মহান মে দিবস

১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কস নামের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনরত শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রক্তদানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল এক নতুন ইতিহাসের। সমগ্র বিশ্বে দিনটি মে দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিক শ্রেণী যেকোনো দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ,


যারা শুধু উৎপাদনব্যবস্থারই প্রধান শক্তি নয়, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বে এখনো শ্রমিকদের নানামুখী বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে এবং বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। জন্মলগ্ন থেকে আইএলও এ পর্যন্ত প্রায় ১৮৯টি সাধারণ কনভেনশন এবং আটটি কোর কনভেনশন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ৩৩টি সাধারণ ও সাতটি কোর কনভেনশন স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। আইএলও সৃষ্টিলগ্ন থেকেই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী মেহনতি মানুষের ঐক্য, অধিকার রক্ষা, আর্থসামাজিক মুক্তি ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দেশে শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও তাদের জন্য ন্যায়সংগত করণীয় আরো অনেক কিছু বাকি। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়, তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বেসরকারি পর্যায়ে তিন থেকে চার লাখ, আত্মকর্মসংস্থানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার এবং প্রবাসে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ও অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করাটা আমাদের সার্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। উল্লেখ্য, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয় সমাজের হতদরিদ্র, অদক্ষ, অসহায়দের। সরকারি খাতে কর্মসংস্থান হয় সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিতদের। মানবসভ্যতার চাকা এগিয়েছে শ্রমদানকারী শক্তির শ্রম, ঘাম আর রক্তের ওপর দিয়ে। এই প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিক অবশ্যই মূল্যায়িত হবে তার অবস্থান থেকেই। সুস্থ রাজনীতি যেমন একটি দেশের জন্য অপরিহার্য, তেমনি সুস্থ ট্রেড ইউনিয়নও জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক যে বেশির ভাগ ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের বিরুদ্ধে অহরহই বিস্তর অভিযোগ ওঠে; যা সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকড় উৎপাটন খুবই দরকার।
বৈষম্য হ্রাস করে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষার বিষয়ে সরকারসহ সব সামাজিক শক্তিকে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। শিল্পের মালিকদেরও হতে হবে আরো মানবিক। তাদের মানবিকতা শুধু শ্রমিককে তার কাজে অধিক উদ্বুদ্ধই করবে না এর বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব রাষ্ট্রেও পড়বে। শ্রমিক-মালিক কিংবা সরকার মিলিতভাবেই সমৃদ্ধির চিত্র উত্তরোত্তর পুষ্ট করতে পারে সবার সদিচ্ছা পোষণের মধ্য দিয়ে। শ্রম আইনের সংশোধন করে শ্রমনীতি আরো স্পষ্ট করতে হবে। ১৯৭২ সালে প্রথম ও ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় শ্রমনীতি ঘোষিত হয়, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী করা দরকার। তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ। মহান মে দিবসের শিক্ষা শুধু শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শানিত করতে শুধু অঙ্গীকার নয়, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় আর্থসামাজিক মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.