চারদিক-চখা-চখির খোঁজে by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
চর ফেলে সদ্য সরে গেছে পানি। আদিগন্ত বিস্তৃত সাদা বালু। ভেজা। তুষারের মতো চুপচাপ পড়ে আছে। নির্মল বাতাস। প্রাণভরে শ্বাস নিতে ভালো লাগছে। আমরা হাঁটছি। খালি পা। এই এলাকার বালুতে বোধ হয় এই প্রথম পায়ের ছাপ পড়ছে।
গহমাবোনা গ্রাম থেকে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে পদ্মা নদীর চরের মধ্যে চলে এসেছি। এই গ্রামের যুবক সোহেল রানার কথা, আর একটু গেলেই একসঙ্গে ৩০টা চখা দেখতে পাবেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের গহমাবোনা গ্রামের গা ঘেঁষে কবে পদ্মা এসে মিশেছিল গ্রামের ৪০ বছর বয়সী কৃষক শফিকুল ইসলামও জানেন না। এবার সেই নদী দক্ষিণে প্রায় দুই কিলোমিটার সরে গেছে। গত বছরেও গাঁয়ের ধারে যে পাখির ঝাঁক বসত, এবার তারা নদীর সঙ্গেই চলে গেছে দূরে। সেই পাখিদের দেখতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আমরা এক অভিযানে বের হই।
মাটিতে পা দেবে যাওয়ায় হাঁটতে গিয়ে আর ধাপ উঠতে চাইছে না। হাতে-পায়ে ক্লান্তি চেপে ধরছে। একসঙ্গে ১০-১২ জন লোক দেখলে পাখি উড়ে যাবে, তাই দলের বাচ্চা ছেলেদের আর সঙ্গে নেওয়া হলো না। শফিকুল ইসলাম বাচ্চাদের নিয়ে থেকে গেলেন। আমাদের সঙ্গে শুধু থাকলেন সোহেল, বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার রবিউল ইসলাম ও রাজশাহী ফটোগ্রাফি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক তানভীর উল ইসলাম। হঠাৎ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে রবিউল ইসলাম বললেন, ‘আমরা পাখির কাছাকাছি এসে গেছি।’ শুনেই ক্যামেরায় লেন্স লাগিয়ে প্রস্তুত হলেন তানভীর। কিন্তু পাখি নয়, পাখির ডিম পেয়েছেন তিনি। হটটিটি পাখির চারটি ডিম। পাখির বাসায় যেভাবে ডিম থাকে, তেমনি করে ডিমগুলো মাটিতে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, ডিমে বসে তা দিয়েছে পাখি।
কোথাও জনমানুষের সাড়াশব্দ নেই। একেবারে সুনসান নীরবতা। আমরা হাঁটছি আরও দক্ষিণে। আস্তেই নীরবতা ভেঙে কানে আসতে লাগল পাখির কিচিরমিচির। হঠাৎ বেশ ভরাট গলায় হাতের কাছেই কোথাও যেন পাখির চকিত গলা শোনা গেল। দেখা গেল হাতের বাঁয়ে একটা খাঁড়ি। এর অল্প পানিতে বসে আছে দুটি চখা। হাতের জুতা ফেলে চখার পিছু নিলেন তানভীর। আমরা তাঁর কয়েক ধাপ পেছনে। যতটা সম্ভব কাছ থেকে চখাকে দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এত দূরে আসা। কিন্তু বেশি দূর ঘেঁষতে দিল না ওরা। শুনেছিলাম, ইউরোপের দেশগুলোয় এরা মানুষের খুব কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু এ দেশে এলেই ওরা হিসাব রাখে, জায়গাটা ওদের জন্য নিরাপদ নয়। সেই জন্য ১০০ মিটারের বেশি কাছে ওরা মানুষকে ভিড়তে দেয় না। চখা-চখির ইংরেজি নাম Ruddy shelduc। এর সারা গা প্রায় কমলা রঙের। পুরুষটার গলায় একটা কালো রেখা আছে। কিন্তু ওড়ার সময় পাখায় কালো, সাদা, কমলা ও নীলচে রং বেরিয়ে আসে। বেশ বড়সড় এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় এরা সহজেই শিকারিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
আর একটু যেতেই পদ্মার মূল ধারা। দূর থেকেই চোখে পড়ল একঝাঁক পাখি। ওখান থেকে তানভীর তাঁর ক্যামেরায় পাখির ঝাঁকের মালার মতো সারি হয়ে বসে থাকার দৃশ্য ধারণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন। আমরা বেশ পেছনে। অবাক করা বিষয়, পাখিগুলো বেশ আয়েশ করে বসে আছে। ওড়ার নামটি নেই। কিন্তু কাছে গিয়ে হতাশ হয়ে তানভীর বললেন, সব পানকৌড়ির ঝাঁক। এগুলো পুকুর-বিলেই পাওয়া যায়।
খাঁড়িটা পার হয়ে পূর্ব পাশে উঁচু বালুর পাড়ের ওপারে গিয়ে কয়েকটি চখার দেখা মিলল। সব মিলিয়ে গোটা ছয়েক হবে। কিন্তু কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আরও পূর্ব দিকে চখার দল দেখা যাচ্ছে কিন্তু গিয়ে তো লাভ নেই। ওরা আরও দূরে চলে যাবে। তা ছাড়া সূর্যটা রশ্মি গুটিয়ে ইতিমধ্যে তার গোল থালার ভেতরে ভরে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছে।
সোহেল বললেন, এই এলাকা পশুপাখিদের জন্য নিরাপদ। এ জন্য এখানে অনেক পাখি থাকে। এখানে কোনো শিকারি আসে না। কেন আসে না—জানতে চাইলে সোহেল হাসতে হাসতে বললেন, এটা তো ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছাকাছি এলাকা। ভারতের লোকদের শিকারের ব্যাপারে কড়াকড়ি। তা ছাড়া নদীটা পার হয়ে ভারতের লোকদের এ পারে আসতে হলে পরিচয়পত্র বিএসএফের কাছে জমা দিয়ে সময় বেঁধে দিয়ে আসতে হয়। কেউ শিকার করতে আসতে পারে না। আবার বাংলাদেশের লোকও বন্দুক নিয়ে সীমান্তের এত কাছে আসতে পারে না। দেখা গেল, অদূরেই বিএসএফের গোলঘর। আমাদের একজন বললেন, ‘ওরা গুলি করে দেবে না তো।’ সোহেল অভয় দিলেন, ‘গুলি করে না, তবে এখন আর এখানে না থাকাই ভালো।’ এ কথা শুনেই আমরা ফেরার জন্য পা তুললাম। সোহেল বলেন, ‘আরে ভয় পান কেন? ওই দেখেন বাংলাদেশি ডিঙিগুলো ভারতের কত ভেতরে বাঁধা।’ নৌকার দিকে না তাকিয়ে আমরা পেছেন ফিরে খুঁজতে লাগলাম কত দূরে গহমাবোনা গ্রাম। তখন গ্রামের উঁচু গাছগুলোর মাথা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।
মাটিতে পা দেবে যাওয়ায় হাঁটতে গিয়ে আর ধাপ উঠতে চাইছে না। হাতে-পায়ে ক্লান্তি চেপে ধরছে। একসঙ্গে ১০-১২ জন লোক দেখলে পাখি উড়ে যাবে, তাই দলের বাচ্চা ছেলেদের আর সঙ্গে নেওয়া হলো না। শফিকুল ইসলাম বাচ্চাদের নিয়ে থেকে গেলেন। আমাদের সঙ্গে শুধু থাকলেন সোহেল, বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার রবিউল ইসলাম ও রাজশাহী ফটোগ্রাফি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক তানভীর উল ইসলাম। হঠাৎ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে রবিউল ইসলাম বললেন, ‘আমরা পাখির কাছাকাছি এসে গেছি।’ শুনেই ক্যামেরায় লেন্স লাগিয়ে প্রস্তুত হলেন তানভীর। কিন্তু পাখি নয়, পাখির ডিম পেয়েছেন তিনি। হটটিটি পাখির চারটি ডিম। পাখির বাসায় যেভাবে ডিম থাকে, তেমনি করে ডিমগুলো মাটিতে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, ডিমে বসে তা দিয়েছে পাখি।
কোথাও জনমানুষের সাড়াশব্দ নেই। একেবারে সুনসান নীরবতা। আমরা হাঁটছি আরও দক্ষিণে। আস্তেই নীরবতা ভেঙে কানে আসতে লাগল পাখির কিচিরমিচির। হঠাৎ বেশ ভরাট গলায় হাতের কাছেই কোথাও যেন পাখির চকিত গলা শোনা গেল। দেখা গেল হাতের বাঁয়ে একটা খাঁড়ি। এর অল্প পানিতে বসে আছে দুটি চখা। হাতের জুতা ফেলে চখার পিছু নিলেন তানভীর। আমরা তাঁর কয়েক ধাপ পেছনে। যতটা সম্ভব কাছ থেকে চখাকে দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এত দূরে আসা। কিন্তু বেশি দূর ঘেঁষতে দিল না ওরা। শুনেছিলাম, ইউরোপের দেশগুলোয় এরা মানুষের খুব কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু এ দেশে এলেই ওরা হিসাব রাখে, জায়গাটা ওদের জন্য নিরাপদ নয়। সেই জন্য ১০০ মিটারের বেশি কাছে ওরা মানুষকে ভিড়তে দেয় না। চখা-চখির ইংরেজি নাম Ruddy shelduc। এর সারা গা প্রায় কমলা রঙের। পুরুষটার গলায় একটা কালো রেখা আছে। কিন্তু ওড়ার সময় পাখায় কালো, সাদা, কমলা ও নীলচে রং বেরিয়ে আসে। বেশ বড়সড় এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় এরা সহজেই শিকারিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
আর একটু যেতেই পদ্মার মূল ধারা। দূর থেকেই চোখে পড়ল একঝাঁক পাখি। ওখান থেকে তানভীর তাঁর ক্যামেরায় পাখির ঝাঁকের মালার মতো সারি হয়ে বসে থাকার দৃশ্য ধারণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন। আমরা বেশ পেছনে। অবাক করা বিষয়, পাখিগুলো বেশ আয়েশ করে বসে আছে। ওড়ার নামটি নেই। কিন্তু কাছে গিয়ে হতাশ হয়ে তানভীর বললেন, সব পানকৌড়ির ঝাঁক। এগুলো পুকুর-বিলেই পাওয়া যায়।
খাঁড়িটা পার হয়ে পূর্ব পাশে উঁচু বালুর পাড়ের ওপারে গিয়ে কয়েকটি চখার দেখা মিলল। সব মিলিয়ে গোটা ছয়েক হবে। কিন্তু কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আরও পূর্ব দিকে চখার দল দেখা যাচ্ছে কিন্তু গিয়ে তো লাভ নেই। ওরা আরও দূরে চলে যাবে। তা ছাড়া সূর্যটা রশ্মি গুটিয়ে ইতিমধ্যে তার গোল থালার ভেতরে ভরে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছে।
সোহেল বললেন, এই এলাকা পশুপাখিদের জন্য নিরাপদ। এ জন্য এখানে অনেক পাখি থাকে। এখানে কোনো শিকারি আসে না। কেন আসে না—জানতে চাইলে সোহেল হাসতে হাসতে বললেন, এটা তো ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছাকাছি এলাকা। ভারতের লোকদের শিকারের ব্যাপারে কড়াকড়ি। তা ছাড়া নদীটা পার হয়ে ভারতের লোকদের এ পারে আসতে হলে পরিচয়পত্র বিএসএফের কাছে জমা দিয়ে সময় বেঁধে দিয়ে আসতে হয়। কেউ শিকার করতে আসতে পারে না। আবার বাংলাদেশের লোকও বন্দুক নিয়ে সীমান্তের এত কাছে আসতে পারে না। দেখা গেল, অদূরেই বিএসএফের গোলঘর। আমাদের একজন বললেন, ‘ওরা গুলি করে দেবে না তো।’ সোহেল অভয় দিলেন, ‘গুলি করে না, তবে এখন আর এখানে না থাকাই ভালো।’ এ কথা শুনেই আমরা ফেরার জন্য পা তুললাম। সোহেল বলেন, ‘আরে ভয় পান কেন? ওই দেখেন বাংলাদেশি ডিঙিগুলো ভারতের কত ভেতরে বাঁধা।’ নৌকার দিকে না তাকিয়ে আমরা পেছেন ফিরে খুঁজতে লাগলাম কত দূরে গহমাবোনা গ্রাম। তখন গ্রামের উঁচু গাছগুলোর মাথা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।
No comments