যৌন নিপীড়ন-নারী, তুমি সাবধান by ফারুক ওয়াসিফ
রসু খাঁ বন্দী হওয়ায় অনেকে স্বস্তির দম ফেলেছিল। তার মতো লোকের সঙ্গে এক আলো-বাতাসে বাস করতে কে-ই বা রাজি? তার বিচার চলছে, সাইদ ও পরিমল জেলহাজতে, কিন্তু মেয়েরা কি নিরাপদ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর্মস্থলে, শহর থেকে গ্রামে চলছে অবিরত ধর্ষণ। শিশু থেকে প্রৌঢ়া, বাঙালি থেকে পাহাড়ি। কিছুই আর ব্যতিক্রম নয়।
হরহামেশাই ঘটছে, ঠেকানো যাচ্ছে না। রসু খাঁকে সমাজচ্যুত বিকারগ্রস্ত বলে মনকে চোখ ঠাওরানো যায়, কিন্তু এসব ঘটাচ্ছে কোন রসু খাঁরা?
নবাব আলীবর্দির আমলে বঙ্গদেশে বর্গিদের খুব উৎপাত ছিল। মায়েরা ঘুমপাড়ানি ছড়া কাটত: খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল, বর্গি এল দেশে। সেই দশা কি আবার এসেছে? মায়েরা শিশু-কিশোরীদেরও একা ছাড়ে না। অনেকের মুখ ঢেকে যায় বোরকায়। অনেকের পড়ালেখা বন্ধ হয়। যারা পারছে বিদেশে পাঠাচ্ছে মেয়েকে। গ্রামে বালিকা বয়সেই অনেকের ঘাড়ে চাপছে বিয়ের জোয়াল। বরগুনার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী জেনি আখতার তাতেও বাঁচেনি। মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণের পর লাশ বানিয়ে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় বাড়িরই গাছের ডালে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সাত বছরের শিশু ধর্ষিত হয়। বান্দরবানের লামায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টায় নৃশংসভাবে খুন হয় পাঁচ বছরের শিশুসহ পরিবারের তিন সদস্য। উৎপাত আর ভিডিও প্রকাশের গ্লানিতে মতিঝিলে ও বরিশালে আত্মহত্যা করে দুই ছাত্রী। সবই গত মাসের ঘটনা। এক নারীবন্ধুর প্রশ্ন, ‘দেশে কি ধর্ষণের উদ্যাপন চলছে?’
পেশাদার যৌনসন্ত্রাসী আর কজন? ধরা পড়ার আগে বা নিপীড়ন ঘটানোর আগে অধিকাংশ যৌন নিপীড়কই ‘ভালো’ মানুষ। তাদেরও পরিবার থাকে, পেশা থাকে, পদাধিকার থাকে, থাকে ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগ। পুরুষালি ক্ষমতা আর যৌন নিপীড়ন হাতে হাত ধরে চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ঢাল হয় আইন-প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যৌন নিপীড়নের সম্পর্ক খোলাখুলি ধরা পড়েছিল ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষকবিরোধী আন্দোলনে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মানিকের নেতৃত্বে সেখানে ধর্ষণের উদ্যাপন চলেছিল। ছাত্রলীগের এহেন নেতার ‘সম্মানে’ জোট বেঁধেছিল প্রশাসন, দল আর একশ্রেণীর শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। বিএনপির আমলে আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ধর্ষিত শিশু তানিয়া কিংবা কিশোরী ইয়াসমিনের ধর্ষকেরা ছিল পুলিশ সদস্য। ইয়াসমিন হত্যা-ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে রচিত হয়েছিল আরেক সাত ভাই চম্পার গল্প। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সাত প্রতিবাদী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৪০ দিন আন্দোলন চালাতে হয়েছিল। সে সময়ের উপাচার্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েতে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, ‘বল, কে ধর্ষিতা?’ এই ঔদ্ধত্যের জবাবে উপস্থিত মেয়েদের বলতে হয়েছিল, ‘আমরা, আমরা সবাই ধর্ষিতা।’ তৈরি হয়েছিল বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের অসাধারণ এক ভগ্নিসংহতি। জাবির সেই ছাত্রীদের পথ ধরেই আজ উঠে দাঁড়িয়েছে ভিকির ছাত্রীরা।
