নিসর্গ-আড়িয়ল ও আনুষঙ্গিক by দ্বিজেন শর্মা
‘মানুষ বিশ্বজগতের জাল বোনেনি, সে এই জালের একটি সুতোমাত্র, এই জাল ছিন্ন করলে সে নিজেই বিপন্ন হবে।’ এটি উদ্ধৃত হলো ১৮৫৬ সালে নিউইয়র্কের গভর্নরকে সিয়াটল নামের জনৈক রেড-ইন্ডিয়ানের লেখা একটি চিঠি থেকে।
কয়েকটা গাছ কাটলে, নরভুক বাঘ ও ফসলভুক পাখি মারলে কী এমন ক্ষতি মানুষের? কী এমন অমূল্য ধন আছে
কয়েকটা গাছ কাটলে, নরভুক বাঘ ও ফসলভুক পাখি মারলে কী এমন ক্ষতি মানুষের? কী এমন অমূল্য ধন আছে
আড়িয়ল বিলে, সেখানে বিমানবন্দর বানালে দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে? এ-ই তো চলছে অনাদিকাল থেকে এবং এভাবেই তো গড়ে উঠেছে সভ্যতা, মানুষের নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবন। যাঁরা প্রায়ই এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরা ওই চিঠিটি পড়তে পারেন। চিঠিটিতে আছে প্রকৃতিপুত্র আদিবাসী মানুষের বিশ্ববীক্ষা, প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগ-নির্ভর জীবনযাত্রার যৌক্তিকতা ও যন্ত্রসভ্যতার অবশ্যম্ভাবী বিনষ্টির পূর্বাভাস। সেই রেড ইন্ডিয়ান পত্রলেখকের কথা কেউ শোনেনি। মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা আদিবাসীদের উৎখাত করেছে বন ও বন্য জন্তুর মতো, যা আজও চলছে প্রায় সর্বত্র, আমাদের দেশেও। লক্ষণীয়, মর্গান ও মার্ক্স-এঙ্গেলস ওই আদিবাসীদের জীবনপ্রণালি থেকেই নিজ নিজ তত্ত্বগ্রন্থনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং আজকের ইকো-সমাজতন্ত্রী ও ‘ডিপ ইকোলজি’র প্রবক্তারা ওই আদলেই ভবিষ্যৎ সভ্যতার কাঠামো নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন।
যন্ত্রসভ্যতার জয়যাত্রা অব্যাহত আছে, চলছে শ্রমজীবী মানুষ ও প্রকৃতির অবাধ শোষণ, আর এটাই উন্নয়নের মৌল মডেল। বিকল্প আরেকটি মডেলও কিছুকাল টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে, সেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ বন্ধ হলেও নিবৃত্ত হয়নি ভোগবাদ ও প্রকৃতির যদৃচ্ছা দোহন। গান্ধীরও একটি কৃষিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন মডেল ছিল, কিন্তু তাঁর স্বদেশ ভারত তা গ্রহণ করেনি। শুমেকারের ‘ক্ষুদ্রই সুন্দর’ কোথাও আমল পায়নি, কেননা ‘বৃহৎ অপরিহার্য’। আফ্রিকান গান্ধী জুলিয়াস নায়বেরি শুমেকারের ‘প্ররোচনায়’ তানজানিয়ায় উন্নয়নের আফ্রিকীয় মডেল চালু করে মার্কিন বিরোধিতায় ক্ষমতা হারান। এককালের সমাজতন্ত্রী চীন আজ ভোগবাদের উর্বর অকুস্থল ও প্রকট প্রকৃতিবিমুখ। বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশাল’ এখন স্মৃতিমাত্র।
কৃষিসভ্যতার পতনের পর উন্নয়ন সর্বত্রই শিল্পনির্ভর। শিল্পবিপ্লবের সূচনা ইংল্যান্ডে। শিল্পোন্নয়নের সেই আদিপর্বে কলকারখানার জ্বালানি ও কাঁচামাল জোগান দিয়ে বন-বনানী উজাড় হতে থাকলে এবং বর্জ্যদূষণে শহরাঞ্চল বাসযোগ্যতা হারালে তাদের নজর পড়ে উপনিবেশগুলোর দিকে এবং সেগুলোই হয়ে ওঠে মুশকিল-আসান। আজ উপনিবেশ নেই, কিন্তু উন্নত বিশ্ব কৌশলটি অব্যাহত রেখেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, উজাড় হচ্ছে ক্রান্তীয় বৃষ্টিবন, দূষিত হচ্ছে নদী ও জলাশয়, বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, আর তাতে মদদ জোগাচ্ছে আক্রান্ত দেশের বশংবদ রাজনীতিক ও আমলারা।