কালের পুরাণ-ওসির চাপাতি, কাদেরের কান্না ও মন্ত্রীর উপদেশ by সোহরাব হাসান

আমরা এক আজব দেশে বাস করছি, যার নাম—বাংলাদেশ। এখানে রাজনীতিকেরা মানুষ নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁদের ভোটে ক্ষমতায় আসেন, মন্ত্রী-এমপি হন; কিন্তু গদিতে বসলেই আমজনতার কথা ভুলে যান। তাদের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও বঞ্চনা রাজনীতিকদের সামান্য বিচলিত করে বলে মনে হয় না; করলে রোজার শুরুতে এই ঢাকা শহরে মানুষের জীবন যে


বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে অতিষ্ঠ, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে দেশবাসী দিশেহারা, তা নিয়ে কিছুটা হলেও তাঁরা উদ্বিগ্ন থাকতেন। বিপন্ন, বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।
রোজার আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান আমাদের অনেক মিষ্টি কথা শুনিয়েছেন, রোজায় কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এখন ব্যবসায়ীদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেই মানুষ যদি হয় সাধারণ মেহনতি মানুষ, নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ, বলব, তারা তো সারা বছরই কম খায়, কম খেতে বাধ্য থাকে। আর যদি কথাটি তিনি ভদ্রলোক, ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিকসহ সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর উদ্দেশে বলে থাকেন, তাঁরা কোনো দিনই তা আমলে নেবেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওয়াদা করেও ব্যবসায়ীরা ওয়াদা রাখেননি। ব্যবসায়ীরা সরকারের দুর্বলতা জানেন। তারা এ-ও জানেন, মন্ত্রীরা যতই হুমকি-ধমকি দিন না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কেননা ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের হাত-পা বাঁধা আছে অথবা যাঁরা মন্ত্রী তাঁরা ব্যবসায়ীও বটে। সে ক্ষেত্রে স্বার্থটা অভিন্ন।
অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত মূল্যস্ফীতির হিসাব করেন বছরওয়ারি। এক বছরে জিনিসপত্রের দাম কত ভাগ বেড়েছে, তার ভিত্তিতে। কিন্তু এখন আমাদের হিসাব করতে হচ্ছে, গত মাসের সঙ্গে এ মাসের, গত সপ্তাহের সঙ্গে চলতি সপ্তাহের। কখনো বা গতকালের সঙ্গে আজকের হিসাবও মেলানো যাচ্ছে না।
জুলাই মাসের বাজারদরের সঙ্গে চলতি মাসের একটি তুলনামূলক হিসাব দিয়েছে প্রথম আলো ৪ আগস্ট। তাতে দেখা যায়, জুলাইয়ে ৬৫ টাকার ছোলার দাম কেজিপ্রতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ টাকায়; ৫০ টাকার কাঁচা মরিচ ১০০, ৩৫ টাকার বেগুন ৪৫, ৩৩ টাকার পেঁয়াজ ৪০, ২৫ টাকার শসা ৪৫ এবং ৩২ টাকার করলা ৪০ টাকায়। চিনির দাম কয়েক দফা বাড়িয়ে সরকার কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা ঠিক করেছে। কিন্তু কোনো দোকানে ৬৫ টাকায় পাওয়া যায় না। বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। এই হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আগামী বছর নাগাদ মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে তিন অঙ্কে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ শতভাগ বৃদ্ধি।
দেশের সাধারণ মানুষ যে কষ্টে আছে, আধপেটা খেয়ে আছে, দুই বেলার জায়গায় এক বেলা খাচ্ছে, সে খবর আমাদের জনদরদি রাজনীতিকেরা রাখেন না। রাখলে ফালতু সব বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন না। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের ব্যর্থতা, দুর্বলতা তুলে ধরে বিরোধী দল; তারা দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ায়, তাদের হয়ে প্রতিবাদ করে, লড়াই করে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের মতো বিরোধী দল নিজের স্বার্থ, দলের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।
হ্যাঁ, তাঁরা প্রতিবাদ করে সভা-সমাবেশে গরম বক্তব্য দেন; কিন্তু সেটি জনগণের স্বার্থ আদায়ে নয়, মামলা থেকে বাঁচতে। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার পথ নির্বিঘ্ন করতে। টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা প্রায় প্রতিদিনই দেখছি ঢাকা শহরের কোনো না কোনো স্থানে পানির তীব্র সংকট, নারী-পুরুষ পানির জন্য কলের সামনে লাইন দিয়ে আছে, বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করছে। কিন্তু কোথাও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি।
আর যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, যাঁরা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, তাঁরা মনে করছেন, জনগণ দেশটাকে তাঁদের কাছে পাঁচ বছর নয়; ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছে। অতএব জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে, তাদের কষ্ট লাঘবে কিছু করার প্রয়োজন নেই। তাঁরা যা করবেন, জনগণ তা মেনে নিতে বাধ্য। তাঁদের কাজের কোনো সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা করলেই সংবিধান অবমাননা হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ হবে। ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু নিজ দলের মাস্তান, সন্ত্রাসী, গডফাদারদের সম্পর্কে কিছু বলেন না। লক্ষ্মীপুরে তাহের বাহিনী আগে কী করেছে, এখন কী করছে, তা কারও অজানা নয়। আওয়ামী লীগের নেতা আবু তাহেরের বাড়ির সামনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলা হলো। কিন্তু পুলিশ নির্বিকার। উচ্চ আদালতে যেসব আইনজীবী গোলমাল করেছেন, তাঁদের শাস্তি হয়েছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলাকারীরা ধরা পড়ে না। আইন একপেশে, বিচার পক্ষপাতমূলক।
এই যে সরকার ও বিরোধী দল সংবিধান নিয়ে অনন্ত বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে জনগণের কী লাভ হলো? পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর কি পণ্যের দাম কমেছে? দেশে চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি বন্ধ হয়েছে? পুলিশের দৌরাত্ম্য কি সামান্য হ্রাস পেয়েছে? মানবাধিকার সমুন্নত হয়েছে? হয়নি। তাহলে সবকিছুতে সংবিধানের দোহাই দেওয়া কেন?

২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদেরের একটি ছবি ছাপা হয়েছে ৪ আগস্ট প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে বেরিয়ে আসছেন। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। পায়ে এখনো সাদা ব্যান্ডেজ। অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারছেন না। কী উদাস ও করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন! কাদের এখনো সুস্থ নন; জামিন পাওয়ার পর তাঁকে অর্থোপেডিক্স বিভাগে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু তিনি জানেন না বিভাগটি কোথায়। এই ব্লক, ওই ব্লক ঘুরে স্বজনের সহায়তায় সেখানে পৌঁছান। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র প্রাণবন্ত কাদেরের তো হাসপাতালে থাকার কথা নয়। হলে তাঁর নিজের কক্ষে থেকে পড়াশোনা করবেন; অথবা বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাবেন।
পুলিশ কাদেরের বিরুদ্ধে ডাকাতি, গাড়ি ছিনতাই ও অস্ত্র আইনে মামলা করেছে। কিন্তু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী কোনোটির সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার প্রমাণ পওয়া যায়নি (প্রথম আলো, ৪ আগস্ট, ২০১১)। তিনি পরিস্থিতির শিকার। ১৫ জুলাই রাতে যে মুহূর্তে খিলগাঁও থানার পুলিশের ধাওয়া করা গাড়িটি সেগুনবাগিচার দুদক অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে কাদেরও রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে হলে ফিরছিলেন। আর যায় কোথায়! পুলিশ তাঁকে পাকড়াও করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিলাল উদ্দীন কাদেরের পায়ে কুপিয়ে কুপিয়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করেছেন! এই বর্বর ও অমানবিক আচরণের পরও এই লোকটি পুলিশ বিভাগে কী করে থাকেন? এই প্রশ্নটি আমরা আইজিপির কাছে রাখলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে রাখলাম, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখলাম। আমাদের অতি দক্ষ পুলিশ বাহিনী প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে না পারলেও নিরীহ মানুষকে ধরে পঙ্গু করে দিতে পারে। সম্প্রতি আমিনবাজারে ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায়ও তাই ঘটেছে। পুলিশ হত্যাকারীদের ধরতে পারেনি। ছয় ছাত্রের বিরুদ্ধে মনগড়া ডাকাতির মামলা দিয়েছে।
প্রিজন সেল থেকে বেরিয়ে এসে কাদের বলেছিলেন, ‘আমি নির্দোষ, যারা আমার মতো অসহায়ের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে, তাদের বিচার চাই। আমি সরকারের কাছে বিচারের দাবি জানাই।’ তাঁর ওপর পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এখনো হাসপাতালের শয্যায় বসে কাঁদছেন। তিনি পুলিশের কাছে বারবার তাঁর পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ডাকাত নই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’ পুলিশের সন্দেহ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে পারত, হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারত। কিন্তু সেসব না করে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁর পায়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করছিলেন! একজন পুলিশ কর্মকর্তা এতটা নির্মম, এতটা বিকৃত রুচির মানুষ হতে পারেন? প্রধানমন্ত্রীও একজন মা। কাদেরের কান্না, তাঁর মা ও বোনের আহাজারি কি তাঁর কানে পৌঁছাবে না?
কাদের তাঁর ওপর পুলিশের নির্যাতনের বিচার চেয়েছেন। তাঁর সহপাঠীরা পুলিশের তদন্ত সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার পরও বলব, তদন্তে যদি প্রমাণ হয় কাদের অপরাধী, দেশের আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার হবে। কিন্তু অপরাধ প্রমাণের আগেই যে পুলিশ কর্মকর্তা সন্দেহবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে এভাবে পঙ্গু করে দিলেন, তাঁর বিচার করবে কে? পুলিশ কর্মকর্তা কাদেরের পায়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করছেন। আমরা সরকারকে আইনের ধার পরীক্ষা করতে বলব। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো কাদের পঙ্গু না হন, কোনো লিমন পা না হারান—সেই নিশ্চয়তা চাই।
কাদের দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক এবং স্বাভাবিক জীবন ও পড়াশোনায় ফিরে আসুক—এটাই প্রার্থনা করি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.