ধর্ম-তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনে রোজা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তাআলার ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও


সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত-১৩)
মাহে রমজানের রোজার অন্তর্নিহিত তা ৎ পর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হূদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়া হলো আল্লাহর হুকুমগুলো্রপালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পরম সম্মানিত হয়। যত প্রকার ইবাদত ও বিধি-বিধান আছে, সবকিছুর মূলে তাকওয়ার অনুপ্রেরণা। তাকওয়া হাসিল হওয়ার পর মানুষের হূদয় আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে রমজান মাসে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠনে রোজাদার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
যিনি মুত্তাকি বা পরহেজগার হবেন, তিনি যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং ভালো কাজের অনুশীলন করবেন। সত্যবাদিতা, আমানতদারি, ধৈর্য, ন্যায়বিচার বা আদল, ইহসান প্রভৃতি যত রকমের অনুপম মানবিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তিনি সেগুলোর অধিকারী হতে চেষ্টা করবেন। তিনি সর্বদা স ৎ কাজ করবেন এবং অপরকে স ৎ কাজের প্রতি বিনীতভাবে আহ্বান জানাবেন। আর নিজে অস ৎ কাজ থেকে সর্বদা বিরত থাকবেন এবং অন্য সবাইকে অস ৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট হবেন। তিনি সময়মতো নামাজ আদায় করবেন, জাকাত প্রদান করবেন এবং মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা তথা রোজাব্রত পালন করবেন।
সত্যবাদী এবং মুত্তাকিনদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘স ৎ কর্ম শুধু এই নয় যে পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় স ৎ কাজ হলো এই যে ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রাসুলের ওপর আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে, আত্মীয়স্ব্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই হলো মুত্তাকিন।’(সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭৭)
বছরের এক মাসব্যাপী রোজা পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। মানুষের মধ্যে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। মুত্তাকির বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা মুত্তাকি বা খোদাভীরু হতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)
রোজাদার ব্যক্তি রোজা আছে কি না, তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সামনে সুস্ব্বাদু ও লোভনীয় খাবার উপস্থ্থিত থাকা সত্ত্বেও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্বশীলতার কারণে সে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ক্ষুধা-পিপাসা ও খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছাকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো রোজাদার যদি লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করেন বা কিছু পান করেন বা নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে বসেন, তাহলে তা মানুষের জানার নয়। কিন্তু খাঁটি রোজাদার ব্যক্তি তা করেন না। কারণ, সেই মুত্তাকি জানেন যে মানুষ না দেখলেও আল্লাহ তাঁর বান্দার সব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছেন। এভাবে রোজাদারের মধ্যে খোদাভীতি সৃষ্টি হয় এবং সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, যাবতীয় অশ্লীল কাজ, মিথ্যা কথা প্রভৃতি খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। তাই রোজাকে বলা হয় তাকওয়া অর্জনের মাস।
রোজা মুত্তাকির জন্য এক অফুরন্ত নিয়ামতস্বরূপ। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুত্তাকি ক্ষুধা, পিপাসা, কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে রোজা পালনে ব্রতী হন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা সুচারুভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফ্ফারা হয়ে যাবে।’ (বায়হাকি)
মাহে রমজানে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে মানুষের পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। বস্তুত যে রোজা তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও হূদয়ের পবিত্রতাশূন্য, সে রোজা যেন প্রকৃত অর্থে রোজাই নয়। রোজা যাতে অন্তঃসারশূন্য আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয় এবং তা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়, সে জন্য মাহে রমজানে তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতিও বিশেষ তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।
একজন রোজা পালনকারী ও তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুসলমান সমাজে কোনো প্রকার অশ্লীল ও অবৈধ কোনো খারাপ কাজ করবেন না, কারও অনিষ্ট সাধনের চিন্তাও করবেন না, বরং সর্বদা পরোপকারে লিপ্ত থাকবেন এবং পবিত্র কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক জীবন যাপন করে জান্নাত লাভের পথ সুগম করবেন। সবাই যদি তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে চলি, মানুষ হিসেবে মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোর প্রতি আত্মসচেতন হই, আল্লাহর নির্দেশ মান্য করি, সমাজে অন্যায়-অসত্য ও অকল্যাণের পথ বর্জন করে চলি, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা মুত্তাকি হতে পারব।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.