সরল গরল-খালেদা-আমিনী এবং ‘সংবিধান পোড়ানো’র গল্প by মিজানুর রহমান খান
বাকস্বাধীনতা-সংশ্লিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যা ঘটে গেল, তা বেদনাদায়ক। আমরা ক্রমাগত বিস্ময়ে বিমূঢ়। প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি দিয়ে শুরুর পরে সহিংসতা এখন এজলাসে ঢুকেছে। যাঁরা হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তি করেছেন, বোতল ছুড়েছেন, তাঁদের যদি কেউ চোট পেয়ে থাকেন, সেই চোট মিলিয়ে যাবে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট যে চোট পেয়েছেন, সেটা মিলিয়ে যাবে না। বরং এই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, তাঁদের কপালের কুঞ্চনরেখা ২ আগস্টের ঘটনায় আরও গভীর হওয়ার কথা। তবে যা ঘটল, তা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। বিএনপির আশঙ্কা ছিল, আমিনী নয়, বিষয়টি খালেদা জিয়াতে গড়াবে। এর আগে শেখ হাসিনাকে আপিল বিভাগ সতর্ক এবং ভর্ৎসনা করেছিলেন।
আদালত বলেছেন, ‘সার্বভৌমত্বের প্রতীক হচ্ছে সংবিধান। এ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আমিনীর বক্তব্যে পার্থক্য খুবই অল্প। আমিনীর বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহমূলক হলে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যও অনুরূপ। সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য আমরা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করব না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যা বলাবলি করে আসছিলেন, তার সঙ্গে এই অভিমতের মিল রয়েছে।
যে ধরনের আলাপ-আলোচনা ও বাকস্বাধীনতার অনুশীলন জাতীয় সংসদ, টিভি টক শো কিংবা জনপথে হতে পারে, ঠিক তেমনটা আমরা আদালতকক্ষে আশা করতে পারি না। কিন্তু ২ আগস্ট একটি আদালতকক্ষে যে ভাবগাম্ভীর্য, তার সওয়াল-জওয়াব যেভাবে আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা, তা ছিল না। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় যখন আদালতে শুনানির বিষয়বস্তু হয়, তখন আইনের নির্দিষ্ট বিধানাবলির সঙ্গে তর্কিত বিষয়ের বৈধতার প্রশ্ন অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।
বিষয়টি আদালতকক্ষে এসেছে এমন এক প্রেক্ষাপটে, যখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘৭ক’ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক। অর্ধডজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমাকে এর অন্তত অর্ধডজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এটুকু পরিষ্কার, বাকস্বাধীনতা হুমকিগ্রস্ত হয়েছে। এর অনেকখানি এখন সেডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ।
৭ক অনুচ্ছেদ বলেছে, কোনো ব্যক্তি ‘শক্তি প্রদর্শন’ বা ‘শক্তি প্রয়োগে’র মাধ্যমে বা ‘অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়’ ‘এই সংবিধান ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে, তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ শক্তি না খাটালেও চলবে, যাঁরাই কোনোভাবে সহযোগিতা বা উসকানি দেবেন, তাঁরাই দোষী হবেন এবং তাঁদের জন্যও ‘মৃত্যুদণ্ড’। লঘু পাপ বলে কিছু নেই, দোষী হলেই কেল্লা ফতে!
বেগম খালেদা জিয়া ১৩ জুলাই ‘এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার’ ঘোষণা দেন। আমিনী পরদিন বলেন, তিনি এই সংবিধানকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবেন। ২০ জুলাই শাহরিয়ার কবির রিট দায়ের করেন। তাঁর লিখিত দরখাস্তে শুধু আমিনী প্রসঙ্গ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করে তা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে একটি রাজনৈতিক বক্তব্যের জবাবে পাল্টা যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া উচিত, প্রধানমন্ত্রী সেটাই করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধান ছুড়ে ফেলা এবং সংবিধান ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা বাকস্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য কি না।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো ছাড়া আর কোনো অজুহাতে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। খালেদা-আমিনীর তর্কিত মন্তব্য তাই ওই আটটি বিষয়ের নিরিখে যাচাইযোগ্য। সে কারণেই সদ্য যুক্ত হওয়া ৭ক অনুচ্ছেদটির উল্লিখিত বয়ান ৩৯(২)এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এবং এই মামলাতেই তা অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার আইনি দরজা খোলা আছে। আদালতে হাতাহাতিতে অংশ না নিয়ে আইনজীবীরা এ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন জানলে খুশি হতাম।
সংবিধান ছুড়ে ফেলার বক্তব্য ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘শালীনতা’ বা ‘নৈতিকতা’র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য হতে পারে। তাঁরা শুধু নাগরিক নন, নেতা। তাঁদের ওই উক্তি অবশ্যই দায়িত্বশীল, শালীন বা নৈতিক নয়। এখানেও ফাঁক আছে। ওই বিষয়গুলোর সীমারেখা ঠিক করার কোনো আইন আছে বলে জানি না। আমাদের বক্তৃতাবাজ নেতা-নেত্রীরা এ রকম সাপ-লুডু না খেলে পারলে আইন করুন।
আমরা বুঝতে অক্ষম, রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার কোন আইনে কোন আদালতে কীভাবে হবে। এ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা রীতিমতো ভয়াবহ। যত মাথা তত ব্যাখ্যা। এমনই অদ্ভুত এক অনাসৃষ্টি এই ৭ক অনুচ্ছেদটি। ড. কামাল হোসেন এই সংবিধানের সমালোচনা করবেনই। তিনি ফাঁসিতে ঝোলার পরোয়া করবেন না।
সংসদের আইন ও বিচারবিষয়ক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে বললাম, ৭ক অনুচ্ছেদের ওই অংশ কী উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে, তা জাতীয় সংসদে আলোচিত হয়নি। আইনমন্ত্রী কোথাও তা বলেননি। আমরা জানতাম, শুধু সামরিক শাসন ঠেকাতেই ৭ক যুক্ত হচ্ছে। তাহলে একই অনুচ্ছেদে এসব কথাবার্তা ঢোকানো হলো কেন? ওই প্রবীণ সাংসদ জবাব দিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলার মতো উক্তি শায়েস্তা করতেই ওই অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ঢাকার একটি আদালতে আমিনীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়েরের চেষ্টা হয়েছে। দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারায় নাকি অভিযোগ আনা হয়েছে। নিম্ন আদালত ঠিকই বলেছেন, এর জন্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। তিনি তাই মামলাটি লালবাগ থানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা গণ-অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করতে পারে—এরূপ কথা বলা বা লেখাই ১২৪ক দণ্ডনীয় করেছে। এই ধারামতে আমিনী বা খালেদা দেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, তাঁদের আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগকে কোনোভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তাই হাইকোর্টের উচ্চারিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ কি দণ্ডবিধির ১২৪ক নাকি সংবিধানের ৭ক-তে পড়বে? একই অপরাধের দুই রকম শাস্তি। দণ্ডবিধিতে যাবজ্জীবন, সংবিধানে মৃত্যুদণ্ড। এত তর্ক-বিতর্ক কিন্তু আমরা এখনো বুঝলাম না, খালেদা-আমিনী কোন আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন করলেন? তাঁদের শাস্তি কি হবে? আশায় আছি, মামলার ভবিষ্যৎ শুনানিতে এসব আইনি প্রসঙ্গ আসবে।
শাহরিয়ার কবির গতকাল বৃহস্পতিবার আমাকে বলেন, ৭ক নয়, ১২৪ক ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করে তিনি মামলা করেছেন। আগেই বলেছি, এটা ১২৪ক ধারায় বিচার্য হওয়ার নয়। তবে তাঁর সঙ্গে আমরা একমত যে এই মামলা সূত্রে সংবিধান সুরক্ষা নিয়ে বিদ্যমান আইনে যে ঘাটতি বা অস্পষ্টতা, তা দূর করার সুযোগ আছে। দেশে এখন এমন একটি গ্যাঁড়াকল বিরাজমান, যখন রাষ্ট্রদ্রোহ কী এবং এর শাস্তি কী এবং কোন আদালতে এর বিচার হবে, তা স্পষ্ট নয়। জনাব কবির জানিয়েছেন, পতাকা ও সংবিধান পোড়ানো প্রসঙ্গে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের আলোকে তিনি সংবিধান সুরক্ষার দিকটি আদালতের শুনানিতে তুলে ধরবেন। আমরা সে জন্য অপেক্ষায় থাকব।
যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ানোর ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত। টেক্সাসের বাসিন্দা জনসন ১৯৮৯ সালে প্রতিবাদ করে মার্কিন পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। নিম্ন আদালত তাঁকে দণ্ড দেন। তিনি তাঁর অঙ্গরাজ্যের উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলে ওই দণ্ড বাতিল হয়। শেষ পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে দণ্ড বাতিলের সিদ্ধান্তই সমুন্নত রাখেন। ৫: ৪ ভোটে রায় স্থির হয়।
চার বিচারক কিন্তু ‘জাতীয় পতাকা যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করেই জনসনের দণ্ড বজায় রাখেন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতটিই গত ২২ বছরেও টিকে গেছে। যাঁরা পতাকা পোড়ানোকে দণ্ডযোগ্য মনে করেছিলেন, তাঁদের ঠাঁই মোটামুটি রক্ষণশীল শিবিরে। একজন প্রবীণ সাবেক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পতাকা পোড়ানোর মামলাটি নিয়ে আলোচনা হলো। তিনি মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতটির সমর্থক। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যালঘু অভিমতের অন্যতম বিচারক ছিলেন বিচারপতি রেনকোয়েস্ট। রক্ষণশীল। নিক্সন তাঁকে বিচারক মনোনয়ন দেন। রিপাবলিকানরাই তাঁকে প্রধান বিচারপতি করেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রদায়ক ক্যারল অ্যান ব্যাসট ঢাকায় আমাকে বলেছিলেন, রেনকোয়েস্ট তরুণ বয়সেই রিপাবলিকান কর্মী হিসেবে ভোটারদের অন্যায়ভাবে ভোটকেন্দ্রে বাধা দিয়েছিলেন। মিজ ক্যারল বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। শুনানিতে রেনকোয়েস্ট তাঁর আচরণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। যা হোক, বিচারপতি রেনকোয়েস্টও মার্কিন পতাকাকে সার্বভৌমত্বের প্রতীক মনে করেন। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি জানালেন, রেনকোয়েস্টের সঙ্গে একদা আমাদের আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তিনি তাঁকে বলে এসেছেন যে পতাকা পোড়ানোকে তিনি বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধ বলেই মনে করেন। এবং তিনি রেনকোয়েস্টের ওই রায়ের একজন অনুরাগী।
তবে আমরা যেটা দেখব, এ পর্যন্ত মার্কিন সংবিধানে একটি সংশোধনী আনার চেষ্টা তিনবার বিফলে গেছে। ১৯৮৯ সালের রায়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয় থাকার আইন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ২০০৬-এ পতাকা পোড়ানো বাকস্বাধীনতার অংশ, সেটা আরও একবার প্রতিষ্ঠিত হয়। রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা কংগ্রেস যাতে পতাকা পোড়ানো নিষিদ্ধ করতে পারে, সে রকমের একটি সংবিধান সংশোধনী বিল সিনেটে এনেছিল। ৬৬-৩৪ ভোটে বিল পাসের ওই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে ইতিহাসের পাতা ওল্টায়নি। ৬৭ ভোটের দরকার ছিল। পতাকা পোড়ানোর মামলাটি সুপ্রিম কোর্টেও মাত্র এক ভোটের ব্যবধানেই টিকেছিল।
উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা কিন্তু রিপাবলিকানদের কঠোর সমালোচনা করেন এই বলে যে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকতে তাঁরা ভর করেন পতাকার মর্যাদা রক্ষায়। আমরাও দেখি, আমাদের উদারনৈতিক বন্ধুরা প্রকারান্তরে বাকস্বাধীনতা সংকুচিত করছেন। খালেদা-আমিনীর মন্তব্য অশালীন ও অনৈতিক, কিন্তু তা দণ্ডনীয় নয়। মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ বলা আরও হাস্যকর। বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহারের মামলার শুনানি চলছিল। এ সময় বিবাদীপক্ষের ‘দেশপ্রেম’ কিংবা ‘স্বাধীনতায় বিশ্বাস না থাকা’ মর্মে আদালতের কোনো দ্ব্যর্থক ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য পূর্বধারণাপ্রসূত (প্রেজুডিশিয়াল) বলে প্রতীয়মান হতে পারে। ‘সহ্য করব না’ ধরনের উক্তির কোনো আইনি নজির নেই।
প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্যাট্রিক লেহি বলেছিলেন, তাঁরা পতাকাকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করছেন। বিলের সমর্থকেরা রাজনৈতিক মতলব সাধনে জনগণের অনুভূতিকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বে এমন বহু দেশ আছে, যারা পতাকা পোড়ানোকে নির্দিষ্টভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আবার নরওয়ের মতো অনেক দেশ পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয় থাকার প্রচলিত আইন রহিত করেছে। তারা পতাকা পোড়ানোয় বাকস্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। চীন ও ভারতে পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয়। বাংলাদেশে দণ্ডযোগ্য ছিল বাহাত্তরেই। পতাকার অবমাননার ঘটনায় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল সরকার। গত বছর তারা খুঁজে দেখে, ওই আইনে বলা ছিল, কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে হবে বিধি দিয়ে। সেই বিধি কখনো করা হয়নি। এখন নতুন বিধি হয়েছে। ৭ক অনুচ্ছেদটি আমাদের কাছে তেমনই এক বিভ্রান্তি। এর আওতায় কোনো অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে শাস্তি দেওয়া যাবে, সেটা আমরা ভাবতে পারি না। এ ধরনের বিচারের উদ্যোগ খাবি খাবে। জেনারেল এরশাদরা নৃত্য করে পার পাবেন।
সংবিধান পোড়ানোর গল্প দিয়ে শেষ করি। সেটা ছিল আমেরিকার রমরমা দাসপ্রথার যুগ। ৪ জুলাই ১৮৪৪। ক্রীতদাস প্রথাবিরোধী বিপ্লবী সাংবাদিক উইলিয়াম লয়েড গেরিসন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ফ্রেমিংহাম শহরে প্রকাশ্যে সংবিধানের একটি কপি পুড়িয়েছিলেন। সংবিধানে তখন ক্রীতদাস প্রথা-সমর্থক বিধান ছিল। তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এ জন্য ১৬৭ বছর আগের আমেরিকায়ও সংবিধান পোড়ানোর জন্য গেরিসনকে শাস্তি পেতে হয়নি। ইতিহাস বরং সাক্ষ্য দিচ্ছে, গেরিসনের সেই ভূমিকা নন্দিত হয়েছে। সংবিধানকে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর সঙ্গে দাসখত’, ‘নরকের সঙ্গে বোঝাপড়া’ এবং ‘মিথ্যার আধার’।
তবে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার সঙ্গে মহত্তম কিছু থাকার সম্পর্ক ক্ষীণ। এই ঘটনায় প্রমাণিত, উভয় পক্ষই গণতন্ত্র ও সংবিধানতন্ত্রে অবিশ্বাসী।আমরা অবিলম্বে ৭ক অনুচ্ছেদের বাকস্বাধীনতাবিনাশী অংশের বিলোপ চাই। এই বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় যাতে না জন্মায়, সে জন্য আমরা জনমত গড়ে তুলতে চাই। আদালতকক্ষ শুধু আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও এর প্রাসঙ্গিক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার স্থান হয়ে উঠুক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আদালত বলেছেন, ‘সার্বভৌমত্বের প্রতীক হচ্ছে সংবিধান। এ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আমিনীর বক্তব্যে পার্থক্য খুবই অল্প। আমিনীর বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহমূলক হলে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যও অনুরূপ। সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য আমরা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করব না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যা বলাবলি করে আসছিলেন, তার সঙ্গে এই অভিমতের মিল রয়েছে।
যে ধরনের আলাপ-আলোচনা ও বাকস্বাধীনতার অনুশীলন জাতীয় সংসদ, টিভি টক শো কিংবা জনপথে হতে পারে, ঠিক তেমনটা আমরা আদালতকক্ষে আশা করতে পারি না। কিন্তু ২ আগস্ট একটি আদালতকক্ষে যে ভাবগাম্ভীর্য, তার সওয়াল-জওয়াব যেভাবে আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা, তা ছিল না। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয় যখন আদালতে শুনানির বিষয়বস্তু হয়, তখন আইনের নির্দিষ্ট বিধানাবলির সঙ্গে তর্কিত বিষয়ের বৈধতার প্রশ্ন অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।
বিষয়টি আদালতকক্ষে এসেছে এমন এক প্রেক্ষাপটে, যখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘৭ক’ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক। অর্ধডজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমাকে এর অন্তত অর্ধডজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এটুকু পরিষ্কার, বাকস্বাধীনতা হুমকিগ্রস্ত হয়েছে। এর অনেকখানি এখন সেডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ।
৭ক অনুচ্ছেদ বলেছে, কোনো ব্যক্তি ‘শক্তি প্রদর্শন’ বা ‘শক্তি প্রয়োগে’র মাধ্যমে বা ‘অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়’ ‘এই সংবিধান ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে, তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ শক্তি না খাটালেও চলবে, যাঁরাই কোনোভাবে সহযোগিতা বা উসকানি দেবেন, তাঁরাই দোষী হবেন এবং তাঁদের জন্যও ‘মৃত্যুদণ্ড’। লঘু পাপ বলে কিছু নেই, দোষী হলেই কেল্লা ফতে!
বেগম খালেদা জিয়া ১৩ জুলাই ‘এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার’ ঘোষণা দেন। আমিনী পরদিন বলেন, তিনি এই সংবিধানকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবেন। ২০ জুলাই শাহরিয়ার কবির রিট দায়ের করেন। তাঁর লিখিত দরখাস্তে শুধু আমিনী প্রসঙ্গ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করে তা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে একটি রাজনৈতিক বক্তব্যের জবাবে পাল্টা যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া উচিত, প্রধানমন্ত্রী সেটাই করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধান ছুড়ে ফেলা এবং সংবিধান ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা বাকস্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য কি না।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো ছাড়া আর কোনো অজুহাতে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। খালেদা-আমিনীর তর্কিত মন্তব্য তাই ওই আটটি বিষয়ের নিরিখে যাচাইযোগ্য। সে কারণেই সদ্য যুক্ত হওয়া ৭ক অনুচ্ছেদটির উল্লিখিত বয়ান ৩৯(২)এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এবং এই মামলাতেই তা অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার আইনি দরজা খোলা আছে। আদালতে হাতাহাতিতে অংশ না নিয়ে আইনজীবীরা এ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন জানলে খুশি হতাম।
সংবিধান ছুড়ে ফেলার বক্তব্য ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘শালীনতা’ বা ‘নৈতিকতা’র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য হতে পারে। তাঁরা শুধু নাগরিক নন, নেতা। তাঁদের ওই উক্তি অবশ্যই দায়িত্বশীল, শালীন বা নৈতিক নয়। এখানেও ফাঁক আছে। ওই বিষয়গুলোর সীমারেখা ঠিক করার কোনো আইন আছে বলে জানি না। আমাদের বক্তৃতাবাজ নেতা-নেত্রীরা এ রকম সাপ-লুডু না খেলে পারলে আইন করুন।
আমরা বুঝতে অক্ষম, রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার কোন আইনে কোন আদালতে কীভাবে হবে। এ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা রীতিমতো ভয়াবহ। যত মাথা তত ব্যাখ্যা। এমনই অদ্ভুত এক অনাসৃষ্টি এই ৭ক অনুচ্ছেদটি। ড. কামাল হোসেন এই সংবিধানের সমালোচনা করবেনই। তিনি ফাঁসিতে ঝোলার পরোয়া করবেন না।
সংসদের আইন ও বিচারবিষয়ক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে বললাম, ৭ক অনুচ্ছেদের ওই অংশ কী উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে, তা জাতীয় সংসদে আলোচিত হয়নি। আইনমন্ত্রী কোথাও তা বলেননি। আমরা জানতাম, শুধু সামরিক শাসন ঠেকাতেই ৭ক যুক্ত হচ্ছে। তাহলে একই অনুচ্ছেদে এসব কথাবার্তা ঢোকানো হলো কেন? ওই প্রবীণ সাংসদ জবাব দিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলার মতো উক্তি শায়েস্তা করতেই ওই অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ঢাকার একটি আদালতে আমিনীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়েরের চেষ্টা হয়েছে। দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারায় নাকি অভিযোগ আনা হয়েছে। নিম্ন আদালত ঠিকই বলেছেন, এর জন্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। তিনি তাই মামলাটি লালবাগ থানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা গণ-অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করতে পারে—এরূপ কথা বলা বা লেখাই ১২৪ক দণ্ডনীয় করেছে। এই ধারামতে আমিনী বা খালেদা দেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, তাঁদের আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগকে কোনোভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তাই হাইকোর্টের উচ্চারিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ কি দণ্ডবিধির ১২৪ক নাকি সংবিধানের ৭ক-তে পড়বে? একই অপরাধের দুই রকম শাস্তি। দণ্ডবিধিতে যাবজ্জীবন, সংবিধানে মৃত্যুদণ্ড। এত তর্ক-বিতর্ক কিন্তু আমরা এখনো বুঝলাম না, খালেদা-আমিনী কোন আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন করলেন? তাঁদের শাস্তি কি হবে? আশায় আছি, মামলার ভবিষ্যৎ শুনানিতে এসব আইনি প্রসঙ্গ আসবে।
শাহরিয়ার কবির গতকাল বৃহস্পতিবার আমাকে বলেন, ৭ক নয়, ১২৪ক ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করে তিনি মামলা করেছেন। আগেই বলেছি, এটা ১২৪ক ধারায় বিচার্য হওয়ার নয়। তবে তাঁর সঙ্গে আমরা একমত যে এই মামলা সূত্রে সংবিধান সুরক্ষা নিয়ে বিদ্যমান আইনে যে ঘাটতি বা অস্পষ্টতা, তা দূর করার সুযোগ আছে। দেশে এখন এমন একটি গ্যাঁড়াকল বিরাজমান, যখন রাষ্ট্রদ্রোহ কী এবং এর শাস্তি কী এবং কোন আদালতে এর বিচার হবে, তা স্পষ্ট নয়। জনাব কবির জানিয়েছেন, পতাকা ও সংবিধান পোড়ানো প্রসঙ্গে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের আলোকে তিনি সংবিধান সুরক্ষার দিকটি আদালতের শুনানিতে তুলে ধরবেন। আমরা সে জন্য অপেক্ষায় থাকব।
যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ানোর ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত। টেক্সাসের বাসিন্দা জনসন ১৯৮৯ সালে প্রতিবাদ করে মার্কিন পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। নিম্ন আদালত তাঁকে দণ্ড দেন। তিনি তাঁর অঙ্গরাজ্যের উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলে ওই দণ্ড বাতিল হয়। শেষ পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে দণ্ড বাতিলের সিদ্ধান্তই সমুন্নত রাখেন। ৫: ৪ ভোটে রায় স্থির হয়।
চার বিচারক কিন্তু ‘জাতীয় পতাকা যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করেই জনসনের দণ্ড বজায় রাখেন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতটিই গত ২২ বছরেও টিকে গেছে। যাঁরা পতাকা পোড়ানোকে দণ্ডযোগ্য মনে করেছিলেন, তাঁদের ঠাঁই মোটামুটি রক্ষণশীল শিবিরে। একজন প্রবীণ সাবেক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পতাকা পোড়ানোর মামলাটি নিয়ে আলোচনা হলো। তিনি মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতটির সমর্থক। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যালঘু অভিমতের অন্যতম বিচারক ছিলেন বিচারপতি রেনকোয়েস্ট। রক্ষণশীল। নিক্সন তাঁকে বিচারক মনোনয়ন দেন। রিপাবলিকানরাই তাঁকে প্রধান বিচারপতি করেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রদায়ক ক্যারল অ্যান ব্যাসট ঢাকায় আমাকে বলেছিলেন, রেনকোয়েস্ট তরুণ বয়সেই রিপাবলিকান কর্মী হিসেবে ভোটারদের অন্যায়ভাবে ভোটকেন্দ্রে বাধা দিয়েছিলেন। মিজ ক্যারল বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। শুনানিতে রেনকোয়েস্ট তাঁর আচরণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। যা হোক, বিচারপতি রেনকোয়েস্টও মার্কিন পতাকাকে সার্বভৌমত্বের প্রতীক মনে করেন। আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি জানালেন, রেনকোয়েস্টের সঙ্গে একদা আমাদের আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তিনি তাঁকে বলে এসেছেন যে পতাকা পোড়ানোকে তিনি বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধ বলেই মনে করেন। এবং তিনি রেনকোয়েস্টের ওই রায়ের একজন অনুরাগী।
তবে আমরা যেটা দেখব, এ পর্যন্ত মার্কিন সংবিধানে একটি সংশোধনী আনার চেষ্টা তিনবার বিফলে গেছে। ১৯৮৯ সালের রায়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয় থাকার আইন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ২০০৬-এ পতাকা পোড়ানো বাকস্বাধীনতার অংশ, সেটা আরও একবার প্রতিষ্ঠিত হয়। রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা কংগ্রেস যাতে পতাকা পোড়ানো নিষিদ্ধ করতে পারে, সে রকমের একটি সংবিধান সংশোধনী বিল সিনেটে এনেছিল। ৬৬-৩৪ ভোটে বিল পাসের ওই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে ইতিহাসের পাতা ওল্টায়নি। ৬৭ ভোটের দরকার ছিল। পতাকা পোড়ানোর মামলাটি সুপ্রিম কোর্টেও মাত্র এক ভোটের ব্যবধানেই টিকেছিল।
উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা কিন্তু রিপাবলিকানদের কঠোর সমালোচনা করেন এই বলে যে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকতে তাঁরা ভর করেন পতাকার মর্যাদা রক্ষায়। আমরাও দেখি, আমাদের উদারনৈতিক বন্ধুরা প্রকারান্তরে বাকস্বাধীনতা সংকুচিত করছেন। খালেদা-আমিনীর মন্তব্য অশালীন ও অনৈতিক, কিন্তু তা দণ্ডনীয় নয়। মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ বলা আরও হাস্যকর। বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহারের মামলার শুনানি চলছিল। এ সময় বিবাদীপক্ষের ‘দেশপ্রেম’ কিংবা ‘স্বাধীনতায় বিশ্বাস না থাকা’ মর্মে আদালতের কোনো দ্ব্যর্থক ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য পূর্বধারণাপ্রসূত (প্রেজুডিশিয়াল) বলে প্রতীয়মান হতে পারে। ‘সহ্য করব না’ ধরনের উক্তির কোনো আইনি নজির নেই।
প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্যাট্রিক লেহি বলেছিলেন, তাঁরা পতাকাকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করছেন। বিলের সমর্থকেরা রাজনৈতিক মতলব সাধনে জনগণের অনুভূতিকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বে এমন বহু দেশ আছে, যারা পতাকা পোড়ানোকে নির্দিষ্টভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আবার নরওয়ের মতো অনেক দেশ পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয় থাকার প্রচলিত আইন রহিত করেছে। তারা পতাকা পোড়ানোয় বাকস্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। চীন ও ভারতে পতাকা পোড়ানো দণ্ডনীয়। বাংলাদেশে দণ্ডযোগ্য ছিল বাহাত্তরেই। পতাকার অবমাননার ঘটনায় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল সরকার। গত বছর তারা খুঁজে দেখে, ওই আইনে বলা ছিল, কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে হবে বিধি দিয়ে। সেই বিধি কখনো করা হয়নি। এখন নতুন বিধি হয়েছে। ৭ক অনুচ্ছেদটি আমাদের কাছে তেমনই এক বিভ্রান্তি। এর আওতায় কোনো অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে শাস্তি দেওয়া যাবে, সেটা আমরা ভাবতে পারি না। এ ধরনের বিচারের উদ্যোগ খাবি খাবে। জেনারেল এরশাদরা নৃত্য করে পার পাবেন।
সংবিধান পোড়ানোর গল্প দিয়ে শেষ করি। সেটা ছিল আমেরিকার রমরমা দাসপ্রথার যুগ। ৪ জুলাই ১৮৪৪। ক্রীতদাস প্রথাবিরোধী বিপ্লবী সাংবাদিক উইলিয়াম লয়েড গেরিসন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ফ্রেমিংহাম শহরে প্রকাশ্যে সংবিধানের একটি কপি পুড়িয়েছিলেন। সংবিধানে তখন ক্রীতদাস প্রথা-সমর্থক বিধান ছিল। তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এ জন্য ১৬৭ বছর আগের আমেরিকায়ও সংবিধান পোড়ানোর জন্য গেরিসনকে শাস্তি পেতে হয়নি। ইতিহাস বরং সাক্ষ্য দিচ্ছে, গেরিসনের সেই ভূমিকা নন্দিত হয়েছে। সংবিধানকে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর সঙ্গে দাসখত’, ‘নরকের সঙ্গে বোঝাপড়া’ এবং ‘মিথ্যার আধার’।
তবে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার সঙ্গে মহত্তম কিছু থাকার সম্পর্ক ক্ষীণ। এই ঘটনায় প্রমাণিত, উভয় পক্ষই গণতন্ত্র ও সংবিধানতন্ত্রে অবিশ্বাসী।আমরা অবিলম্বে ৭ক অনুচ্ছেদের বাকস্বাধীনতাবিনাশী অংশের বিলোপ চাই। এই বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় যাতে না জন্মায়, সে জন্য আমরা জনমত গড়ে তুলতে চাই। আদালতকক্ষ শুধু আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও এর প্রাসঙ্গিক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার স্থান হয়ে উঠুক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments