সময়চিত্র-টার্গেট যখন ড. ইউনূস by আসিফ নজরুল
২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ড. ইউনূসের বক্তৃতা শোনার জন্য ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভার একটি যুক্ত সভা হয়েছিল। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ড. ইউনূসকে সম্মানিত বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া একটি সত্যিকারের প্রিভিলেজ (বিশেষ সুযোগ) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
আবেগপূর্ণ বক্তৃতার একটি অংশে তিনি বলেছিলেন: ‘২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার আছে এবং আমি আবারও তাঁর কাজ এবং আমাদের মধ্যে তাঁর উপস্থিতিকে স্যালুট (অভিবাদন) জানাচ্ছি।’
ড. ইউনূসকে নিয়ে ঠিক এক বছর পর বাংলাদেশের কয়েকটি দৈনিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ড. ইউনূস এবং তাঁর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন সঙ্গে সঙ্গে এই ভিত্তিহীন সংবাদের প্রতিবাদ করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিবাদপত্রটি উল্লিখিত দৈনিকগুলোর কোনো কোনোটি ছাপানোরই দায়িত্ব অনুভব করেনি।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও ভয়ংকর অপপ্রচার চলে সে সময়। নরওয়ের টেলিভিশনের একটি প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল যে গ্রামীণ ব্যাংক দাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া ব্যাংকের তহবিল থেকে অন্য একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তহবিলে টাকা স্থানান্তর করে অনুদানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। প্রামাণ্যচিত্রে কোথাও ড. ইউনূস কর্তৃক টাকা আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। অথচ এই প্রামাণ্যচিত্রের বরাত দিয়ে কিছু কিছু পত্রিকার সংবাদে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ কিংবা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয়। পরে নরওয়ে সরকার নতুনভাবে তদন্ত করে জানিয়ে দেয় যে বিষয়টি বহু আগে সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তাতে দুর্নীতি বা টাকা আত্মসাতের কোনো বিষয় ছিল না।
বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ড. ইউনূসকে গরিবের রক্তচোষা হিসেবে ইঙ্গিত করেন এবং ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি ব্যাপক তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। এরপর সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারকেরা ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন এবং সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু সংবাদমাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানান কুৎসামূলক সংবাদ ও সংবাদভাষ্য প্রচারিত হতে থাকে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে হয়, অনেকটা তেমনভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে ভিনদেশি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে যখন সরকার নানাভাবে সম্মান জানাচ্ছে, সে সময় আমাদের দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে জামিনের জন্য ছুটতে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন আদালতে।
২ মার্চ তাঁর ওপর আসে চূড়ান্ত আঘাত। সারা পৃথিবীতে সম্মানিত গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মদাতা এবং নির্মাতাকে এদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একটি চিঠি দিয়ে। রাতে টেলিভিশন খুলে দেখি, আইন পেশার ধারে-কাছে নেই এমন কেউ কেউ এটি আইনগতভাবে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের আদৌ কোনো সফলতা আছে নাকি তা নিয়ে। এর আগে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিবকে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার পর ইউনূসবিরোধী যে প্রচারণার কোরাস চলছে থেমে থেমে, তাতে দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরাও যোগ দিয়েছেন কোনো তথ্য-প্রমাণ এমনকি যুক্তি ছাড়াই।
মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের তদন্ত চলছে। আদালতে বিচার হচ্ছে। একই সঙ্গে একশ্রেণীর গণমাধ্যমের বিচার চলছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি নতুন প্রতিষ্ঠান, চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করে বাংলাদেশকে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন বিরল ও অনন্য সম্মান এনে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষের সম্পর্কে সমালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও সংযম থাকা উচিত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে জনগণ ও বাংলাদেশের স্বার্থ এবং দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যথেষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল।
২.