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন শুরুর সেই যুগের মতো। আমাদের দেশটিও ছোট, নেই কিন্তু কোনো উপনিবেশ। সে কারণে শিল্পের প্রসার ও পরিবেশ সুরক্ষার যথাযোগ্য মেলবন্ধন ঘটানো কঠিন। এই সঙ্গে আছে অত্যধিক জনঘনত্ব। ইতিমধ্যে অনেক নদী দূষিত, বনাঞ্চলের আয়তন সর্বনিম্ন, চলছে পাহাড় কাটা, নদী দখল, জলাভূমি ভরাট ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সরকার নিষ্ক্রিয় নেই, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের চেষ্টা আছে—কাগজে এসব খবর আমরা পড়ি ও আশান্বিত হই। কিন্তু আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ আমাদের ধন্দে ফেলে, কেননা আমরা রামসার কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা, জলাভূমি সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। বিমানবন্দর নির্মাণ-প্রকল্প স্থানান্তরিত হয়েছে জনমতের চাপে, বাস্তুসংস্থানকে মান্য করে নয়। বিরোধী দলের বক্তব্যও তথৈবচ। তাহলে কি ধরে নেব যে আমাদের রাজনীতিকেরা দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথাসম্ভব সুরক্ষা প্রদানে আন্তরিক নন? এমনটি হলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমের কাছ থেকে প্রাপ্য খেসারত আদায় আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে।
আজকাল সাসটেইনেবল বা পরিপোষক উন্নয়নের ব্যাপক প্রচার চলছে, যাতে আছে বাস্তুসংস্থান সুরক্ষা, পরিবেশদূষক বর্জ্য নিঃসরণ হ্রাস, অরগানিক কৃষি, প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ইত্যাদি। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক আবহে এটির বাস্তবায়ন সুকঠিন। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা পশ্চিমা করপোরেট সংস্থাগুলো, সেই সব দেশের রাজনীতিকেরা যাদের ক্রীড়নক। প্রয়োজনীয় সময়ের দৈর্ঘ্যও একটি প্রতিকূল ফ্যাক্টর। সময় আমাদের নেই। আগামী ৫০ বছর হলো শেষ সীমা। ইতিমধ্যে দূষণমুক্ত জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সাহায্যে সাবেকি উৎপাদন-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে বর্তমান সভ্যতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
আগামী ৫০ বছরের সময়কালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন হবে? জনসংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, নদীনালা, হাওর-বাঁওড় ভরাট হতে থাকবে, বনজঙ্গল বিলীন হবে, জীববৈচিত্র্যের নির্বিশেষ বিনাশ ঘটবে, মাথাপিছু খেতজমির পরিমাণ শূন্যাঙ্কে পৌঁছাবে, সারা দেশ গৃহময় হয়ে উঠবে এবং জনারণ্যে অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা নামবে। দেশের মানুষ তখন কতটা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে, রাজনীতিকদের কাছে এটাই আমাদের জিজ্ঞাস্য।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
যন্ত্রসভ্যতার জয়যাত্রা অব্যাহত আছে, চলছে শ্রমজীবী মানুষ ও প্রকৃতির অবাধ শোষণ, আর এটাই উন্নয়নের মৌল মডেল। বিকল্প আরেকটি মডেলও কিছুকাল টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে, সেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ বন্ধ হলেও নিবৃত্ত হয়নি ভোগবাদ ও প্রকৃতির যদৃচ্ছা দোহন। গান্ধীরও একটি কৃষিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন মডেল ছিল, কিন্তু তাঁর স্বদেশ ভারত তা গ্রহণ করেনি। শুমেকারের ‘ক্ষুদ্রই সুন্দর’ কোথাও আমল পায়নি, কেননা ‘বৃহৎ অপরিহার্য’। আফ্রিকান গান্ধী জুলিয়াস নায়বেরি শুমেকারের ‘প্ররোচনায়’ তানজানিয়ায় উন্নয়নের আফ্রিকীয় মডেল চালু করে মার্কিন বিরোধিতায় ক্ষমতা হারান। এককালের সমাজতন্ত্রী চীন আজ ভোগবাদের উর্বর অকুস্থল ও প্রকট প্রকৃতিবিমুখ। বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশাল’ এখন স্মৃতিমাত্র।
