চিরকুট-গণক বানর by শাহাদুজ্জামান
মনে আছে, এক অভিনব ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি একটি ঝোলা কাঁধে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ডাক দিচ্ছিলেন, ‘বানর দিয়া গণনা করাইবেন?’ আমি কৌতূহলী হয়ে তাঁকে ডেকে জানতে চাইলাম—কী বৃত্তান্ত। তিনি জানান, তাঁর ঝোলার ভেতর যে বানরটি আছে, সেটি গণক বংশের।
এই বানরের আদি নিবাস শ্যামদেশ অর্থাৎ অধুনা থাইল্যান্ড। এই বিশিষ্ট বানরের বাবা, দাদাসহ পূর্বপুরুষেরা সবাই গণক ছিল। তিনি বলেন, এই বানরকে আপনি এমন একটি প্রশ্ন করতে পারেন, যার উত্তর আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না। বানর গণনা করে এর উত্তর বলে দেবে। আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে ব্যাপারটা ঘটবে? বানরের মালিক জানালেন, আমাকে তাঁর কানে কানে প্রশ্নটি করতে হবে। তারপর তিনি বানরকে কানে কানে সেই প্রশ্নটি বলবেন। এ সময় বানরের সামনে দুটি বিশেষ ধরনের কাঠি রাখা হবে। বানর প্রশ্নটি শুনে সেই কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করে গণনা করবে। গণনা শেষে বানর কাঠিটি মালিকের হাতে ফেরত দেবে। মালিক তখন মাটিতে বানরের করা আঁকিবুঁকিটি অনুবাদ করে আমাকে গণনার ফল জানাবেন। তবে শর্ত হচ্ছে, এই গণনার ফল আর কাউকে বলা যাবে না। তিনি এ-ও জানান, প্রতিটি প্রশ্ন বাবদ তাঁকে ৫০ টাকা দিতে হবে। আমি এই বিশিষ্ট বানরকে দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠি। তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ঝোলা থেকে বানরটি বের করেন এবং তমিজের সঙ্গে হাত তুলে স্যালুটের ভঙ্গি করেন। বিশিষ্ট বানর গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। মালিক বলেন, ‘এই বানর সম্মানী বংশের সন্তান, তারে একটু সন্মান দেখান।’ আমি অনুরোধমাফিক বানরের দিকে হাত তুলি। বানর প্রত্যুত্তরে হাত উঁচু করে পাল্টা জবাব দেয়। এরপর মালিক বলেন, ‘কোনো প্রশ্ন আছে আপনার? জটিল প্রশ্ন? যার উত্তর আপনি পাইতেছেন না। ধরেন, প্রেম, বিয়া, চাকরি—এই সব নিয়া কোনো প্রশ্ন?’
ভেবে দেখি, প্রেম, বিয়ে ও চাকরিবিষয়ক প্রশ্নগুলো জটিল ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা-চরিত্র করে উত্তর একটু-আধটু পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সত্যিই ভীষণ জটিল হয়ে উঠেছে, সেসব অন্য ঘরানার। যেমন ধরা যাক, রাজনীতির। রাজনীতির মঞ্চে যে পালাগানটি চলছে দীর্ঘদিন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করে এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘মায়ার খেলা’। কয়েক দশক ধরে এই মঞ্চে কত বিবিধ ধরনের সরকার তাদের পালা মঞ্চস্থ করল! নির্বাচিত সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক সরকার, সেনা-সমর্থিত সরকার ইত্যাদি। আমরা অন্ধকার প্যান্ডেলে বসে আলোকিত মঞ্চে সেই সব পালার মায়াবী, রহস্যময় সব খেলা দেখলাম। দেখলাম জাদুকরের ছোঁয়ায় সেখানে রুমাল হয়ে যায় খরগোশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিণত হয় গোয়েন্দা সরকারে, নির্বাচিত সরকার পরিণত হয় স্বৈরসরকারের পরম বন্ধুতে। ইতিমধ্যে এসব পালার পাত্র-পাত্রী, কাহিনি, সংলাপ আমাদের মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। বিশেষ গণনা ছাড়াই আমরা বলে দিতে পারি, সামনের পালায় নির্বাচন, সংসদ, হরতাল ইত্যাদি বিষয়ে যেসব দৃশ্য থাকবে, তাতে কী কী ঘটবে। কারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ বলবে, কারা বলবে ষড়যন্ত্র; কারা সংসদকে পবিত্র স্থান বলবে, কারা বলবে এর পরিবেশ দূষিত; কারা হরতালকে সফল করার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানাবে, আর কারা ধন্যবাদ দেবে হরতাল প্রতিহত করবার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মায়ার খেলা আর কত দিন চলবে? মঞ্চের ওই একই পুরোনো পালা লোকে আর কত দিন ঘুমঘুম চোখে দেখবে? নাকি এ প্যান্ডেল ভেঙে শুরু হবে একেবারে নতুন কোনো পালা? যে পালায় থাকবে মেধাবী সংলাপ, স্বপ্নজাগানিয়া কাহিনি, প্রজ্ঞাদীপ্ত পাত্র-পাত্রী। কিন্তু সেটা কি ঘটবে আদৌ? যদিও বা ঘটে, সেই পালা কি আর আমাদের জীবদ্দশায় দেখা হবে? বিবিধ মানুষ-পণ্ডিতের কাছে এ প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাইনি। ভাবলাম, এই ত্রিকালদর্শী বানরের কাছে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে! তা ছাড়া পশুজগতের তো কত রকম অতিপ্রাকৃত গুণাবলি থাকে, শুনেছি। ফলে এই সুযোগ হাতছাড়া করা সমীচীন হবে না বলে মনে হলো। আমি সরল ভাষায় আমার এই জটিল জিজ্ঞাসাটি বানরের মালিককে জানাই। অভিজ্ঞ গণক বানরের বুদ্ধিমান মালিক দ্রুতই বুঝে নিলেন আমার প্রশ্নটি। তবে বললেন, ‘পলিটিক্স নিয়া প্রশ্ন তো গণক বাবারে করি নাই, তবে চেষ্টা কইরা দেখতে পারি। কিন্তু আপনার প্রশ্ন তো দুইটা। পলিটিক্স বদলাইব কি না, আর বদলাইলে কবে? দুইটা প্রশ্নে ডাবল রেট দেয়া লাগবে। পঞ্চাশে পঞ্চাশে ১০০ টাকা।’ আমি ভেবে দেখলাম, আমার এই কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর যদি মাত্র ১০০ টাকায় মিলে যায়, তাতে আপত্তি কী? আমি রাজি হলাম।
বানরের মালিক এরপর বানরের কানে কানে আমার প্রশ্নটি বললেন। গণক বানর প্রশ্ন শুনে যথারীতি মাটিতে কাঠি দিয়ে বিবিধ আঁকাজোকা করে এবং একপর্যায়ে কাঠিটি তার মালিকের হাতে দেয়। বানরের মালিক তারপর গভীর মনোযোগসহকারে বানরকৃত ওই সাংকেতিক চিহ্নগুলো পাঠ করেন এবং আমাকে ব্যাখ্যা করে শোনান। আমি পরম আগ্রহে এই মহামূল্যবান প্রশ্নের উত্তর শুনি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, শর্ত অনুযায়ী, গণনার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার এখতিয়ার আমার নেই। তাই আমি গণনার ফলাফল পাঠকদের জানাতে অপারগ। তবে এটুকু বলতে পারি, গণনার ফল শোনার পর আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
ভেবে দেখি, প্রেম, বিয়ে ও চাকরিবিষয়ক প্রশ্নগুলো জটিল ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা-চরিত্র করে উত্তর একটু-আধটু পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সত্যিই ভীষণ জটিল হয়ে উঠেছে, সেসব অন্য ঘরানার। যেমন ধরা যাক, রাজনীতির। রাজনীতির মঞ্চে যে পালাগানটি চলছে দীর্ঘদিন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করে এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘মায়ার খেলা’। কয়েক দশক ধরে এই মঞ্চে কত বিবিধ ধরনের সরকার