মুহাম্মদ ইউনূস কি তাই বলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে? অবশ্যই না। তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, আইনের তো নয়ই। বহু বছর ধরে ড. ইউনূসের সমালোচনা করে আসছেন বদরুদ্দীন উমর। কোন সরকার ক্ষমতায় আছে, কখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর রুষ্ট, এই হিসাব-নিকাশ তাঁর সমালোচনায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য বহু ব্যক্তি ও গণমাধ্যম তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের সমালোচনা করার পর। তাদের সমালোচনায় যুক্তি নেই, পাণ্ডিত্য নেই, এমনকি সৌজন্যবোধও নেই। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং হচ্ছেন ড. ইউনূস। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ইউনূস সেন্টার এবং মাইক্রোক্রেডিট ডিপার্টমেন্ট খুলে তাঁর চিন্তাকে অধ্যয়ন করছে, সেখানে বাংলাদেশে কিছু মানুষ কোনো প্রমাণ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনায় নেমেছে। আমাদের আপত্তি সেখানেই।
ব্যক্তির সমালোচনার চেয়ে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আক্রমণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে তাঁকে অপসারণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পত্রিকায় দেখেছি, তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দুটো কারণ দেখিয়ে। প্রথমত, তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, তিনি চাকরির বয়সসীমা ৬০ পার করেছেন অনেক বছর আগে। আমার মতে, এই দুটো যুক্তির কোনোটিই ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ‘গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩’ নামে আলাদা একটি আইন অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালিত। এই আইনের ৩৬ ধারায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনার স্বার্থে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালের গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) আইনের ১৪ ধারা অনুসারে বিধিগুলো সরকার কর্তৃক পূর্বানুমোদন করানোর প্রয়োজন নেই। সে মোতাবেক ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধি প্রণয়ন করে, যাতে বলা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না এবং গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিবিধি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই বিধি যদি অবৈধ না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বয়স বা পূর্বানুমোদনের কথা বলে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না। এই বিধি অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক ১০ বছর যাবৎ পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিধিকে অবৈধ ঘোষণা না করে বা এ সম্পর্কিত কোনো আইনি উদ্যোগ না গ্রহণ করেই গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়েছে। ড. ইউনূসকে আইনসংগতভাবে অপসারিত করতে চাইলে এই বিধি আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করানোর বা এটি পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাতিল করার চেষ্টা করা আবশ্যক ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে অপসারিত করতে পারে কি না, তা নিয়েও আইনগত প্রশ্ন তোলা যায়। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুসারে চাকরিদাতাই কেবল চাকরি থেকে কাউকে অপসারিত করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এটি অনুমোদন করতে পারে বা অনুমোদন না করতে পারে। আমাদের প্রশ্ন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয় তা ২০০১ সালের বিধির মাধ্যমে লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে মেনে নিল কেন? প্রিন্সিপল অব এসটোপেল অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ বছর পর এখন ভিন্ন ভূমিকা নিতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে তার অভিমত জানানো এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া। পরিচালনা পর্ষদ ড. ইউনূসকে সে অনুসারে অব্যাহতি না দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে যেতে পারত। কিন্তু তাই বলে সরাসরি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। গ্রামীণ ব্যাংক যে আইন দ্বারা পরিচালিত তাতে ঠিক এ ধরনের কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদান করা হয়নি। ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে, কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আগে তাঁকে নোটিশ দেওয়া ও তাঁর বক্তব্য শোনা। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে এমনকি এই নীতিও মানা হয়নি।
৩.
৭০ বছর হয়েছে তাই ড. ইউনূসের চলে যাওয়া উচিত কিংবা চিরদিন এক পদ ধরে না রেখে তাঁর চলে যাওয়া উচিত—এ ধরনের কথাও বলছেন সরকারের কেউ কেউ। তাঁদের কেউ কেউ ড. ইউনূসের চেয়েও বয়স্ক বা তাঁর সমবয়সী। সরকার অবসর থেকে ডেকে এনে যাঁদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা মনে করি, বয়স নয়, জনস্বার্থ ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দক্ষতা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা। ড. ইউনূস কি তাঁর দক্ষতা হারিয়েছেন, তাঁর বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের বিকাশ কি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? দেশে এবং সারা বিশ্বে ব্যাংকের বিকাশ এবং ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তো দিন দিন বরং বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
