শ্রদ্ধাঞ্জলি-কিংবদন্তি সন্তোষদা by অসীম সাহা

আমি যখন ১৯৬৯ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি, তখন প্রথম দিকে যাঁদের সঙ্গে আমার সূচনা-পরিচয় ঘটে, তাঁদের মধ্যে সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন অন্যতম। তিনি তখন দৈনিক আজাদ-এ চাকরি করেন। তখনো বিয়েথা করেননি। আজাদ অফিসের কাছেই একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন।


কথাসাহিত্যিক প্রয়াত আহমদ ছফা আমাকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে আজাদ অফিসে দেখা করতে যান। কিন্তু তখনো তিনি অফিসে না আসায় আমরা তাঁর বাসায় চলে যাই। দরজায় টোকা দিতেই খুব ছোট্ট একটি জানালা খুলে যায় এবং তার মাঝখানের শিকের ওপার থেকে একটি মুখ আমাদের চোখের সীমানায় এসে ধরা দেয়।
সন্তোষ গুপ্তর সঙ্গে আহমদ ছফার পূর্ব-পরিচয় ছিল। আমি নতুন। তা সত্ত্বেও আমাকে নিয়ে তাঁর মধ্যে আমি কোনো প্রশ্নের উদয় হতে দেখিনি। তখন সন্তোষদাকে আমার খুব রাশভারী মানুষ বলে মনে হয়েছিল। তখন বুঝিনি, এটা তাঁর স্বভাবেরই অংশ, এক ধরনের ব্যক্তিত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে যখন আমার খানিকটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, তখন বুঝতে পারি, একজন কমিউনিস্টের মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়েই তিনি সব সময় চলতেন। ইতিমধ্যে সন্তোষদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আগেই সত্যেন সেনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। রণেশদা ও শহীদুল্লা কায়সারকে আমি দেখতে পাই দৈনিক সংবাদ অফিসে। আমি তখন নিয়মিত সংবাদে যাই। সত্যেনদার নারিন্দার বাসায় ছিল আমার নিত্যগমন। এরই মধ্যে আমার পরিচয় হয় কৃষকনেতা কমিউনিস্ট জীতেন ঘোষের সঙ্গে। তখন পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং আমাদের নিয়মিত আড্ডাস্থল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় জগন্নাথ হল থেকে বাংলাবাজারে যাই। সেখানেই আমার পরিচয় ঘটে দেশবরেণ্য লেখকসহ অনেক তরুণ লেখকের সঙ্গেও। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, কায়েস আহমেদ ও আবুল হাসানের সঙ্গে সে সময়ই আমার পরিচয় হয়। সৈয়দ শামসুল হককে আমি প্রথম দেখি সদরঘাটে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে লাগোয়া শঙ্কর বোর্ডিংয়ের সামনে ছোট্ট একটি ছাদে চলচ্চিত্রশিল্পের কলাকুশলীদের মধ্যমণিরূপে। এরপর একে একে আমি অনেককে চিনতে থাকি এবং ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটতে থাকে। কিন্তু আমি সত্যেনদা, জীতেনদা, রণেশদা, সন্তোষদা প্রমুখের সাম্যবাদী রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে মানসিক নতি স্বীকার করে সেই ঘরানার দিকে ঝুঁকে পড়ি। ফলে তাঁদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হয়ে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। সত্যেনদা কিংবা রণেশদার মতো না হলেও সন্তোষদার কাছেও আমার গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
সন্তোষদা দৈনিক আজাদ ছেড়ে যখন দৈনিক সংবাদে চলে আসেন, তখন তাঁকে আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি কাছে পাই। মাঝেমধ্যেই দেখা হয়, নানা বিষয়ে কথা হয়। আমার চেনা সন্তোষদা অনেকটাই তাঁর খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সম্পাদকীয় বিভাগে বসে নানা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনি।
সন্তোষদা যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। যুক্তি ছাড়া অকারণে মানুষের সমালোচনা করাকে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। নিজে যেমন খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন, তেমনি অন্যকেও সহনশীল হতে অনুপ্রাণিত করতেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, আদর্শবাদী এই মানুষটি কোনো লোভের কাছেই পরাজিত হয়ে নিজের আদর্শ থেকে সরে যাননি। সংবাদে কর্মচারীদের আর্থিক অনটন যখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন অনেকে বাধ্য হয়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে, আবার অনেকে আদর্শচ্যুত হয়ে সংবাদ থেকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সন্তোষদা যাননি। সংবাদকে তখন সবাই কমিউনিস্টদের পত্রিকা বলে মনে করতেন। তার কারণও ছিল। এই পত্রিকাতেই যেহেতু সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সারদের মতো কমিউনিস্ট নেতা কাজ করতেন এবং এর মালিক আহমদুল কবিরও বাম ঘরানার পত্রিকা হিসেবেই একে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, সেহেতু কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা যেমন সংবাদকে নিজেদের পত্রিকা বলে মনে করতেন, তেমনি অন্যরাও জানতেন এটা বামদের পত্রিকা। সন্তোষদা নিজে কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ। তাই সংবাদেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। টাকাটা তাঁর কাছে মুখ্য ছিল না। তাই শত অনটনেও সংবাদকেই আঁকড়ে ধরে থেকেছেন, এমনকি বেঁচে থাকার তাগিদেও নিজেকে একজন কমিউনিস্টের আদর্শের অবস্থান থেকে কখনো সরিয়ে নেননি। বিশেষভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যখন ক্রমেই কমে যেতে থাকে, তখন সন্তোষ গুপ্ত যেন অনড় পাহাড়ের মতো দারিদ্র্যকে নিত্যসঙ্গী করেও তাঁর পূর্বসূরি সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তদের আদর্শের প্রতীক হয়ে অন্যদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আদর্শবাদী মানুষকে কী করে তাঁর নিজের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
আমৃত্যু কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতীক এই অতিসাদাসিধে মানুষটিই সম্ভবত আমাদের পূর্বসূরি কমিউনিস্ট নেতাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে গেছেন। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পরও তিনি অন্যদের মতো নিরাশার বালুচরে মুখ থুবড়ে না পড়ে নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থেকেছেন। এ ধরনের আদর্শবাদী মানুষ আমাদের সমাজে এখন আর কোথায়? তাই আমাদের প্রয়োজন, সন্তোষ গুপ্তদের মতো মানুষরা আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন তাকেই আত্তীকৃত করে তাঁদের আদর্শকে মহিমান্বিত করে তোলা। আর তারই জন্য আজকের প্রজন্মের তরুণদের কাছে সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষদের আদর্শের পতাকা উড্ডীন করার যে দায়িত্ব পড়েছে, সেটা সমুন্নত রাখতে পারলেই মনে হবে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, জীতেন ঘোষ কিংবা শহীদুল্লা কায়সারদের জীবন ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থ হয়নি সন্তোষ গুপ্তর রেখে যাওয়া আদর্শের পতাকার মহিমান্বিত গৌরব। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা নিরহংকার, জ্ঞানী, আদর্শবাদী সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষদের চিরকালীন আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার করতে পারি।
অসীম সাহা

No comments

Powered by Blogger.