তাদের পালা মঞ্চস্থ করল! নির্বাচিত সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামরিক সরকার, সেনা-সমর্থিত সরকার ইত্যাদি। আমরা অন্ধকার প্যান্ডেলে বসে আলোকিত মঞ্চে সেই সব পালার মায়াবী, রহস্যময় সব খেলা দেখলাম। দেখলাম জাদুকরের ছোঁয়ায় সেখানে রুমাল হয়ে যায় খরগোশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিণত হয় গোয়েন্দা সরকারে, নির্বাচিত সরকার পরিণত হয় স্বৈরসরকারের পরম বন্ধুতে। ইতিমধ্যে এসব পালার পাত্র-পাত্রী, কাহিনি, সংলাপ আমাদের মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। বিশেষ গণনা ছাড়াই আমরা বলে দিতে পারি, সামনের পালায় নির্বাচন, সংসদ, হরতাল ইত্যাদি বিষয়ে যেসব দৃশ্য থাকবে, তাতে কী কী ঘটবে। কারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ বলবে, কারা বলবে ষড়যন্ত্র; কারা সংসদকে পবিত্র স্থান বলবে, কারা বলবে এর পরিবেশ দূষিত; কারা হরতালকে সফল করার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানাবে, আর কারা ধন্যবাদ দেবে হরতাল প্রতিহত করবার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মায়ার খেলা আর কত দিন চলবে? মঞ্চের ওই একই পুরোনো পালা লোকে আর কত দিন ঘুমঘুম চোখে দেখবে? নাকি এ প্যান্ডেল ভেঙে শুরু হবে একেবারে নতুন কোনো পালা? যে পালায় থাকবে মেধাবী সংলাপ, স্বপ্নজাগানিয়া কাহিনি, প্রজ্ঞাদীপ্ত পাত্র-পাত্রী। কিন্তু সেটা কি ঘটবে আদৌ? যদিও বা ঘটে, সেই পালা কি আর আমাদের জীবদ্দশায় দেখা হবে? বিবিধ মানুষ-পণ্ডিতের কাছে এ প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাইনি। ভাবলাম, এই ত্রিকালদর্শী বানরের কাছে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে! তা ছাড়া পশুজগতের তো কত রকম অতিপ্রাকৃত গুণাবলি থাকে, শুনেছি। ফলে এই সুযোগ হাতছাড়া করা সমীচীন হবে না বলে মনে হলো। আমি সরল ভাষায় আমার এই জটিল জিজ্ঞাসাটি বানরের মালিককে জানাই। অভিজ্ঞ গণক বানরের বুদ্ধিমান মালিক দ্রুতই বুঝে নিলেন আমার প্রশ্নটি। তবে বললেন, ‘পলিটিক্স নিয়া প্রশ্ন তো গণক বাবারে করি নাই, তবে চেষ্টা কইরা দেখতে পারি। কিন্তু আপনার প্রশ্ন তো দুইটা। পলিটিক্স বদলাইব কি না, আর বদলাইলে কবে? দুইটা প্রশ্নে ডাবল রেট দেয়া লাগবে। পঞ্চাশে পঞ্চাশে ১০০ টাকা।’ আমি ভেবে দেখলাম, আমার এই কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর যদি মাত্র ১০০ টাকায় মিলে যায়, তাতে আপত্তি কী? আমি রাজি হলাম।
বানরের মালিক এরপর বানরের কানে কানে আমার প্রশ্নটি বললেন। গণক বানর প্রশ্ন শুনে যথারীতি মাটিতে কাঠি দিয়ে বিবিধ আঁকাজোকা করে এবং একপর্যায়ে কাঠিটি তার মালিকের হাতে দেয়। বানরের মালিক তারপর গভীর মনোযোগসহকারে বানরকৃত ওই সাংকেতিক চিহ্নগুলো পাঠ করেন এবং আমাকে ব্যাখ্যা করে শোনান। আমি পরম আগ্রহে এই মহামূল্যবান প্রশ্নের উত্তর শুনি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, শর্ত অনুযায়ী, গণনার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার এখতিয়ার আমার নেই। তাই আমি গণনার ফলাফল পাঠকদের জানাতে অপারগ। তবে এটুকু বলতে পারি, গণনার ফল শোনার পর আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments