পঞ্চদশ সংশোধনী-বদলে দেওয়া হয়েছে মৌলিক কাঠামোর ধারণা by বদিউল আলম মজুমদার
সংগত কারণেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। আমি নিজেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি নিবন্ধে সংশোধনীর কয়েকটি দিকের ওপর আলোকপাত করেছিলাম। ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিণাম শুভ হবে না’ শিরোনামের লেখায় (১২ জুলাই ২০১১) আমি প্রধানত পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কথা—পূর্বনির্ধারিত কার্যপরিধি ছাড়া সম্পূর্ণ
একতরফাভাবে, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে সংশোধনীটি পাসের বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। সেই লেখায় আমি সংশোধনীর বিষয়বস্তুর কিছু দিকও তুলে ধরেছিলাম। পরবর্তী ‘সংবিধানের সমালোচনা করলে চরম দণ্ড!’ শিরোনামের লেখাটিতে (২১ জুলাই ২০১১) সংবিধান নিয়ে সমালোচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস চালিয়েছিলাম। তবু সংশোধনীর আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বহুলাংশে আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উপেক্ষিত বিষয় হলো সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন। আওয়ামী লীগ তার ‘দিনবদলের সনদে’ সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ নির্বাচন-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন (প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। এ ছাড়া এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারীসমাজের ঐক্যবদ্ধ দাবি রয়েছে। এসব অঙ্গীকার ও দাবি উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বর্তমান ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করা এবং একই ধরনের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আরেকটি উপেক্ষিত বিষয় হলো সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার বিধান। সাধারণভাবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন করা যায় না—এটি সংসদের সংবিধান সংশোধনের ওপর আদালত অর্পিত সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ সংসদ ইচ্ছা করলেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে না, যদিও মৌলিক কাঠামো সম্পর্কে বিচারকদের মধ্যে মতৈক্য নেই। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭খ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ৫৩টি অনুচ্ছেদসহ ‘সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন অযোগ্য’ করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে ৭খ অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক বিধানাবলী’ ও ‘মৌলিক কাঠামো’র মধ্যে বিভাজন করা হয়েছে, যে বিভাজনের কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। কিন্তু ৭খ অনুচ্ছেদে মৌলিক বিধানাবলিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে—মৌলিক কাঠামোর মতো মৌলিক বিধানাবলিকে অপরিবর্তনযোগ্য করা হয়েছে। সংসদের এই ক্ষমতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ এটি আদালতের ‘জুডিশিয়াল রিভিউ’ বা বিচারিক পর্যালোচনার সর্বজনস্বীকৃত ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫ সংযুক্ত করে সংসদে পাস করা সংবিধান সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে কোনো কারণেই আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সংযোজিত ৫ উপধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘সকল সন্দেহ দূর করার লক্ষ্যে ঘোষণা করা হলো যে, সংযুক্তকরণ, পরিবর্তন ও বাতিল করার মাধ্যমে সংবিধানের বিধানাবলী সংশোধনের সংসদের ক্ষমতার উপর কোনোরূপ সীমাবদ্ধতা থাকবে না।’ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মিনার্ভা মিলস লি. বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(১৯৮০) ৩এসসিসি৬২৫] মামলায় এ দুটি উপ-অনুচ্ছেদ অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন।
একটি বাস্তবসম্মত উদাহরণের মাধ্যমে মৌলিক কাঠামোর ধারণা সুস্পষ্ট করা যেতে পারে। একটি ইমারতের পিলারগুলো এর মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, কারণ এক বা একাধিক পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইমারত ধসে যেতে পারে। তবে দরজা-জানালা ভেঙে গেলে ইমারত ভেঙে পড়ে না। তাই পিলার ছাড়া দরজা-জানালা যেমন ইমারতের মৌলিক কাঠামো নয়, তেমনিভাবে কতগুলো সীমিত বিষয়ের (যেমন সংবিধানের ‘সুপ্রেমসি’, ধর্মরিপেক্ষতা, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি) বাইরের বিধানাবলিকেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলা যুক্তিসংগত নয়। তাই ৭খ অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক বৈধতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ৭খ অনুচ্ছেদের মৌলিক বিধানাবলি যুক্ত করলে আমাদের সংবিধানের আরও বিরাট অংশই অপরিবর্তনযোগ্য হয়ে পড়বে। তাই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর শুধু পরিধি বৃদ্ধিই নয়, এর ধারণাও পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘনেরই শামিল।
আরেকভাবেও ৭খ অনুচ্ছেদ আমাদের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রাধান্যের কথা বলা আছে, কারণ সংবিধানে নাগরিকের ‘এজন্ট’ হিসেবে প্রত্যেকের কার্যপরিধি নির্ধারিত আছে এবং সেই পরিধির মধ্যে থেকেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এমনকি সংবিধান সংশোধনও করতে হয় সংবিধান অনুসরণ করেই। তাই বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত এবং এগুলোকে সংশোধনের অযোগ্য করে সংবিধানের ওপর সংসদ নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, যে অপচেষ্টা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয়েছে।
অন্য একটি অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত বিষয় হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা পৃথক্করণের তত্ত্ব ব্যবহার করে সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তিনটি বিভাগের ওপর—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচার বিভাগ—ন্যস্ত করা হয়। এ তিনটি বিভাগকেই স্বাধীনভাবে, যদিও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে, দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারি কর্মকমিশনের সঙ্গে পরামর্শের বিধান বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়। একইভাবে ১১৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বিচারিক কার্যক্রমে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এককভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ করা হয়। তবে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরায় সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরামর্শের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চরমভাবে খর্ব করা হয়।
ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ বা কাঠামোর একটি এবং কোনোভাবে ও কোনো যুক্তিতেই এই স্বাধীনতাকে খর্ব করা যায় না। অর্থাৎ এটি অলঙ্ঘনীয়। তবে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার সাম্প্রতিক সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হবে না, যদি সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না হয়।’ তাই আদালত বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ যত দ্রুত সম্ভব পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংসদের কাছে আরজি রাখেন। একইভাবে গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ বাতিল হওয়া দশজন অতিরিক্ত বিচারকের মামলার ২০০৯ সালে প্রদত্ত রায়ে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, ‘সংবিধানের অসংশোধিত ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ যদি ফিরিয়ে না আনা হয়, তা হলে... বিচার বিভাগের পৃথক্করণ দূরের কান্না ও ঢোলের বাজনা হিসেবেই থেকে যাবে।’
শোনা যায়, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটি আদালতের অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মূল সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কমিটির উপপ্রধান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ ব্যাপারে একাধিকবার সুস্পষ্ট ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে পঞ্চম সংশোধনীর এবং ১১৫ অনুচ্ছেদকে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে পরিবর্তন করা হয়, সেভাবেই বহাল রাখা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি উচ্চ আদালতের একাধিক রায়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের সমতুল্য, যদিও রায় ঘোষণার আগেই সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও প্রতীয়মান হয়—সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের ওপর নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে।
মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও আলোচনায় আসেনি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদের মেয়াদ শেষের আগের ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও নবনির্বাচিতরা বিদ্যমান সংসদের মেয়াদ শেষের আগে সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না। অনেকের আশঙ্কা যে এই দুটি সংশোধনী সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কারণ সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারণ করা আছে, কিন্তু মেয়াদের শেষ ৯০ দিন সময়ে সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রহিত করার ফলে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন থেকে সংসদ সদস্যদের বিরত রাখা হতে পারে।
কিন্তু মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন হলে, পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা সংসদ সদস্যের সব মর্যাদা ও ‘ক্ষমতা’ (যেমন স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা ইত্যাদি) নিয়েই নির্বাচনে অবতীর্ণ হবেন। এ ধরনের ব্যবস্থা কি সব প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সমসুযোগ নিশ্চিত করবে? এ ছাড়া নির্বাচনকে ‘রিগ’ বা নির্বাচনে জালিয়াতি করতে পারে নির্বাহী বিভাগের অধীন প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ নয়; যদিও ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্যরা তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অসদাচরণে লিপ্ত হতে পারেন এবং সাধারণত তা করেও থাকেন। তাই মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে সহায়ক হবে বলে মনে হয় না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উপেক্ষিত বিষয় হলো সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন। আওয়ামী লীগ তার ‘দিনবদলের সনদে’ সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ নির্বাচন-পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন (প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। এ ছাড়া এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারীসমাজের ঐক্যবদ্ধ দাবি রয়েছে। এসব অঙ্গীকার ও দাবি উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বর্তমান ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করা এবং একই ধরনের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আরেকটি উপেক্ষিত বিষয় হলো সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার বিধান। সাধারণভাবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন করা যায় না—এটি সংসদের সংবিধান সংশোধনের ওপর আদালত অর্পিত সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ সংসদ ইচ্ছা করলেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে না, যদিও মৌলিক কাঠামো সম্পর্কে বিচারকদের মধ্যে মতৈক্য নেই। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭খ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ৫৩টি অনুচ্ছেদসহ ‘সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন অযোগ্য’ করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে ৭খ অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক বিধানাবলী’ ও ‘মৌলিক কাঠামো’র মধ্যে বিভাজন করা হয়েছে, যে বিভাজনের কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। কিন্তু ৭খ অনুচ্ছেদে মৌলিক বিধানাবলিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে—মৌলিক কাঠামোর মতো মৌলিক বিধানাবলিকে অপরিবর্তনযোগ্য করা হয়েছে। সংসদের এই ক্ষমতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ এটি আদালতের ‘জুডিশিয়াল রিভিউ’ বা বিচারিক পর্যালোচনার সর্বজনস্বীকৃত ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫ সংযুক্ত করে সংসদে পাস করা সংবিধান সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে কোনো কারণেই আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সংযোজিত ৫ উপধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘সকল সন্দেহ দূর করার লক্ষ্যে ঘোষণা করা হলো যে, সংযুক্তকরণ, পরিবর্তন ও বাতিল করার মাধ্যমে সংবিধানের বিধানাবলী সংশোধনের সংসদের ক্ষমতার উপর কোনোরূপ সীমাবদ্ধতা থাকবে না।’ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মিনার্ভা মিলস লি. বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(১৯৮০) ৩এসসিসি৬২৫] মামলায় এ দুটি উপ-অনুচ্ছেদ অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন।
একটি বাস্তবসম্মত উদাহরণের মাধ্যমে মৌলিক কাঠামোর ধারণা সুস্পষ্ট করা যেতে পারে। একটি ইমারতের পিলারগুলো এর মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, কারণ এক বা একাধিক পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইমারত ধসে যেতে পারে। তবে দরজা-জানালা ভেঙে গেলে ইমারত ভেঙে পড়ে না। তাই পিলার ছাড়া দরজা-জানালা যেমন ইমারতের মৌলিক কাঠামো নয়, তেমনিভাবে কতগুলো সীমিত বিষয়ের (যেমন সংবিধানের ‘সুপ্রেমসি’, ধর্মরিপেক্ষতা, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি) বাইরের বিধানাবলিকেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলা যুক্তিসংগত নয়। তাই ৭খ অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক বৈধতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ৭খ অনুচ্ছেদের মৌলিক বিধানাবলি যুক্ত করলে আমাদের সংবিধানের আরও বিরাট অংশই অপরিবর্তনযোগ্য হয়ে পড়বে। তাই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর শুধু পরিধি বৃদ্ধিই নয়, এর ধারণাও পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘনেরই শামিল।
আরেকভাবেও ৭খ অনুচ্ছেদ আমাদের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রাধান্যের কথা বলা আছে, কারণ সংবিধানে নাগরিকের ‘এজন্ট’ হিসেবে প্রত্যেকের কার্যপরিধি নির্ধারিত আছে এবং সেই পরিধির মধ্যে থেকেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এমনকি সংবিধান সংশোধনও করতে হয় সংবিধান অনুসরণ করেই। তাই বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত এবং এগুলোকে সংশোধনের অযোগ্য করে সংবিধানের ওপর সংসদ নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, যে অপচেষ্টা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয়েছে।
অন্য একটি অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত বিষয় হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা পৃথক্করণের তত্ত্ব ব্যবহার করে সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তিনটি বিভাগের ওপর—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচার বিভাগ—ন্যস্ত করা হয়। এ তিনটি বিভাগকেই স্বাধীনভাবে, যদিও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে, দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারি কর্মকমিশনের সঙ্গে পরামর্শের বিধান বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়। একইভাবে ১১৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বিচারিক কার্যক্রমে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এককভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ করা হয়। তবে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরায় সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরামর্শের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চরমভাবে খর্ব করা হয়।
ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ বা কাঠামোর একটি এবং কোনোভাবে ও কোনো যুক্তিতেই এই স্বাধীনতাকে খর্ব করা যায় না। অর্থাৎ এটি অলঙ্ঘনীয়। তবে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল মামলার সাম্প্রতিক সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হবে না, যদি সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না হয়।’ তাই আদালত বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ যত দ্রুত সম্ভব পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংসদের কাছে আরজি রাখেন। একইভাবে গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ বাতিল হওয়া দশজন অতিরিক্ত বিচারকের মামলার ২০০৯ সালে প্রদত্ত রায়ে বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, ‘সংবিধানের অসংশোধিত ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ যদি ফিরিয়ে না আনা হয়, তা হলে... বিচার বিভাগের পৃথক্করণ দূরের কান্না ও ঢোলের বাজনা হিসেবেই থেকে যাবে।’
শোনা যায়, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটি আদালতের অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মূল সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কমিটির উপপ্রধান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ ব্যাপারে একাধিকবার সুস্পষ্ট ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে পঞ্চম সংশোধনীর এবং ১১৫ অনুচ্ছেদকে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে পরিবর্তন করা হয়, সেভাবেই বহাল রাখা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি উচ্চ আদালতের একাধিক রায়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের সমতুল্য, যদিও রায় ঘোষণার আগেই সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও প্রতীয়মান হয়—সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের ওপর নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে।
মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও আলোচনায় আসেনি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদের মেয়াদ শেষের আগের ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও নবনির্বাচিতরা বিদ্যমান সংসদের মেয়াদ শেষের আগে সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না। অনেকের আশঙ্কা যে এই দুটি সংশোধনী সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কারণ সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারণ করা আছে, কিন্তু মেয়াদের শেষ ৯০ দিন সময়ে সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রহিত করার ফলে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন থেকে সংসদ সদস্যদের বিরত রাখা হতে পারে।
কিন্তু মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন হলে, পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা সংসদ সদস্যের সব মর্যাদা ও ‘ক্ষমতা’ (যেমন স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা ইত্যাদি) নিয়েই নির্বাচনে অবতীর্ণ হবেন। এ ধরনের ব্যবস্থা কি সব প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সমসুযোগ নিশ্চিত করবে? এ ছাড়া নির্বাচনকে ‘রিগ’ বা নির্বাচনে জালিয়াতি করতে পারে নির্বাহী বিভাগের অধীন প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ নয়; যদিও ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্যরা তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অসদাচরণে লিপ্ত হতে পারেন এবং সাধারণত তা করেও থাকেন। তাই মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে সহায়ক হবে বলে মনে হয় না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments