চেতনা-একুশ যেন ফুরিয়ে না যায় by এম আবদুল হাফিজ

একুশের ট্র্যাজেডি একটাই। এর ত্রূক্রর স্থূল আনুষ্ঠানিকতা। এর প্রাণহীন স্থবিরতা যেন একুশের সূর্যাস্তের পরই এর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গেল। একুশের সামাজিকতা এবং উপভোগ্য বস্তুগুলোর আকর্ষণ অক্ষুণ্ন থাকলেও যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আদৌ একুশের বিস্ফোরণ হয়েছিল_ সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন, এর ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা, এর সর্বাঙ্গীণ


উৎকর্ষ সাধন এগুলোর প্রতি এখনও আকর্ষণ সামান্যই। ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জাতিদের ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে গবেষণা এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে সেগুলোর মেলবন্ধন ঘটানো, এসবে কারও আগ্রহ নেই। শুনলে আশ্চর্য লাগে যে, আজও নাকি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়নি। আন্দোলনে শহীদদের স্বজনদের নাকি একুশের কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণও জানানো হয় না। ট্র্যাডিশন তো ঠিকই আছে

সাঙ্গ হলো একুশ উদযাপন। শহীদ মিনারের অঙ্গনে আলপনা শোভা পাবে কিছুদিন। চত্বরের পরিচ্ছন্নতাও থাকবে দিনকয়েক। আবার ধুলো-আবর্জনার স্তূপ জমবে সেখানে। এ মাসের শেষ নাগাদ বইমেলাও সমাপ্ত হবে। আগামী এক বছর প্রাণের মেলার এ প্রাঙ্গণকে তাড়া করবে স্মৃতি, নির্জনতা এবং বিবর্ণ ঘাস, খড়কুটো। মিলনের মেলায় এবারই অনেককে দেখা যায়নি। আগামীতে আরও অনেককে দেখা যাবে না। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ গাজীউল হক এবার ছিলেন না, তবু যেন অনেকের ভিড়ে কেউ তার অভাবও অনুভব করেননি।
একুশের ট্র্যাজেডি একটাই। এর ক্রূর স্থূল আনুষ্ঠানিকতা। এর প্রাণহীন স্থবিরতা যেন একুশের সূর্যাস্তের পরই এর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গেল। একুশের সামাজিকতা এবং উপভোগ্য বস্তুগুলোর আকর্ষণ অক্ষুণ্ন থাকলেও যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আদৌ একুশের বিস্ফোরণ হয়েছিল_ সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন, এর ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা, এর সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সাধন এগুলোর প্রতি এখনও আকর্ষণ সামান্যই। ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জাতিদের ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে গবেষণা এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে সেগুলোর মেলবন্ধন ঘটানো, এসবে কারও আগ্রহ নেই। শুনলে আশ্চর্য লাগে যে, আজও নাকি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়নি। আন্দোলনে শহীদদের স্বজনদের নাকি একুশের কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণও জানানো হয় না। ট্র্যাডিশন তো ঠিকই আছে।
যে দেশের মন্ত্রী নির্দয় উচ্চারণে বলতে পারেন, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট অথবা বর্ডারে ওইসব ঘটনা অর্থাৎ (বাংলাদেশিদের) হত্যা-নির্যাতন হয়েই থাকে, এ নিয়ে আবার হইচইয়ের কী হলো_ সে দেশের ভাষা সংগ্রামীরা উপেক্ষিত-অবহেলিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। ভাষা আন্দোলন গোড়ার দিকে ছিল এক প্রকার ছাত্র গণআন্দোলন, তা এখন উদযাপন করে মূলত এলিট সম্প্রদায়, যাদের আছে নিরাপত্তার প্রশ্ন, আছে শুচিবায়ুগ্রস্ততার বিষয় এবং আছে পদ-পদবির সচেতনতা। তাই এখন একুশের মতো করে উদযাপিত হতে পারে না। মন্ত্রী-আমলারা তো আর সাধারণের কাতারে আসতে পারেন না। তবু যেটুকু আসেন বা আসতে হয় তা একান্তই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায়। তাদের কিছু এসে যায় না যে, বাংলা ভাষার প্রচলন হলো কিনা। কেননা তারা তো কদাচিৎ জনসমক্ষে আসেন, তাও নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে, তাদের সন্তান-সন্ততিরা তো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল বা কলেজে পড়ে, অতঃপর মেধাসাপেক্ষে পাড়ি জমায় আমেরিকা বা কানাডার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের বাংলা ভাষার উৎকর্ষ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? তার বদলে তাদের এপার বাংলা-ওপার বাংলা নিয়ে খানিকটা তৎপরতা দেখাতে পারলেই যথেষ্ট।
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পেরিয়ে গেছে, আরও ষাট বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলা ভাষার বানান বিভ্রাট বা উচ্চারণ বিভ্রাট থেকেই যাবে। শুদ্ধ বাংলা কথনের রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে। তবে ব্যতিক্রমও যে আছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ক্রমক্ষয়িষ্ণু স্তম্ভগুলো যখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে তখনকার কথা ভাবলে ভাষাপ্রেমীদের উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া পথ খোলা থাকবে না। অবশিষ্ট ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য থেকে সাধারণ মানুষ এমনই একটি ধারণা পায়, যদিও ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মতো ভাষাসংগ্রামী এখনও আশাবাদী।
যেভাবে এবং যত দ্রুত সমাজ বদলাচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে শঙ্কা হয় যে, একুশের বা বইমেলার ঐতিহ্যকে কতদিন ধরে রাখা যায়। কেননা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার নামে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিলেন তা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। শুধু এ বক্তৃতাই নয়, ভাষার মাস আসা থেকে ভাষা সংক্রান্ত সভা-সমাবেশ প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। এ চাতুর্য প্রথমে ধরা না পড়লেও পরে শ্রোতাসাধারণ সতর্ক হয়ে গেছে। ভাষাই যেখানে বিষয় এবং তার উৎকর্ষতাই যখন প্রতিপাদ্য এসব সমাবেশে রাজনৈতিক ভাষণ এবং তাও আবার বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে নৈতিকতাবর্জিত। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম স্ফুরণ। এর মর্যাদা, ইতিহাস কোনো প্রকার রাজনৈতিক কলঙ্ক কালিমা থেকে সুরক্ষা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। একুশ বারবার এ বাংলায় ফিরে আসুক এবং আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিক প্রভাত সূর্যের আলো, বিদূরিত হোক আমাদের অন্তরের সংকীর্ণতা এবং অন্ধকার।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.