ধর্ষক-যৌন নিপীড়কদের ক্ষমতার উৎস প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি ও সংস্কৃতি, এ বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। বারবার আইন বদলেছে, বিরাট বিরাট বক্তৃতা চলেছে, সমান তালে বেড়েছে আতঙ্ক ও প্রতিবাদ। একটি ক্ষেত্রেও প্রশাসনের আচরণ আইনসংগত ও দায়িত্বশীল ছিল না। পরিমলের খুঁটির জোর ঠেকাতে খুদে মেয়েদের বাবা-মা ও নাগরিক সহমর্মীদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের চাপ ছাড়া ক্ষমতাবান নেতার আত্মীয় সাইদের টিকি স্পর্শ করা যেত কি না সন্দেহ। জেনির ধর্ষক ও হত্যাকারী যুবকও এলেবেলে কেউ নয়, সে বামনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পুত্রধন। দুঃখের বিষয়, গলায় দড়ি বাঁধা ঝুলন্ত জেনি মধ্যবিত্ত মহলে তেমন সহমর্মিতা ও সংহতি পায়নি। সেটা কি দরিদ্র ও গ্রামীণ মেয়ে বলেই? পোশাককর্মীদের নির্যাতন ও বঞ্চনাও মধ্যবিত্ত মহলে ততটা সাড়া তোলে না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপ জানায়, ১০-১৮ বছর বয়সী ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোরীই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। জিজ্ঞেস করে দেখুন, অধিকাংশ নারীর মনেই অপমান আর নির্যাতনের ছাপ। এই সত্য মেনে নিয়ে চলবে সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র? চলবে এই সমাজের মেয়েরা? বিপদে উটপাখি মাথা লুকায় বালুতে, আমরা দেখে চলি টেলিভিশন, ঘুরি শপিং মলে, খুঁজি ভালো স্কুল। কিন্তু ভাবছেন কি, আপনার জানের টুকরো মেয়েটির বেড়ে ওঠা কতটা নিরাপদ? গত ১০০ বছরে আমরা দুবার রাষ্ট্র বদলেছি, অথচ সমাজবদলের, মানসিকতা বদলের চেষ্টাই হয়নি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, নারী-পুরুষের মধ্যে অবিশ্বাস-হিংসা আর নিপীড়নের ভয়াবহতায় তারই ইঙ্গিত। সমস্যাটা তাই পুরুষেরও, গোটা সমাজেরও। নারীকে বিপন্ন রেখে পুরুষদের পক্ষে, সমাজের পক্ষে মুক্তমনের মানুষ হওয়া অসম্ভব।
কিছুদিন আগে রাস্তাঘাটে যৌন সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ইভ টিজিং’ শব্দটি দারুণ চালু হল। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পুলিশ-র্যাবসহ ভ্রাম্যমাণ যৌন সন্ত্রাসকে সবাই এই নারীবিদ্বেষী শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করতে থাকল। নারীকে উত্ত্যক্তকারীদের বলা হলো প্রেমিক ‘রোমিও’। র্যাব চালাল ‘রোমিও হান্ট’ অভিযান। যার শিকার হয়ে অনেক তরুণী আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে, তা স্পষ্টতই যৌন সন্ত্রাস। নিপীড়নকে নিপীড়নই বলতে হবে, তাকে দুষ্টামি বলে হালকা করে দেখা ও দেখানো মানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া।
যৌন নিপীড়নের এ রকম ভয়াবহতার মুখে, গত বছর উচ্চ আদালত সব শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে কেন যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা কার্যকর করা হবে না, সে বিষয়ে সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেন। বছর পেরোচ্ছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নির্বিকার, উদাস বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই নীতিমালা ও অভিযোগ সেলের দাবি উঠে এসেছিল এক যুগ আগে জাবি ও ঢাবির যৌন নিপীড়নবিরোধী দুটি বিরাট আন্দোলনের গর্ভ থেকে। পরে এটা ছড়িয়ে যায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একটা পর্যায়ে আদালতসহ অধিকারবাদী মহলের সমর্থনও পায়।
শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার মাধ্যমে অ-ফৌজদারি শাস্তির ব্যবস্থা এবং গোপনে অভিযোগ জানানোর সুযোগ যদি থাকত, তাহলে বোবা কান্নায় গুমরে মরা ও আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যেত। চাপে থাকত পুরুষালি-বীরত্ব এবং তরুণী ‘শিকার’ হয়ে যেত কঠিন কঠিন। আইনি শাস্তির বিকল্প এটা নয়। এটা প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি। নিপীড়িতকে যাতে কোনোভাবেই নিপীড়কের সঙ্গে এক ক্লাসে, এক ক্যাম্পাসে বা এক অফিসে কাজ করতে না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। এই সহাবস্থানের পরিণতি হলো নিপীড়কের দাপট বাড়া আর নিপীড়িতের কোণঠাসা হতে হতে বিদায় নেওয়া। শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও অভিযোগ সেল প্রতিষ্ঠার জরুরত এটাই। প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ৮০-৯০ শতাংশ যখন পুরুষের হাতে, তখন পুরুষাধিপত্যের প্রশমনে নারীর হাতে কিছু রক্ষাকবচ রাখা চাই।
নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণে কোনো দোষ নেই। যৌন নিপীড়ন সেটাই, যেখানে মানবিক যোগাযোগ অস্বীকার করে, অপর পক্ষের সম্মতির পরোয়া ছাড়াই তাকে বিকৃত আনন্দের জন্য বস্তুর মতো ব্যবহার করতে চায়। এতে কেবল নারীর স্বাধীনতা ও শরীরই আক্রান্ত হয় না, ধ্বংস হয় নারী-পুরুষে এবং মানুষে মানুষে সম্পর্কের বয়ন।
এই অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো? দুর্বত্ত ক্ষমতার প্রতাপ, প্রশাসনের অপরাধীকরণ দায়ী। কিন্তু বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির লাগামছাড়া বাণিজ্য দিয়ে জনসংস্কৃতিকে যৌনাসক্ত করার দায় কি কম? পুরুষালি দাপুটে রাজনীতি আর নিপীড়ন-বান্ধব সংস্কৃতি আজ এক দেহ এক আত্মা হয়ে উঠেছে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অচল। এই দুর্বৃত্ত ক্ষমতাকে বশে আনা ছাড়া গতি নেই। যৌন সন্ত্রাসবিরোধী সামাজিক প্রতিবাদের যে ঢেউ জাগছে, তাকে এসব নিয়েও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে মানুষে মানুষে নতুন সম্পর্ক নির্মাণের কথাও।
যৌন সন্ত্রাসের দাপট আর সামাজিক নৈরাজ্য জমাট বাঁধতে বাঁধতে পাহাড়সমান হয়ে গেছে। রসু খাঁ বা পরিমল-সাইদরা সেই পাহাড়ের একেকটি পাথর মাত্র। এসব পাথর ভাঙা কঠিন নয়। কিন্তু পাহাড়টি তো দাঁড়িয়ে, তাকে ডিঙানো ছাড়া কিছুই ঠিক হবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
নবাব আলীবর্দির আমলে বঙ্গদেশে বর্গিদের খুব উৎপাত ছিল। মায়েরা ঘুমপাড়ানি ছড়া কাটত: খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল, বর্গি এল দেশে। সেই দশা কি আবার এসেছে? মায়েরা শিশু-কিশোরীদেরও একা ছাড়ে না। অনেকের মুখ ঢেকে যায় বোরকায়। অনেকের পড়ালেখা বন্ধ হয়। যারা পারছে বিদেশে পাঠাচ্ছে মেয়েকে। গ্রামে বালিকা বয়সেই অনেকের ঘাড়ে চাপছে বিয়ের জোয়াল। বরগুনার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী জেনি আখতার তাতেও বাঁচেনি। মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণের পর লাশ বানিয়ে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় বাড়িরই গাছের ডালে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সাত বছরের শিশু ধর্ষিত হয়। বান্দরবানের লামায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টায় নৃশংসভাবে খুন হয় পাঁচ বছরের শিশুসহ পরিবারের তিন সদস্য। উৎপাত আর ভিডিও প্রকাশের গ্লানিতে মতিঝিলে ও বরিশালে আত্মহত্যা করে দুই ছাত্রী। সবই গত মাসের ঘটনা। এক নারীবন্ধুর প্রশ্ন, ‘দেশে কি ধর্ষণের উদ্যাপন চলছে?’