ড. ইউনূসের একটি ব্যর্থতা হচ্ছে, তিনি তাঁর উত্তরসূরি তৈরি করতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলা যায়। ড. ইউনূস এর কোনো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হতে পারেননি। ভালো হতো, তিনি যদি তা পারতেন। ভালো হয়, সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংক যদি অন্য কোনোভাবে ব্যাংক এবং এর সব সহযোগী প্রতিষ্ঠানে তাঁর ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞতাকে স্থায়ী ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে কোনো আইনি সংস্কার করতে পারে। সম্মানজনকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এখনো তা করা সম্ভব।
আমাদের বুঝতে হবে, এখন যেভাবে তাঁকে অপসারিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, এটি জনস্বার্থমূলক নয় এবং এতে সুশাসনের কোনো লক্ষণ নেই। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে অধিকাংশ পাঠক এতে দেশের ভাবমূর্তি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণ্যমান্য প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিরা এর নিন্দা করছেন। উন্নয়ন-সহযোগীরা বহু আগে থেকে ড. ইউনূসকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তাতে তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে আসছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু সরকার, ড. ইউনূস বা গ্রামীণ ব্যাংক নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও স্বার্থ। হুমকির মুখে পড়েছে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সুবিধাভোগী লাখ লাখ সাধারণ মানুষ।
আমাদের উৎকণ্ঠা সেখানেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. ইউনূসকে নিয়ে ঠিক এক বছর পর বাংলাদেশের কয়েকটি দৈনিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ড. ইউনূস এবং তাঁর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন সঙ্গে সঙ্গে এই ভিত্তিহীন সংবাদের প্রতিবাদ করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিবাদপত্রটি উল্লিখিত দৈনিকগুলোর কোনো কোনোটি ছাপানোরই দায়িত্ব অনুভব করেনি।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও ভয়ংকর অপপ্রচার চলে সে সময়। নরওয়ের টেলিভিশনের একটি প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল যে গ্রামীণ ব্যাংক দাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া ব্যাংকের তহবিল থেকে অন্য একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তহবিলে টাকা স্থানান্তর করে অনুদানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। প্রামাণ্যচিত্রে কোথাও ড. ইউনূস কর্তৃক টাকা আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। অথচ এই প্রামাণ্যচিত্রের বরাত দিয়ে কিছু কিছু পত্রিকার সংবাদে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ কিংবা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয়। পরে নরওয়ে সরকার নতুনভাবে তদন্ত করে জানিয়ে দেয় যে বিষয়টি বহু আগে সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তাতে দুর্নীতি বা টাকা আত্মসাতের কোনো বিষয় ছিল না।
বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ড. ইউনূসকে গরিবের রক্তচোষা হিসেবে ইঙ্গিত করেন এবং ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি ব্যাপক তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। এরপর সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারকেরা ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন এবং সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু সংবাদমাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানান কুৎসামূলক সংবাদ ও সংবাদভাষ্য প্রচারিত হতে থাকে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে হয়, অনেকটা তেমনভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে ভিনদেশি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে যখন সরকার নানাভাবে সম্মান জানাচ্ছে, সে সময় আমাদের দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে জামিনের জন্য ছুটতে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন আদালতে।
২ মার্চ তাঁর ওপর আসে চূড়ান্ত আঘাত। সারা পৃথিবীতে সম্মানিত গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মদাতা এবং নির্মাতাকে এদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একটি চিঠি দিয়ে। রাতে টেলিভিশন খুলে দেখি, আইন পেশার ধারে-কাছে নেই এমন কেউ কেউ এটি আইনগতভাবে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের আদৌ কোনো সফলতা আছে নাকি তা নিয়ে। এর আগে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিবকে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার পর ইউনূসবিরোধী যে প্রচারণার কোরাস চলছে থেমে থেমে, তাতে দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরাও যোগ দিয়েছেন কোনো তথ্য-প্রমাণ এমনকি যুক্তি ছাড়াই।
মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের তদন্ত চলছে। আদালতে বিচার হচ্ছে। একই সঙ্গে একশ্রেণীর গণমাধ্যমের বিচার চলছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি নতুন প্রতিষ্ঠান, চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করে বাংলাদেশকে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন বিরল ও অনন্য সম্মান এনে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষের সম্পর্কে সমালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও সংযম থাকা উচিত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে জনগণ ও বাংলাদেশের স্বার্থ এবং দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যথেষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল।
২.
