কুশিয়ারার উৎপত্তি মুখে ভারতের করিমগঞ্জের বরাক মোহনায় পলি-বালিতে প্রায় এক কিলোমিটার স্থানজুড়ে চর গজিয়ে ওঠায় শুষ্ক মৌসুমে বরাক নদের পানি সুরমায় ২০ শতাংশ ও কুশিয়ারায় ৮০ শতাংশ প্রবাহিত হয়। কুশিয়ারা নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ৫০ বছর আগে মার্কুলীর উজানে বিবিয়ানা নদী সুরিয়া খালে গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে দুই পাড় থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি টন মাটি ভেঙে পড়ে। আর এ মাটির বেশির ভাগ আজমিরীগঞ্জ থেকে মাদনা পর্যন্ত কালনী নদীর তলদেশে জমা হয় এবং আজমিরীগঞ্জ বন্দর বাজারের উত্তর ও পূর্ব পাশে বিশাল চর গজিয়ে ওঠে নদী প্রায় ১৫ শ গজ পশ্চিমে সরে শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকার ও সিডার জরিপে কুশিয়ারা-কালনী নদী ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে কলমা পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার মুমূর্ষু উল্লেখ করে একটি সংস্কার প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল। এ জরিপে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ পলি-বালিতে ভরাট হয়ে ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু হয়ে গেছে বলে বলা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সুরমা ও কুশিয়ারায় বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টন পলি-বালি প্রবাহিত হয়। অবকাঠামোর ফলে উপনদীগুলোতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুরমা ও কুশিয়ারার স্বাভাবিক গতি (পানি প্রবাহ) হারিয়ে ফেলায় প্রায় ২০-২৫টি শাখা নদীর মিলন মুখ পলি-বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে সুরমা-কুশিয়ারার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থা উপনদীগুলোর শাখা-প্রশাখার নদীরও। এ প্রবণতায় উপনদীগুলোসহ ৬০টি নদী দ্রুত মরার পথে এগোচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত বা ভারী ঢলে পাহাড়ের ভূমিধসের ফলে নদীতে পলি-বালি প্রবাহের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী ভরাটের পথকে ত্বরান্বিত করছে।
লেখক : হাওর গবেষক
নাগা-মণিপুর সীমান্তের জাভো পাহাড়ের ঝরনাধারার দক্ষিণ ঢালে জলবিভাজিকর থেকে উৎপন্ন বরাক নদ মণিপুর, মিজোরাম ও আসামের ভাটিতে বয়ে টিপাই (গিরিখাদ) হয়ে ১০০ কিলোমিটার ভাটিতে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত গ্রাম অমলশীদের কাছে দুই ভাগে ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে হাওরের বুক চিরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে। ২৮৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সুরমার পশ্চিমে বয়ে সিলেট নগরীর মধ্য দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর পাশ ঘেঁষে আবার দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি হয়ে ভাটিতে কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিটামইন উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে বয়ে ভৈরবের উজানে দিলালপুরের কাছে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। সিলেটে প্রবাহিত অভিন্ন নদী ধলা, পিয়াইন, সারি-গোয়াইন, ডাউকি ও সোনাই-বরদল, সুনামগঞ্জের অভিন্ন নদী যাদুকাটা, ধামালিয়া, জালুখালি, নওয়াগাং, উমিয়াম এবং নেত্রকোনার অভিন্ন নদী সোমেশ্বরী (কংস, মগড়া, ধেনু, গুনাই নদী হয়ে) সুরমা নদীতে পানি দেয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সুরমায় প্রতিবছর পানি আসে ১৫ হাজার মিলিয়ন কিউসেক। এ নদীর মূল প্রবাহে বিয়ানীবাজার, ছাতক, দোয়ারাবাজারসহ কয়েকটি স্থানে চর গজিয়ে ওঠাসহ গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখার অংশ এখন প্রায় মৃত ও মুমূর্ষু। সুনামগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ভাটিতে পৈন্দা ও নীলপুরের কাছে সুরমার একটি ভাগ অপেক্ষাকৃত পূর্ব-দক্ষিণে জামালগঞ্জ ও দিরাই উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হবিগঞ্জের মার্কুলী (কাদিরগঞ্জ) বাজারের কাছে উত্তর পাড়ে কুশিয়ারা-কালনী নদীর সঙ্গে মিশেছিল। উজানে পুরান সুরমা ও ভাটিতে উজান কালনী নামে পরিচিত প্রায় ৮০-৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদীটির মার্কুলী সংলগ্ন মিলন মোহনায় (টুকেরগাঁয়ের কাছে) ১৯৭৮ সালে ক্রসবাঁধ (Enbankment) দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্যার কবল থেকে দিরাইয়ের ভাটিধল ও কুলঞ্জ হাওরের বোরো ফসল রক্ষার জন্য। পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় পলি-বালি জমে বাঁধের উজানে নদীর চার-পাঁচ কিলোমিটার মরে গেছে। এ ছাড়া পুরান সুরমার অপর একটি অংশ দিরাইয়ের ভাটি থেকে দক্ষিণে শাল্লা উপজেলার অভ্যন্তরে বয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার উত্তর পাশ ঘেঁষে পূর্বদিকে বয়ে আজমিরীগঞ্জ নদীবন্দর বাজারের কাছে কুশিয়ারা-কালনী নদীর উত্তর পাড়ে মিলিত হয়েছিল। শাল্লা ও শ্রীহাইল হাওরের বোরো ফসল রক্ষার জন্য প্রায় ২৫ বছর আগে মিলন মোহনায় ক্রসবাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেয় কুশিয়ারা-কালনী নদীর পানি উল্টো প্রবেশ করত বলে। ফলে বাঁধের উজানে পলি-বালি জমে গোদী, ভেড়ামোহনা, দাড়াইন, ধেনু নদী প্রায় মৃত ও একেবারেই মুমূর্ষু। বর্তমানে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় সুরমা শাখা-প্রশাখার প্রায় ৩০টি নদী শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়। শুধু নদীগুলোর খাঁড়ি বা ডহরগুলোতে যৎসামান্য পানির দেখা মেলে, যা সেচের একমাত্র শেষ ভরসা।
সুরমা ও কুশিয়ারার উৎপত্তি মুখে ভারতের করিমগঞ্জের বরাক মোহনায় পলি-বালিতে প্রায় এক কিলোমিটার স্থানজুড়ে চর গজিয়ে ওঠায় শুষ্ক মৌসুমে বরাক নদের পানি সুরমায় ২০ শতাংশ ও কুশিয়ারায় ৮০ শতাংশ প্রবাহিত হয়। কুশিয়ারা নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ৫০ বছর আগে মার্কুলীর উজানে বিবিয়ানা নদী সুরিয়া খালে গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে দুই পাড় থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি টন মাটি ভেঙে পড়ে। আর এ মাটির বেশির ভাগ আজমিরীগঞ্জ থেকে মাদনা পর্যন্ত কালনী নদীর তলদেশে জমা হয় এবং আজমিরীগঞ্জ বন্দর বাজারের উত্তর ও পূর্ব পাশে বিশাল চর গজিয়ে ওঠে নদী প্রায় ১৫ শ গজ পশ্চিমে সরে শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকার ও সিডার জরিপে কুশিয়ারা-কালনী নদী ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে কলমা পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার মুমূর্ষু উল্লেখ করে একটি সংস্কার প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল। এ জরিপে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ পলি-বালিতে ভরাট হয়ে ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু হয়ে গেছে বলে বলা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সুরমা ও কুশিয়ারায় বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টন পলি-বালি প্রবাহিত হয়। অবকাঠামোর ফলে উপনদীগুলোতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুরমা ও কুশিয়ারার স্বাভাবিক গতি (পানি প্রবাহ) হারিয়ে ফেলায় প্রায় ২০-২৫টি শাখা নদীর মিলন মুখ পলি-বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে সুরমা-কুশিয়ারার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থা উপনদীগুলোর শাখা-প্রশাখার নদীরও। এ প্রবণতায় উপনদীগুলোসহ ৬০টি নদী দ্রুত মরার পথে এগোচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত বা ভারী ঢলে পাহাড়ের ভূমিধসের ফলে নদীতে পলি-বালি প্রবাহের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী ভরাটের পথকে ত্বরান্বিত করছে।
লেখক : হাওর গবেষক
No comments