কৃষিসভ্যতার পতনের পর উন্নয়ন সর্বত্রই শিল্পনির্ভর। শিল্পবিপ্লবের সূচনা ইংল্যান্ডে। শিল্পোন্নয়নের সেই আদিপর্বে কলকারখানার জ্বালানি ও কাঁচামাল জোগান দিয়ে বন-বনানী উজাড় হতে থাকলে এবং বর্জ্যদূষণে শহরাঞ্চল বাসযোগ্যতা হারালে তাদের নজর পড়ে উপনিবেশগুলোর দিকে এবং সেগুলোই হয়ে ওঠে মুশকিল-আসান। আজ উপনিবেশ নেই, কিন্তু উন্নত বিশ্ব কৌশলটি অব্যাহত রেখেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, উজাড় হচ্ছে ক্রান্তীয় বৃষ্টিবন, দূষিত হচ্ছে নদী ও জলাশয়, বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, আর তাতে মদদ জোগাচ্ছে আক্রান্ত দেশের বশংবদ রাজনীতিক ও আমলারা।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন শুরুর সেই যুগের মতো। আমাদের দেশটিও ছোট, নেই কিন্তু কোনো উপনিবেশ। সে কারণে শিল্পের প্রসার ও পরিবেশ সুরক্ষার যথাযোগ্য মেলবন্ধন ঘটানো কঠিন। এই সঙ্গে আছে অত্যধিক জনঘনত্ব। ইতিমধ্যে অনেক নদী দূষিত, বনাঞ্চলের আয়তন সর্বনিম্ন, চলছে পাহাড় কাটা, নদী দখল, জলাভূমি ভরাট ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সরকার নিষ্ক্রিয় নেই, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের চেষ্টা আছে—কাগজে এসব খবর আমরা পড়ি ও আশান্বিত হই। কিন্তু আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ আমাদের ধন্দে ফেলে, কেননা আমরা রামসার কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা, জলাভূমি সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। বিমানবন্দর নির্মাণ-প্রকল্প স্থানান্তরিত হয়েছে জনমতের চাপে, বাস্তুসংস্থানকে মান্য করে নয়। বিরোধী দলের বক্তব্যও তথৈবচ। তাহলে কি ধরে নেব যে আমাদের রাজনীতিকেরা দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথাসম্ভব সুরক্ষা প্রদানে আন্তরিক নন? এমনটি হলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমের কাছ থেকে প্রাপ্য খেসারত আদায় আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে।
আজকাল সাসটেইনেবল বা পরিপোষক উন্নয়নের ব্যাপক প্রচার চলছে, যাতে আছে বাস্তুসংস্থান সুরক্ষা, পরিবেশদূষক বর্জ্য নিঃসরণ হ্রাস, অরগানিক কৃষি, প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ইত্যাদি। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক আবহে এটির বাস্তবায়ন সুকঠিন। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা পশ্চিমা করপোরেট সংস্থাগুলো, সেই সব দেশের রাজনীতিকেরা যাদের ক্রীড়নক। প্রয়োজনীয় সময়ের দৈর্ঘ্যও একটি প্রতিকূল ফ্যাক্টর। সময় আমাদের নেই। আগামী ৫০ বছর হলো শেষ সীমা। ইতিমধ্যে দূষণমুক্ত জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সাহায্যে সাবেকি উৎপাদন-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে বর্তমান সভ্যতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
আগামী ৫০ বছরের সময়কালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন হবে? জনসংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, নদীনালা, হাওর-বাঁওড় ভরাট হতে থাকবে, বনজঙ্গল বিলীন হবে, জীববৈচিত্র্যের নির্বিশেষ বিনাশ ঘটবে, মাথাপিছু খেতজমির পরিমাণ শূন্যাঙ্কে পৌঁছাবে, সারা দেশ গৃহময় হয়ে উঠবে এবং জনারণ্যে অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা নামবে। দেশের মানুষ তখন কতটা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে, রাজনীতিকদের কাছে এটাই আমাদের জিজ্ঞাস্য।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
No comments