চরাচর-লাল ও সবুজের মাস by ফখরে আলম

লাল ঝাণ্ডা, লাল রক্ত_সবই মে মাসের। আবার সবুজও মে মাসের। মে মাসে সবুজ হেসে ওঠে। প্রকৃতির যে ঔদার্য তা মে মাসেই ছড়িয়ে যেতে দেখা যায়। নতুন সবুজে সেজে মানুষ তার আগামী নির্মাণের স্বপ্ন দেখে। প্রাচীন ইউরোপের সর্বজনীন মহা উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে মে মাসকে ঘিরেই।


মে মাসের প্রথম প্রভাতে ইউরোপের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এক হয়ে নতুন পল্লবিত বৃক্ষের শাখা, নতুন শস্যের দানা, নতুন ফোটা ফুল নিয়ে উৎসবে মেতে উঠত। এই উৎসবে একজন মে রাজা, একজন মে রানি সেজে মে মাসের রং মানুষের প্রাণে-প্রাণে ছড়িয়ে দিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর পর ইউরোপ থেকে এই উৎসব পাচার হয়ে যায় আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে। শিল্প বিপ্লব এ উৎসবকে রুখে দিল। ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠে অসংখ্য শিল্প-কারখানা। যন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিকেরও আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গ্রামের মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে শিল্প-কারখানার শ্রমিকের খাতায় নাম লেখায়। গড়ে ওঠে নতুন সম্প্রদায়, পুঁজিবাদী শ্রেণী। মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণী আর শোষিত-বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণী। শিল্প বিপ্লবের এই যন্ত্রের চাকা ঘুরতে ঘুরতে পুরো ইউরোপ-আমেরিকার মাটি স্পর্শ করে। শ্রমিকের কাজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা। শ্রমিকের কোনো স্বপ্ন নেই। শ্রমিক জন্তু। মালিকের কথায় শ্রমিক উঠবে-বসবে। এমন অসহনীয় অস্থির অবস্থা বেশ কিছুদিন চলার পর শ্রমিকরা জোট বাঁধা শুরু করে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শ্রমিকরা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, তারা আট ঘণ্টা কাজ করবে। আট ঘণ্টা বিশ্রাম করবে। আট ঘণ্টা গান গাইবে। পহেলা মে এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কারখানা বন্ধ করে শিকাগো শহরের শ্রমিকরা রাজপথে নেমে আসে। ধর্মঘটে বন্ধ হয়ে যায় আমেরিকা। এরপর ঐতিহাসিক হে মার্কেটে শ্রমিকের রক্তের বান, শ্রমিকের আত্মত্যাগ মে মাসকে লাল রঙে রাঙায়। সেই থেকে মে মাসের প্রথম দিন আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। ভারতবর্ষে প্রথম মে দিবস উদ্যাপিত হয় মাদ্রাজে, ১৯২৩ সালে। বাংলাদেশেও লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে শ্রমিকরা মে দিবস পালন করছে। ১৮৮৬ সালের সেই রক্তরাঙা মে কবির রক্তক্ষরণের কাব্যেও প্রস্ফুটিত হয়। মে নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের কবিই কবিতা লিখেছেন। বাংলা ভাষার কবিরাও মে মাসের লাল সূর্যদীপ্ত উত্তাপ নিয়ে চরণ সাজিয়েছেন। আজও মে মাসের প্রথম প্রভাতে পৃথিবীর কোটি কোটি শ্রমিক গর্জে ওঠে। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। গার্মেন্টের সেলাই-দিদিমণি, মোটর শ্রমিক, ইটখোলার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, লৌহ শ্রমিকসহ যেসব শ্রমিক তাদের শরীরের শক্তি দিয়ে পৃথিবী টিকিয়ে রেখেছে, তারা জোটবদ্ধ হয়ে মে দিবস পালন করে। দিনটি তাদের ঈদের দিন। উৎসবের দিন। এখনো লড়াই। এখনো সংগ্রাম। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের এই সংগ্রাম কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। এ জন্যই প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় মনে করেন, শ্রমিকের সব দিনই মে দিবস। সব দিনই কাজের। সব দিনই সৃষ্টির। সব দিনই অধিকার আদায়ের। তিনি কণ্ঠ ছাড়েন জোরে, 'হররোজ মে ডে'।
ফখরে আলম

No comments

Powered by Blogger.