মুহাম্মদ ইউনূস কি তাই বলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে? অবশ্যই না। তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, আইনের তো নয়ই। বহু বছর ধরে ড. ইউনূসের সমালোচনা করে আসছেন বদরুদ্দীন উমর। কোন সরকার ক্ষমতায় আছে, কখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর রুষ্ট, এই হিসাব-নিকাশ তাঁর সমালোচনায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য বহু ব্যক্তি ও গণমাধ্যম তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের সমালোচনা করার পর। তাদের সমালোচনায় যুক্তি নেই, পাণ্ডিত্য নেই, এমনকি সৌজন্যবোধও নেই। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং হচ্ছেন ড. ইউনূস। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ইউনূস সেন্টার এবং মাইক্রোক্রেডিট ডিপার্টমেন্ট খুলে তাঁর চিন্তাকে অধ্যয়ন করছে, সেখানে বাংলাদেশে কিছু মানুষ কোনো প্রমাণ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনায় নেমেছে। আমাদের আপত্তি সেখানেই।
ব্যক্তির সমালোচনার চেয়ে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আক্রমণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে তাঁকে অপসারণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পত্রিকায় দেখেছি, তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দুটো কারণ দেখিয়ে। প্রথমত, তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, তিনি চাকরির বয়সসীমা ৬০ পার করেছেন অনেক বছর আগে। আমার মতে, এই দুটো যুক্তির কোনোটিই ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ‘গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩’ নামে আলাদা একটি আইন অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালিত। এই আইনের ৩৬ ধারায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনার স্বার্থে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালের গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) আইনের ১৪ ধারা অনুসারে বিধিগুলো সরকার কর্তৃক পূর্বানুমোদন করানোর প্রয়োজন নেই। সে মোতাবেক ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধি প্রণয়ন করে, যাতে বলা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না এবং গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিবিধি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই বিধি যদি অবৈধ না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বয়স বা পূর্বানুমোদনের কথা বলে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না। এই বিধি অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক ১০ বছর যাবৎ পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিধিকে অবৈধ ঘোষণা না করে বা এ সম্পর্কিত কোনো আইনি উদ্যোগ না গ্রহণ করেই গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়েছে। ড. ইউনূসকে আইনসংগতভাবে অপসারিত করতে চাইলে এই বিধি আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করানোর বা এটি পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাতিল করার চেষ্টা করা আবশ্যক ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে অপসারিত করতে পারে কি না, তা নিয়েও আইনগত প্রশ্ন তোলা যায়। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুসারে চাকরিদাতাই কেবল চাকরি থেকে কাউকে অপসারিত করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এটি অনুমোদন করতে পারে বা অনুমোদন না করতে পারে। আমাদের প্রশ্ন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয় তা ২০০১ সালের বিধির মাধ্যমে লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে মেনে নিল কেন? প্রিন্সিপল অব এসটোপেল অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ বছর পর এখন ভিন্ন ভূমিকা নিতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে তার অভিমত জানানো এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া। পরিচালনা পর্ষদ ড. ইউনূসকে সে অনুসারে অব্যাহতি না দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে যেতে পারত। কিন্তু তাই বলে সরাসরি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। গ্রামীণ ব্যাংক যে আইন দ্বারা পরিচালিত তাতে ঠিক এ ধরনের কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদান করা হয়নি। ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে, কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আগে তাঁকে নোটিশ দেওয়া ও তাঁর বক্তব্য শোনা। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে এমনকি এই নীতিও মানা হয়নি।
৩.
৭০ বছর হয়েছে তাই ড. ইউনূসের চলে যাওয়া উচিত কিংবা চিরদিন এক পদ ধরে না রেখে তাঁর চলে যাওয়া উচিত—এ ধরনের কথাও বলছেন সরকারের কেউ কেউ। তাঁদের কেউ কেউ ড. ইউনূসের চেয়েও বয়স্ক বা তাঁর সমবয়সী। সরকার অবসর থেকে ডেকে এনে যাঁদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা মনে করি, বয়স নয়, জনস্বার্থ ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দক্ষতা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা। ড. ইউনূস কি তাঁর দক্ষতা হারিয়েছেন, তাঁর বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের বিকাশ কি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? দেশে এবং সারা বিশ্বে ব্যাংকের বিকাশ এবং ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তো দিন দিন বরং বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
ড. ইউনূসের একটি ব্যর্থতা হচ্ছে, তিনি তাঁর উত্তরসূরি তৈরি করতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলা যায়। ড. ইউনূস এর কোনো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হতে পারেননি। ভালো হতো, তিনি যদি তা পারতেন। ভালো হয়, সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংক যদি অন্য কোনোভাবে ব্যাংক এবং এর সব সহযোগী প্রতিষ্ঠানে তাঁর ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞতাকে স্থায়ী ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে কোনো আইনি সংস্কার করতে পারে। সম্মানজনকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এখনো তা করা সম্ভব।
আমাদের বুঝতে হবে, এখন যেভাবে তাঁকে অপসারিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, এটি জনস্বার্থমূলক নয় এবং এতে সুশাসনের কোনো লক্ষণ নেই। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে অধিকাংশ পাঠক এতে দেশের ভাবমূর্তি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণ্যমান্য প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিরা এর নিন্দা করছেন। উন্নয়ন-সহযোগীরা বহু আগে থেকে ড. ইউনূসকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তাতে তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে আসছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু সরকার, ড. ইউনূস বা গ্রামীণ ব্যাংক নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও স্বার্থ। হুমকির মুখে পড়েছে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সুবিধাভোগী লাখ লাখ সাধারণ মানুষ।
আমাদের উৎকণ্ঠা সেখানেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments