স্মরণ-নেত্রকোনার বাতিঘর

‘কুন্তল একটি জানালা খুলে বসেছিল। তার সে জানালায় বসে নেত্রকোনা সাংস্কৃতিক জগৎ দেখত। শারীরিক প্রতিবন্ধী এই মানুষটি ঘরে বসে থেকে কত কাজই না করত! তাকে সমাজের বেশ প্রয়োজন ছিল।’ এক স্মরণসভায় কুন্তল বিশ্বাস সম্পর্কে বলছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার।


প্রয়াত কুন্তল বিশ্বাস সত্যি একটি জানালা খুলে বসেছিলেন। বলা যায়, সে জানালা দিয়ে পরিচালিত হতো নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক অঙ্গন। কখন, কোথায় প্রতিবাদ করতে হবে, কোন অনুষ্ঠানটি করা জরুরি—ঘরে বসে সেই আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতেন তিনি। এগুলো তিনি করতেন প্রাণের তাগিদে, নিছক ভালোবাসা থেকে। এতে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা। মানুষটি ছিলেন নেত্রকোনার জন্য সত্যিকারের একটি বাতিঘর। তিনি একটি কুপি জ্বালিয়ে মানবধর্ম বিকাশের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ডেকেছিলেন তরুণ, যুবক, প্রবীণসহ সব বয়সী মানুষকে। তিনি নেত্রকোনার অনেকের প্রিয় কাক্কুমণি।
সেদিনের স্মরণসভায় জেলা পরিষদের প্রশাসক মতিয়র রহমান খান বলেছিলেন, ‘কুন্তল বিশ্বাসের অসাধারণ একটি গুণ ছিল। তিনি সবাইকে একত্র করতে পারতেন। দলমত, জাতি, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে আলাদা একটি জগৎ তৈরি করেছিলেন তিনি। দেখতে পেতাম তাঁর ঘরে সবার আনাগোনা। এটা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।’
কর্মোদ্যোগী এই মানুষটি শারীরিকভাবে চার দশকেরও বেশি সময় অসুস্থ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিলেন শতভাগ সুস্থ। মানবকল্যাণে তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, শৈশবে এক শিক্ষক ক্লাসে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিলে তিনি প্রতিবাদ করেন। শেষে ওই শিক্ষক আন্দোলনের চাপে বরখাস্থ হন। কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাফল্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রাখেন তিনি। পরে ছাত্র ইউনিয়নের জগন্নাথ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে শারীরিক অসুস্থতায় জন্য অমনোনীত হন। তবু থেমে থাকেননি তিনি। আসামের ধুবরিতে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। দেশ স্বাধীন হলে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সাপ্তাহিক একতায় কাজ শুরু করেন।
এদিকে ১৯৬৯ সালে লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমে অস্ট্রিও আর্থরাটিসে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে কমরেড মণি সিংহের সহায়তায় জার্মানি থেকে চিকিৎসা শেষে ১৯৭৪ সালে ঢাকায় ফেরেন। আবার সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক কাজে যোগ দেন। জার্মানিতে চিকিৎসা শেষে সেখানে কাল মার্কসের পার্টির স্কুল থেকে মার্কসীয় দর্শন, আর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিষয়ে ডিপ্লোমা নেন। অবশ্য সাম্যবাদী শিক্ষা তিনি নিয়েছিলেন বড়ভাই কমরেড মৃণাল বিশ্বাসের সহায়তায় ত্যাগী রাজনীতিবিদ মণি সিংহ, খোকা রায়, আব্দুস সালামের কাছ থেকে। স্বপ্ন দেখতেন সারা বিশ্বে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। জনতা মুক্তি পাবে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে।
প্রগতিশীল এই মানুষটি ১৯৮০ সালে ঢাকা থেকে নেত্রকোনায় এসে ভোরের কাগজ ও পরে প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করেন। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের উৎসাহে ইথিওপিয়া: এক অজানা বিপ্লবের কাহিনি নামে গ্রন্থ অনুবাদ করেন।
সেই মানুষটির স্মরণে আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি, সোমবার আরেকটি স্মরণসভার আয়োজন করেছে নেত্রকোনা নাগরিক কমিটি। বিকেল তিনটায় স্থানীয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে স্মরণসভাটি অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন শিক্ষাবিদ মতীন্দ্র সরকার।
মতীন্দ্র সরকার বলেন, ‘তিনি শুধু নেত্রকোনার নন, ছিলেন দেশের সম্পদ। তিনি ঘরে বসেই অনেক কাজ করতেন। তাঁর অকালপ্রয়াণে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। পিছিয়ে গেল অনেক সামাজিক কাজ। কোথাও কোনো জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচিত না হলেও হতো কুন্তলের বাসায়। কেউ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাক তা তিনি চাইতেন না।’
তাঁর ভাবশিষ্য, তরুণ কবি ও শিল্পী আলমগীর বলেন, ‘কাক্কুমণি, নেত্রকোনার স্টিফেন হকিং। হকিং হাত ও মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে কাজ করে চলেছেন। কাক্কুমণিও শারীরিক অক্ষমতার জন্য ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। কিন্তু জানালার পাশের চেয়ারটিতে বসে একাগ্রচিত্তে কাজ করে গেছেন।’
জীবনের শেষের এক দশক তিনি বাসা থেকে একা বের হতে পারতেন না। কিন্তু নেত্রকোনার প্রতিটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল। জীবিত অবস্থায় একাধারে সাংবাদিক ও জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি, রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্রের সদস্য, উদীচী নেত্রকোনার সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন। গত ৯ আগস্ট অকৃতদার এই মানুষটির ৬৫তম জন্মদিনে নেত্রকোনা নাগরিক সমাজ তাঁকে ‘বাতিঘর’ উপাধি দেয়।
কুন্তল বিশ্বাস শিক্ষকতা না করেও ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক। সংসার না করেও দক্ষ সংসারী। তাঁর ঘরে সব সময় লেগে থাকত জম্পেশ আড্ডা। নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক জগৎকে দূরে ফেলে গত ১৪ জানুয়ারি চলে গেছেন তিনি না ফেরার দেশে।
মোহাম্মদ খায়রুল হক

No comments

Powered by Blogger.