পেশাদার যৌনসন্ত্রাসী আর কজন? ধরা পড়ার আগে বা নিপীড়ন ঘটানোর আগে অধিকাংশ যৌন নিপীড়কই ‘ভালো’ মানুষ। তাদেরও পরিবার থাকে, পেশা থাকে, পদাধিকার থাকে, থাকে ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগ। পুরুষালি ক্ষমতা আর যৌন নিপীড়ন হাতে হাত ধরে চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ঢাল হয় আইন-প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যৌন নিপীড়নের সম্পর্ক খোলাখুলি ধরা পড়েছিল ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষকবিরোধী আন্দোলনে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মানিকের নেতৃত্বে সেখানে ধর্ষণের উদ্যাপন চলেছিল। ছাত্রলীগের এহেন নেতার ‘সম্মানে’ জোট বেঁধেছিল প্রশাসন, দল আর একশ্রেণীর শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। বিএনপির আমলে আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ধর্ষিত শিশু তানিয়া কিংবা কিশোরী ইয়াসমিনের ধর্ষকেরা ছিল পুলিশ সদস্য। ইয়াসমিন হত্যা-ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে রচিত হয়েছিল আরেক সাত ভাই চম্পার গল্প। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সাত প্রতিবাদী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৪০ দিন আন্দোলন চালাতে হয়েছিল। সে সময়ের উপাচার্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েতে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, ‘বল, কে ধর্ষিতা?’ এই ঔদ্ধত্যের জবাবে উপস্থিত মেয়েদের বলতে হয়েছিল, ‘আমরা, আমরা সবাই ধর্ষিতা।’ তৈরি হয়েছিল বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের অসাধারণ এক ভগ্নিসংহতি। জাবির সেই ছাত্রীদের পথ ধরেই আজ উঠে দাঁড়িয়েছে ভিকির ছাত্রীরা।
ধর্ষক-যৌন নিপীড়কদের ক্ষমতার উৎস প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি ও সংস্কৃতি, এ বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। বারবার আইন বদলেছে, বিরাট বিরাট বক্তৃতা চলেছে, সমান তালে বেড়েছে আতঙ্ক ও প্রতিবাদ। একটি ক্ষেত্রেও প্রশাসনের আচরণ আইনসংগত ও দায়িত্বশীল ছিল না। পরিমলের খুঁটির জোর ঠেকাতে খুদে মেয়েদের বাবা-মা ও নাগরিক সহমর্মীদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের চাপ ছাড়া ক্ষমতাবান নেতার আত্মীয় সাইদের টিকি স্পর্শ করা যেত কি না সন্দেহ। জেনির ধর্ষক ও হত্যাকারী যুবকও এলেবেলে কেউ নয়, সে বামনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পুত্রধন। দুঃখের বিষয়, গলায় দড়ি বাঁধা ঝুলন্ত জেনি মধ্যবিত্ত মহলে তেমন সহমর্মিতা ও সংহতি পায়নি। সেটা কি দরিদ্র ও গ্রামীণ মেয়ে বলেই? পোশাককর্মীদের নির্যাতন ও বঞ্চনাও মধ্যবিত্ত মহলে ততটা সাড়া তোলে না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপ জানায়, ১০-১৮ বছর বয়সী ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোরীই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। জিজ্ঞেস করে দেখুন, অধিকাংশ নারীর মনেই অপমান আর নির্যাতনের ছাপ। এই সত্য মেনে নিয়ে চলবে সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র? চলবে এই সমাজের মেয়েরা? বিপদে উটপাখি মাথা লুকায় বালুতে, আমরা দেখে চলি টেলিভিশন, ঘুরি শপিং মলে, খুঁজি ভালো স্কুল। কিন্তু ভাবছেন কি, আপনার জানের টুকরো মেয়েটির বেড়ে ওঠা কতটা নিরাপদ? গত ১০০ বছরে আমরা দুবার রাষ্ট্র বদলেছি, অথচ সমাজবদলের, মানসিকতা বদলের চেষ্টাই হয়নি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, নারী-পুরুষের মধ্যে অবিশ্বাস-হিংসা আর নিপীড়নের ভয়াবহতায় তারই ইঙ্গিত। সমস্যাটা তাই পুরুষেরও, গোটা সমাজেরও। নারীকে বিপন্ন রেখে পুরুষদের পক্ষে, সমাজের পক্ষে মুক্তমনের মানুষ হওয়া অসম্ভব।
কিছুদিন আগে রাস্তাঘাটে যৌন সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ইভ টিজিং’ শব্দটি দারুণ চালু হল। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পুলিশ-র্যাবসহ ভ্রাম্যমাণ যৌন সন্ত্রাসকে সবাই এই নারীবিদ্বেষী শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করতে থাকল। নারীকে উত্ত্যক্তকারীদের বলা হলো প্রেমিক ‘রোমিও’। র্যাব চালাল ‘রোমিও হান্ট’ অভিযান। যার শিকার হয়ে অনেক তরুণী আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে, তা স্পষ্টতই যৌন সন্ত্রাস। নিপীড়নকে নিপীড়নই বলতে হবে, তাকে দুষ্টামি বলে হালকা করে দেখা ও দেখানো মানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া।
যৌন নিপীড়নের এ রকম ভয়াবহতার মুখে, গত বছর উচ্চ আদালত সব শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে কেন যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা কার্যকর করা হবে না, সে বিষয়ে সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেন। বছর পেরোচ্ছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নির্বিকার, উদাস বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই নীতিমালা ও অভিযোগ সেলের দাবি উঠে এসেছিল এক যুগ আগে জাবি ও ঢাবির যৌন নিপীড়নবিরোধী দুটি বিরাট আন্দোলনের গর্ভ থেকে। পরে এটা ছড়িয়ে যায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একটা পর্যায়ে আদালতসহ অধিকারবাদী মহলের সমর্থনও পায়।
শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার মাধ্যমে অ-ফৌজদারি শাস্তির ব্যবস্থা এবং গোপনে অভিযোগ জানানোর সুযোগ যদি থাকত, তাহলে বোবা কান্নায় গুমরে মরা ও আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যেত। চাপে থাকত পুরুষালি-বীরত্ব এবং তরুণী ‘শিকার’ হয়ে যেত কঠিন কঠিন। আইনি শাস্তির বিকল্প এটা নয়। এটা প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি। নিপীড়িতকে যাতে কোনোভাবেই নিপীড়কের সঙ্গে এক ক্লাসে, এক ক্যাম্পাসে বা এক অফিসে কাজ করতে না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। এই সহাবস্থানের পরিণতি হলো নিপীড়কের দাপট বাড়া আর নিপীড়িতের কোণঠাসা হতে হতে বিদায় নেওয়া। শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও অভিযোগ সেল প্রতিষ্ঠার জরুরত এটাই। প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ৮০-৯০ শতাংশ যখন পুরুষের হাতে, তখন পুরুষাধিপত্যের প্রশমনে নারীর হাতে কিছু রক্ষাকবচ রাখা চাই।
নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণে কোনো দোষ নেই। যৌন নিপীড়ন সেটাই, যেখানে মানবিক যোগাযোগ অস্বীকার করে, অপর পক্ষের সম্মতির পরোয়া ছাড়াই তাকে বিকৃত আনন্দের জন্য বস্তুর মতো ব্যবহার করতে চায়। এতে কেবল নারীর স্বাধীনতা ও শরীরই আক্রান্ত হয় না, ধ্বংস হয় নারী-পুরুষে এবং মানুষে মানুষে সম্পর্কের বয়ন।
এই অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো? দুর্বত্ত ক্ষমতার প্রতাপ, প্রশাসনের অপরাধীকরণ দায়ী। কিন্তু বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির লাগামছাড়া বাণিজ্য দিয়ে জনসংস্কৃতিকে যৌনাসক্ত করার দায় কি কম? পুরুষালি দাপুটে রাজনীতি আর নিপীড়ন-বান্ধব সংস্কৃতি আজ এক দেহ এক আত্মা হয়ে উঠেছে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অচল। এই দুর্বৃত্ত ক্ষমতাকে বশে আনা ছাড়া গতি নেই। যৌন সন্ত্রাসবিরোধী সামাজিক প্রতিবাদের যে ঢেউ জাগছে, তাকে এসব নিয়েও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে মানুষে মানুষে নতুন সম্পর্ক নির্মাণের কথাও।
যৌন সন্ত্রাসের দাপট আর সামাজিক নৈরাজ্য জমাট বাঁধতে বাঁধতে পাহাড়সমান হয়ে গেছে। রসু খাঁ বা পরিমল-সাইদরা সেই পাহাড়ের একেকটি পাথর মাত্র। এসব পাথর ভাঙা কঠিন নয়। কিন্তু পাহাড়টি তো দাঁড়িয়ে, তাকে ডিঙানো ছাড়া কিছুই ঠিক হবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments