গোলটেবিল বৈঠক-ইশারা ভাষার উন্নয়নে চাই বিশেষ উদ্যোগ

বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য স্বীকৃত ও প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষা তৈরি ও প্রচলন হয়নি। যোগাযোগের সীমাবদ্ধতায় এই জনগোষ্ঠী সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


তাই ইশারা ভাষা উন্নতকরণ ও প্রমিতীকরণে ইশারা ভাষা বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এই ভাষার স্বীকৃতির জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
গতকাল রোববার প্রথম আলো আয়োজিত ‘বাংলায় ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণ: বর্তমান অবস্থা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। বক্তারা ইশারা ভাষার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকার বিষয়টিতেও জোর দেন।
প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহায়তা করে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত কিন্তু বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী সাবিরা ইয়ামীনের পাঠানো লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। বৈঠকে ইশারা ভাষায় দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইশারা ভাষায় সংবাদ উপস্থাপক মনোয়ার হোসেন।
বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ঢাকা বধির সংঘের নির্বাহী সহসভাপতি শাহ বাবুল আহমেদ বৈঠকে বলেন, ‘যখন পড়াশোনা করতাম, তখন শিক্ষকেরা ইশারা ভাষা জানতেন না। বোর্ডে লিখে তা মুখস্থ করতে বলতেন। তা করতে না পারলে মার খেতে হতো।’
বক্তাদের আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে, শাহ বাবুল আহমেদের অভিজ্ঞতা আর বর্তমান প্রজন্মের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। এখনো বিশেষ শিক্ষা স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক এই ভাষা জানেন না, তাঁদের প্রশিক্ষণেরও তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন জায়গায় ইশারা ভাষা যেটুকু ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যেও নেই সমন্বয়।
বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ১০ বছর আগের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের প্রায় ২৪ লাখ জনগোষ্ঠী বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী।
প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, একটি অংশকে উপেক্ষিত বা বাধার মুখে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা, যোগাযোগ একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এটি কারও আয়ত্তের মধ্যে না থাকলে পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। তিনি বলেন, এই ভাষার প্রমিতীকরণের বিকল্প নেই। ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণে কমিটি গঠন করা বা অন্য কোনো বিষয়ে সহযোগিতার প্রয়োজন হলে বাংলা একাডেমী সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত অতিথি জাতীয় সংসদের প্রতিবন্ধীবিষয়ক সংসদীয় মোর্চার আহ্বায়ক আবদুল মতিন খসরু বিশেষ কাজ থাকায় নির্ধারিত সময়ে বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি। তবে পরে প্রথম আলোর কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষ আমাদের সমাজেরই অংশ। সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে পারলে সাধারণ মানুষের মতো তারাও সমাজে অবদান রাখতে পারবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ম দানীউল হক বলেন, সরকারি পর্যায় থেকেই বাংলা ইশারা ভাষার জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান গুলশান আরা বলেন, ইশারা ভাষার অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কোনো দলিলপত্র নেই। নেই সাংবিধানিক বা আইনি স্বীকৃতি।
মূল বক্তা সিডিডির নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান বলেন, ইশারা ভাষা এবং এই ভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী সমাজে এখনো অবহেলিত। সাধারণ স্কুলে বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করা হয় না। ভর্তি করা হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে তা কাজে লাগে না। বাড়িতেও যোগাযোগের অভাবে এই জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যায়।
নোমান খান জানান, সিডিডি এ পর্যন্ত ইশারা ভাষার ওপর চার হাজার ২০০ শব্দে ছয়টি বই প্রকাশ করেছে। পকেট বই, বিভিন্ন জেলার নাম দিয়ে আলাদা বইও করেছে। এ পর্যন্ত হাজারেরও বেশি জনসংখ্যাকে এই ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সোসাইটি অব দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারসের চেয়ারম্যান বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী এম ওসমান খালেদ দোভাষীর সহায়তায় এই ভাষার বিস্তৃতি ও বর্তমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে সহায়তা না পাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রেসিডেন্ট গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বীর বিক্রম বলেন, বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি সাতজনের জন্য একজন শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। অথচ সংস্থার অধীনে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকই নেই। উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চালাতে হচ্ছে। তিনি এই শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে সহজে চেনার জন্য আলাদা পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করেন।
সরকারি মূক-বধির বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাইদুর রহমান এই ভাষা নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক নাজরানা ইয়াসমিন বলেন, বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হলে আইনি সুরক্ষা পান না। কেননা, পুলিশ, আদালত কেউ এই নারীদের কথা বুঝতে পারেন না।
জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সমন্বয়কারী জাহিদুল কবির ইশারা ভাষার উন্নয়নে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাওহিদা জাহান ও শেখ মো. ফয়সাল হোসেন ইশারা ভাষা নিয়ে অভিভাবক ও সমাজের সবাইকে আগ্রহী হওয়ার আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.