ভিন্নমত-পদ্মা সেতুর জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও অর্থ নেওয়া যেত by আবু আহমেদ
একেক সময় ভাবি, আমাদের সমাজে শিক্ষিত লোক আছে অনেক, কিন্তু মেধাবী লোকের যেন বড়ই অভাব। সেই অর্ধশত বর্ষ থেকে কিংবা তারও কিছু বেশি সময় থেকে আমাদের শিক্ষা দিয়ে আসা হয়েছে- কোনো বড় প্রকল্প বাইরের অর্থ ছাড়া ফাইন্যান্সিং বা অর্থায়ন করা সম্ভব নয়।
আমলাদের মধ্যে পাকিস্তানের সিএসপিদেরও দেখেছি, আর বাংলাদেশ আমলের বিসিএস ক্যাডারদেরও দেখেছি। অবশ্যই সিএসপিরা বেশি চৌকস ছিলেন। তবে মাথায়-মননে বর্তমানের বিসিএস ক্যাডারদের থেকে বেশি পার্থক্য ছিল বলে মনে হয় না। হুকুমমতো কাজ করতেন। সেই হুকুম অবশ্য সরকারের। সরকারের রাজনৈতিক মন্ত্রী অথবা পুরো সরকার যদি একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে, তাহলে আমলারাও সে বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন না। কিন্তু চিন্তা করলে ভালো হতো। কারণ সমাজ ধরে নেয় প্রশাসনে প্রশাসক হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁরা সমাজের অন্যদের থেকে মেধাবী। তাঁরা লেখাপড়া করে অনেক কিছু জেনে হাজার হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে তবেই তো সেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো পাস করেছেন।
জুনিয়র আমলাদের পক্ষে নীতিনির্ধারণে অবদান রাখার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু সচিব পর্যায়ের আমলাদের তো এ ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ অনেক। তবে কোনো রকমে চাকরি করতে চাইলে সেই সুযোগ কোনো দিনই নেওয়া হবে না। চাকরি করতে করতে অবসরে চলে যাবেন। আপনার মন্ত্রীর মাথায় একটা আইডিয়া বা ধারণা নাও আসতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া জানলে তো আপনার মাথায় ধারণাটা আসা উচিত এবং সবার সামনে বড় মিটিংয়ে সেটি উপস্থাপন করলে বা সেই আইডিয়ার ভিত্তিতে ধারণাপত্র তৈরি করলে ক্ষতি কী? কিন্তু দুঃখ হলো, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এবং জ্ঞানের অভাবে আমরা অর্থায়নের অনেক ভালো সুযোগ বারবার হারিয়েছি। হারিয়ে পরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং গ্যারান্টিতে হয় বিদেশ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ করতে চেয়েছি, অথবা নূ্যনপক্ষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার দ্বারা ঋণ করিয়ে মোট অর্থায়নের প্রয়োজনের একটি অংশকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছি। একটি বা দুটি উদাহরণ দিই। যে দিন বা দিনগুলোতে সরকারি মোবাইলফোন কম্পানি টেলিটক বাজারে সিম বিক্রয় করা শুরু করল, সেদিন টেলিটকের গ্রাহক হওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের কী হুমড়ি খেয়ে পড়া। আর সেই দিনগুলোতে আমাদের শেয়ারবাজারে শেয়ারের দারুণ স্বল্পতা বিরাজ করছিল। টেলিটক সেই দিন গ্রিনফিল্ড নিয়েও শেয়ার বেচতে চাইলে শত শত কোটি টাকার পুঁজি শেয়ারবাজার থেকে তুলতে পারত। কিন্তু কথাটা সেই দিন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কেউ ভাবেনি। ভাবেনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও কেউ। ফলে টেলিটক বাস মিস করেছে। আজকে টেলিটক অর্থাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। হয়তো এই কম্পানির একটি প্রাকৃতিক মৃত্যুই হবে। কেউ আর টেলিটকের শেয়ারও কিনবে না এবং সিম কেনার জন্যও কারো অতিরিক্ত উৎসাহ নেই।
এই বাস সরকার মিস করেছে কি জ্ঞানের ঘাটতির জন্য নয়? অন্য উদাহরণ হলো, সরকারি এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশ। এই সংস্থা ট্যাক্স পেয়ারদের হাজার হাজার কোটি টাকা হজম করে চলেছে। কিন্তু লাভ করছে বলে কেউ জানে না। শুধু লোকসানই এই সংস্থার নিয়তি। মধ্যখানে বাংলাদেশ সরকার এই সংস্থার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের জালে আটকা পড়েছে এবং পড়ছে। এভাবে বিশ্বের অন্য কয়টি বিমান সংস্থা চলছে? তাহলে আমরা কী করে বলি আমরাও শিক্ষিত? এই সংস্থা নিয়ে আমাদের সংসদে কয় মিনিট আলোচনা হয়েছে? পদ্মা ব্রিজ অর্থায়নের জন্য প্রথম শুনেছি ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। পরে শোনলাম, ২০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। যে অর্থ আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় সমান। তবে এই ব্রিজ অর্থায়নের উপায় কী? এ ক্ষেত্রেও সেই অর্ধশতাব্দী আগে থেকে আমাদের শিখিয়ে দেওয়া সেই অর্থায়ন পদ্ধতির সম্মুখীন হলাম। সেই পদ্ধতি হলো, বিদেশিদের বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হও। অর্থ আসবে আর পদ্মা ব্রিজ অর্থায়ন হবে! একবারও এই জাতির পলিসিমেকাররা চিন্তা করে দেখল না, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি যদি অর্থ না দেয়, তাহলে কী হবে। এটা ঠিক যে পুরো অর্থায়ন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমার দুঃখ লাগে, বিকল্প অর্থায়ন নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে ঘণ্টাদুয়েক আলোচনা হয়েছে কি না। ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অন্তত অর্ধেক অর্থ এই জাতি নিজেই জোগান দিতে পারত কিভাবে? এই ভাবে।
আপনি পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করে যমুনা, মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রিজকে ইকুইটি আকারে তথা শেয়ারে বিভক্ত করে জনগণের কাছে বেচুন। এই তিনটি ব্রিজের মূল্য কত? নিশ্চয়ই এক বিলিয়ন ডলার তো হবে। সেই অর্থ পদ্মা ব্রিজের জন্য কাজে লাগান। প্রশ্ন হতে পারে, লোকে যমুনা, মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রিজের শেয়ার কিনবে কেন? কিনবে একশবার। কারণ এই ব্রিজগুলো বাণিজ্যিকভাবে লোভনীয়। সরকার এসব ব্রিজ থেকে কোনো বাণিজ্য করতে পারছে না, সেটা তো সরকারেরই ব্যর্থতা। ব্যক্তি খাতে এবং কম্পানি বোর্ডের হাতে গেলে এসব ব্রিজ অবশ্যই লাভজনকভাবে চালানো সম্ভব হবে। এতে ফল হবে দুভাবে। এক. সরকার একসঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকা পেয়ে পদ্মা ব্রিজের কাজে হাত দিতে পারবে। দুই. এই ব্রিজগুলো লাভে চললে এই লাভ থেকেই দ্বিতীয় মেঘনা সেতু এবং দ্বিতীয় দাউদকান্দি সেতু নির্মাণ করা সহজ হবে। এসব ধারণা সওজ এবং সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে আসবে না। কারণ সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষ হলো সরকারি সংস্থা। এরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু দুঃখ হলো, এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষের লোকজন তো অর্থনীতি এবং ব্যবসা করেনি। তাদের কাছে পাবলিক লিমিটেড কম্পানির ধারণাই অপরিচিত। কিন্তু সরকারের মধ্যে তো কিছু লোকের এসব ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত। যে সময় সরকার বর্তমানে পদ্মা ব্রিজ অর্থায়নের জন্য এগোচ্ছে, এটা জাতির জন্য বোঝা হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
জুনিয়র আমলাদের পক্ষে নীতিনির্ধারণে অবদান রাখার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু সচিব পর্যায়ের আমলাদের তো এ ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ অনেক। তবে কোনো রকমে চাকরি করতে চাইলে সেই সুযোগ কোনো দিনই নেওয়া হবে না। চাকরি করতে করতে অবসরে চলে যাবেন। আপনার মন্ত্রীর মাথায় একটা আইডিয়া বা ধারণা নাও আসতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া জানলে তো আপনার মাথায় ধারণাটা আসা উচিত এবং সবার সামনে বড় মিটিংয়ে সেটি উপস্থাপন করলে বা সেই আইডিয়ার ভিত্তিতে ধারণাপত্র তৈরি করলে ক্ষতি কী? কিন্তু দুঃখ হলো, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এবং জ্ঞানের অভাবে আমরা অর্থায়নের অনেক ভালো সুযোগ বারবার হারিয়েছি। হারিয়ে পরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং গ্যারান্টিতে হয় বিদেশ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ করতে চেয়েছি, অথবা নূ্যনপক্ষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার দ্বারা ঋণ করিয়ে মোট অর্থায়নের প্রয়োজনের একটি অংশকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছি। একটি বা দুটি উদাহরণ দিই। যে দিন বা দিনগুলোতে সরকারি মোবাইলফোন কম্পানি টেলিটক বাজারে সিম বিক্রয় করা শুরু করল, সেদিন টেলিটকের গ্রাহক হওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের কী হুমড়ি খেয়ে পড়া। আর সেই দিনগুলোতে আমাদের শেয়ারবাজারে শেয়ারের দারুণ স্বল্পতা বিরাজ করছিল। টেলিটক সেই দিন গ্রিনফিল্ড নিয়েও শেয়ার বেচতে চাইলে শত শত কোটি টাকার পুঁজি শেয়ারবাজার থেকে তুলতে পারত। কিন্তু কথাটা সেই দিন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কেউ ভাবেনি। ভাবেনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও কেউ। ফলে টেলিটক বাস মিস করেছে। আজকে টেলিটক অর্থাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। হয়তো এই কম্পানির একটি প্রাকৃতিক মৃত্যুই হবে। কেউ আর টেলিটকের শেয়ারও কিনবে না এবং সিম কেনার জন্যও কারো অতিরিক্ত উৎসাহ নেই।
এই বাস সরকার মিস করেছে কি জ্ঞানের ঘাটতির জন্য নয়? অন্য উদাহরণ হলো, সরকারি এয়ারলাইন্স বিমান বাংলাদেশ। এই সংস্থা ট্যাক্স পেয়ারদের হাজার হাজার কোটি টাকা হজম করে চলেছে। কিন্তু লাভ করছে বলে কেউ জানে না। শুধু লোকসানই এই সংস্থার নিয়তি। মধ্যখানে বাংলাদেশ সরকার এই সংস্থার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের জালে আটকা পড়েছে এবং পড়ছে। এভাবে বিশ্বের অন্য কয়টি বিমান সংস্থা চলছে? তাহলে আমরা কী করে বলি আমরাও শিক্ষিত? এই সংস্থা নিয়ে আমাদের সংসদে কয় মিনিট আলোচনা হয়েছে? পদ্মা ব্রিজ অর্থায়নের জন্য প্রথম শুনেছি ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। পরে শোনলাম, ২০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। যে অর্থ আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় সমান। তবে এই ব্রিজ অর্থায়নের উপায় কী? এ ক্ষেত্রেও সেই অর্ধশতাব্দী আগে থেকে আমাদের শিখিয়ে দেওয়া সেই অর্থায়ন পদ্ধতির সম্মুখীন হলাম। সেই পদ্ধতি হলো, বিদেশিদের বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হও। অর্থ আসবে আর পদ্মা ব্রিজ অর্থায়ন হবে! একবারও এই জাতির পলিসিমেকাররা চিন্তা করে দেখল না, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি যদি অর্থ না দেয়, তাহলে কী হবে। এটা ঠিক যে পুরো অর্থায়ন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমার দুঃখ লাগে, বিকল্প অর্থায়ন নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে ঘণ্টাদুয়েক আলোচনা হয়েছে কি না। ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অন্তত অর্ধেক অর্থ এই জাতি নিজেই জোগান দিতে পারত কিভাবে? এই ভাবে।
আপনি পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করে যমুনা, মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রিজকে ইকুইটি আকারে তথা শেয়ারে বিভক্ত করে জনগণের কাছে বেচুন। এই তিনটি ব্রিজের মূল্য কত? নিশ্চয়ই এক বিলিয়ন ডলার তো হবে। সেই অর্থ পদ্মা ব্রিজের জন্য কাজে লাগান। প্রশ্ন হতে পারে, লোকে যমুনা, মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রিজের শেয়ার কিনবে কেন? কিনবে একশবার। কারণ এই ব্রিজগুলো বাণিজ্যিকভাবে লোভনীয়। সরকার এসব ব্রিজ থেকে কোনো বাণিজ্য করতে পারছে না, সেটা তো সরকারেরই ব্যর্থতা। ব্যক্তি খাতে এবং কম্পানি বোর্ডের হাতে গেলে এসব ব্রিজ অবশ্যই লাভজনকভাবে চালানো সম্ভব হবে। এতে ফল হবে দুভাবে। এক. সরকার একসঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকা পেয়ে পদ্মা ব্রিজের কাজে হাত দিতে পারবে। দুই. এই ব্রিজগুলো লাভে চললে এই লাভ থেকেই দ্বিতীয় মেঘনা সেতু এবং দ্বিতীয় দাউদকান্দি সেতু নির্মাণ করা সহজ হবে। এসব ধারণা সওজ এবং সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে আসবে না। কারণ সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষ হলো সরকারি সংস্থা। এরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু দুঃখ হলো, এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষের লোকজন তো অর্থনীতি এবং ব্যবসা করেনি। তাদের কাছে পাবলিক লিমিটেড কম্পানির ধারণাই অপরিচিত। কিন্তু সরকারের মধ্যে তো কিছু লোকের এসব ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত। যে সময় সরকার বর্তমানে পদ্মা ব্রিজ অর্থায়নের জন্য এগোচ্ছে, এটা জাতির জন্য বোঝা হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
No comments