বিশ্বকাপ ক্রিকেট-আবার কি দৈত্য হতে হবে? by আফজাল হোসেন

মনে হতাশা, নিকট পরাজয়ের বেদনা। আবার একই মনে জোরালো আশা—জয় হবে, জিতে যাবে বাংলাদেশ। এ এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি। এ দোটানা চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত কোটি আশারই জয় হলো। আবেগের ঠেলায় পড়ে এ জয়কে প্রতিশোধ ভেবে আনন্দের মাত্রাকে বাড়িয়ে নেওয়া যায়।


হেরে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা যখন সামনে দাঁড়িয়ে—আবেগই ভরসা জোগায়, জয় হবে। হিসাবে, যুক্তিতে মেলে না, তবু আশা টিকে থেকেছে। আশাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে একের পর এক। তার পরও মানুষের মনে হয়, মনে হতেই থাকে, জিতবে বাংলাদেশ।
আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বীরের মতো লড়ে জয় হলো আমাদের। ভাঙা কোমরে মনের শক্তি জুড়ে তিলে তিলে জয়কে অর্জন করা হয়েছে। দুর্মুখেরাও এ জয়কে ‘সৌভাগ্যবশত’ বলে মন্তব্য করতে পারবে না। ক্রিকেটের জয়-পরাজয়কে অপরিকল্পিত, চক্রান্ত—এসব ঢালাও মন্তব্য করে পারের উপায় নেই। মনগড়া মন্তব্য এখানে হালে পানি পায় না। স্পষ্ট খেলায় জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় ক্রিকেটে। স্পষ্ট করেই বলতে হবে, খেলে, লড়াই করে জিতেছে বাংলাদেশ।
লড়াই, সংগ্রাম এ জাতির জন্য নতুন নয়। ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—সবই বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফসল। মানুষের এই তিন গৌরবোজ্জ্বল অর্জন বিশ্বে বিরল। এই তিন সংগ্রামে বাঙালি ছিল এক ও অভিন্ন।
এখনো আগুন আছে মানুষের মনে। সে আগুনের আলোয় নিজেদের ভালো করে দেখা হয়। আনন্দ জাগে, মনে প্রশ্নও জাগে, তাহলে ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’ এমন মনে হয় কেন?
ক্রিকেট আমাদের অনেক কিছু ভুলিয়ে রেখেছে। অনেক কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমাদের আগের ক্ষতগুলোয় কোনো ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণার অনুভব নেই এখন। কারও মনে এখন কোনো হতাশার অস্তিত্ব নেই। ক্ষোভ, অভিমান বা ক্রোধের ছিটেফোঁটা নেই। আমরা বিভেদ ভুলেছি, আমিত্ব ভুলেছি। পেছনের মতো আবার একত্র হতে পেরেছি, হতে পেরেছি আমি থেকে আমরা।
যারা ঘরে বসে টেলিভিশনে খেলাটা দেখেছে, স্মরণ করা যাক, প্রথম দিকের অনুভূতি কেমন ছিল। অনেক আশা নিয়ে বসা। তারপর ক্রমে ক্রমে সবাই টের পেতে থাকি যে আশার গুড়ে বালি পড়ে যাচ্ছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে সবার স্বপ্ন। হতাশায় শূন্য হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে চলছিল একের পর এক। তবু কেউ আশা ছাড়েনি। যারা রেডিওতে শুনেছে, তাদের অনুভূতিও একই রকমের ছিল। রেডিও বা টেলিভিশন শোনেনি-দেখেনি, কিন্তু নানাভাবে এর-ওর কাছ থেকে খবর নিয়ে বা ফোনে কী হলো, কী হবে খবর নিচ্ছিল যারা, সবার মনে মুহূর্তে মুহূর্তে অন্ধকার নেমেছে, কিন্তু তার পরও টিম টিম করে জ্বলে থেকেছে আশা, জিতবেই বাংলাদেশ।
গ্যালারিতে বসে থাকা মানুষের হাজারবার অনুভব হয়েছে, হেরে যাব, হেরে যাচ্ছি। আবার লাখোবার মনে হয়েছে, হারব না আমরা। মাঠের প্রত্যেক খেলোয়াড় জানেন, জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছেন তাঁরা। বুঝেছেন, খেলাটা শুধু তাঁদের কয়েকজনের নয়, তাঁদের সঙ্গে দর্শকেরাও বলে বলে লড়ে চলেছে, খেলে চলেছে।
এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। খেলাটাই যে দেখার মতো বিষয়, তা নয়। গ্যালারিভর্তি মানুষও ছিল দর্শনীয়। প্রত্যেক মানুষের মনে জয়ের সংকল্প। আশাহত হওয়ার মতো ঘটনা যতই ঘটুক, শক্তি হারায়নি কেউ। একাত্মা হয়ে, পরস্পরের হাত ধরে মনের জোর অটুট রেখেছে। খেলোয়াড়দের মুহূর্তে মুহূর্তে জানান দিয়েছে, রয়েছি তোমাদের সঙ্গে। বুঝিয়ে দিয়েছে, খেলাটা শুধু তোমাদের নয়, আমাদেরও। মিলিত উচ্ছ্বাস বলেছে, আমরা পারব, নিশ্চয় পারব।
মানুষ এমন এক সুরে বাঁধা, একসঙ্গে এত মানুষ এমন গৌরবের আচরণ করতে পারে, ভুলে গিয়েছিলাম।
এ ওকে প্রতিনিয়ত একহাত দেখিয়ে দেওয়ার স্বভাবে মেতে থেকে থেকে শূন্য হয়ে যাওয়ার কথা আমাদের ভেতরে সভ্যতা সৌন্দর্যের পরিমাণ সামান্য অবশিষ্ট রয়েছে বলে ভাবা কঠিন।
আমরা জ্বালাই-পোড়াই, ভেঙে তছনছ করতে জানি, মানুষ হয়ে মানুষকে পিটিয়ে মারি—আমাদের পক্ষে বুকের সব শক্তি উজাড় করে একসঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ বলে এ রকম চেঁচিয়ে ওঠা বিস্ময়কর। নিরন্তর হতাশার মধ্যে এটা আলো হয়ে ফুটে ওঠার মতো ঘটনা। এ রকম একসঙ্গে হওয়ার ইতিহাস অসংখ্য রয়েছে, মনে করিয়ে দেয়। সময়ের প্ররোচনায় আমরা বদলে গিয়েছিলাম; আবার আমরা আমাদের ফিরে পেয়েছি বলে আনন্দে সাত আসমানের ওপর উঠে যাওয়ার কথা।
সবাই সেদিনের খেলাটা আবার দেখি। খেলা হচ্ছে, পায়ে পায়ে পরাজয়কে দেখা গেছে বেশ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এ রকম সময় চাওয়া অনুযায়ী পাওয়া হয় না বলে মানুষ কেটে পড়ে। এমনটি কেউ করেনি সেদিন। খেলোয়াড়দের শেষ পর্যন্ত খেলতে হয়, জয়-পরাজয়ের জন্য শেষ পর্যন্তই খেলোয়াড়দের সঙ্গে থেকেছে মানুষ।
মুহূর্ত খানেক ধৈর্যহারা হয়নি কেউ, আনন্দ-উল্লাসে কার্পণ্য ছিল না কারও। দুঃখিত হয়েছে, কিন্তু দুঃখে ভেঙে পড়েনি মানুষ। ক্ষোভ হয়েছে, কিন্তু অসাবধানেও কেউ অসুন্দর হয়নি। রাগ হলে সে রাগ দমন করেছে। মনে হয়েছে, সবারই যেন প্রতি মুহূর্তে মনে রয়েছে, এটা বিশ্বকাপ ক্রিকেট। সবাই মনে রেখেছে, বিশ্বব্যাপী মানুষের চোখ খেলায়, মানুষে, বাংলাদেশের ওপর। শুধু খেলার জয়ে গৌরব নয়, দেশ ও দেশের মানুষও জয়ের গৌরবের মতো।
অপ্রত্যাশিত জয় আর প্রত্যাশার জয়ের মধ্যে পার্থক্য বিপুল, সেটাও জানা হলো। স্পষ্ট অনুভব করতে পারল সবাই। একটু একটু করে জিততে হলে ধৈর্য ও শৌর্যের প্রয়োজন হয়। হারতে হারতে জয়লাভের জন্য প্রচণ্ড মানসিক শক্তি দরকার। কোনোটার অভাব ছিল না আমাদের ক্রিকেটার ও গ্যালারির দর্শকদের।
সারা বছর ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে হতাশার যে হাত-ধরাধরি চরকি-নৃত্য, তার ভেতরে থেকে বুকে সাহস, মনে শক্তি ধরে রাখা সাধারণ মানুষের জন্য সত্যি কঠিন। মাঠে চলেছে রুদ্ধশ্বাস ক্রিকেট। গ্যালারি ছিল অসাধারণত্বে ভরপুর। যেদিকে তাকানো যায়, উজ্জ্বল মানুষের উচ্ছ্বাস, উল্লাস। ছোট থেকে মাঝারি, বড়—সব বয়সের মানুষ আনন্দ, অধীরতা, উত্তেজনা মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কে পরিচিত, আর কাদের সঙ্গে গ্যালারিতে জনমে প্রথম দেখা, সেই হিসাব হূদয়াবেগে উড়ে গিয়েছিল। টিকিটে সিট নম্বর উল্লেখ ছিল, তবু কার সিটে কে বসেছে, তা নিয়ে সময় নষ্ট করেনি কেউ। কে কার পানি খাচ্ছে, কার খাওয়া কাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছে, হিসাব কষেনি। একজন আকৃতিতে ছোট পতাকা এনেছে, নৃত্য-স্লোগানে পাশের জনেরা বড় পতাকার অংশীদার করেছে, সাথি বানিয়েছে তাকেও। কোনো দর্শক দলের কাছে দুটো বাঁশি বেশি, তা-ও অবলীলায় ভাগাভাগি হয়ে গেছে। কাদের ক্যামেরায় কারা ছবি তুলছে, হিসাব নেই। একসঙ্গে জড়াজড়ি করে ছবি তুলে টেলিফোন নম্বর বিনিময় হয়েছে। যেন সবাই সবার নিকটাত্মীয়।
যখন হতাশা ঘাড়ে চেপে বসতে চেয়েছে, তখন তা ঝেড়ে ফেলে দিতে একত্রে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকারে মেতে উঠেছে সবাই। খেলা শেষে মহা আনন্দে-উল্লাসে একাকার হয়ে গেছে স্টেডিয়ামের ভেতর-বাইরের মানুষ। তিন-চার ঘণ্টা ধরে আনন্দ মিছিল নৃত্য-গীতে মেতে থেকেছে মানুষ। এমন হুলুস্থুলে নানা অঘটন ঘটে যায়, কিন্তু সেদিনের জয় শুধু ক্রিকেটের নয়, সাধারণ মানুষেরও ছিল বলে আনন্দের রেশেই শেষ হয়েছে সব। সব ভালো যার, শেষ ভালোতেই কেটে গেছে দিনের শেষটা।
নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়, সব ধরনের মানুষ পথে নেমে যেমন আনন্দ-খুশিতে মেতেছে, অথচ শেষমেশ কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেনি। এত রকমের মানুষ, এত রকমের আনন্দ, এত ভিন্ন উচ্ছ্বাস-উল্লাস, হঠাৎ অধিক আনন্দে পাগলামি, তবু মানুষ মানুষকে দেখে ভীত হয়নি, সন্ত্রস্ত দেখায়নি কাউকে।
দেখা গেছে, ফুটপাতে অনেক ভিড়, দ্রুত বের হওয়ার জন্য মানুষ সপরিবারে নির্ভয়ে আনন্দমিছিলে ঢুকে পড়েছে। আস্থা, ভরসা, আপন অনুভবের এমন পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা কেউ বয়ান করতে পারবে কি?
সাধারণ মানুষ মিছিল-সমাবেশকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। দূরে সরে থাকে। কোনো অভয়ে সবাই বদলে গিয়েছিল সেদিন। মানুষেরা মানুষ ছিল, সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। নেতৃত্ব ছিল না, কিন্তু সবার যেন দায়িত্ব ছিল নির্দোষ থাকা, সবাই সবার ওপর খুবই ভরসা করেছিল।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-তে যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। নানা দুুর্বিপাকে, হা-হুতাশে ভোগা একটা জাতি হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ক্রিকেট আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাসে, ভরসায়, নতুন প্রেরণায় জেগে উঠেছে মানুষ। শত রকম মানুষ এক হয়েছে। কষ্ট ভুলে, দীর্ঘশ্বাস ভুলে একত্রে স্বপ্ন দেখছে। একত্রে মনের জোরে সেই স্বপ্নকে জয়ও করেছে। মানুষ মনে করেছে, অসম্ভব বলে কিছু নেই। এই বিশ্বাস কি অটুট থাকবে?
ক্রিকেট শেষ হয়ে যাবে, আবার কি আমরা সেই মুখস্থ জীবনে ফিরে যাব? সেই প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠা, সেই একের বিরুদ্ধে অন্যে ভয়ংকর ভূমিকায় লিপ্ত হওয়া। জ্বালাতে-পোড়াতে-ভাঙতে দেশ ও মানুষকে তছনছ করতে লেগে যাওয়া হবে আবার? আবার কি মানুষকে হত্যা করে মানুষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে?
এই যে হাজার-লাখো-কোটি মানুষ একত্রে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ চিৎকারে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করছে, এই ভালোবাসা কেউ কি ধরে রাখার চেষ্টা করবে না? আবার সবাইকে বিচ্ছিন্ন করা হবে? আবার মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করানো হবে? ‘বাংলাদেশ’ স্লোগান ফেলে অন্য কোনো স্লোগানে মুখর হবে এই মানুষগুলো?
কেউ কি কোথাও নেই, সোনার মানুষের মধ্যে সোনালি এই আলো দেখতে পেয়েছেন? এই মানুষগুলোকে এমনভাবে একত্র করতে পারলে হা-হুতাশের অবসান হয়। সোনার মানুষেরা মিলে স্বপ্নের সোনার দেশ গড়ে তুলতে পারে সহজেই।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট অতিথি হয়ে এসেছে, চলে যাবে। মানুষের যেসব ভালো একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে, তা কেনা নয়, আমদানি করা নয়, অতিথিও নয়। আমাদের ছিল, আমাদেরই আছে, থেকে যাবে। কুড়িয়ে জড়ো করার মানুষ কি আছেন?
আমাদের এই শক্তি, অনুভূতিগুলোকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায়? বিশ্বকাপ ক্রিকেট গেলে আমাদের কি সত্যি আবার প্রদীপে প্রদীপে ঢুকে পড়তে হবে? ঘষা খেয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে পৃথক পৃথক বের হয়ে আবার কি বলতে হবে, ‘হুকুম করো মালিক।’ মানুষের স্বভাব বদলে আবার কি দৈত্য হতে হবে আমাদের?
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক।
afzalhossain1515@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.