বাঙালির স্বপ্নপূরণের সারথি by মাহবুবা নাসরীন

এবারের একুশে পদকে ভূষিত অধ্যাপক এ. কে. নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অন্যতম পুরোধা এবং প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া এ. কে. নাজমুল করিমের কর্মজীবনের শুরু (১৯৪৬-৫১ ফেনী কলেজ ও ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক) থেকেই তার বৈচিত্র্যময় ও জ্ঞানগর্ভ লেখনীর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে।


বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান পঠন-পাঠনের গুরুত্ব যারা উপলব্ধি করেন তাদের মধ্যে নাজমুল করিমের সমাজ বিশ্লেষণধর্মী বিভিন্ন প্রবন্ধ ভারত ও বাংলাদেশের সমাজ চিন্তাবিদদের জন্য জুগিয়েছিল অফুরন্ত চিন্তার ভাণ্ডার। অধ্যাপক নাজমুল করিমের শিক্ষক অধ্যাপক অজিত কুমার সেন সমাজ, সংস্কৃৃতি ও সভ্যতা বিষয়ে ছাত্রের শাণিত বক্তব্য প্রীত ও সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পরামর্শ দেন সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্ব্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। তরুণ নাজমুল করিমের সুযোগ হয় প্রখ্যাত ফরাসি নৃ-বিজ্ঞানী লেভি স্ট্রসের সাহচর্যে আসার। লেভি স্ট্রস ১৯৫০ সালে ইউনেস্কোর সহায়তায় ঢাকা আসেন এবং নাজমুল করিমকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। ১৯৫১ সালে নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়টি পড়াতেন। ১৯৫১-৫২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখানে 'সরকার' ও 'সমাজবিজ্ঞান' এ দুটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তার দেশে প্রত্যাবর্তনের পর লেভি স্ট্রসের প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ইউনেস্কোর সহায়তায় সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে বিভাগের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. পেরি বেসাইনি। ১৯৬৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এ. কে. নাজমুল করিম। তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল :দি মডার্ন মুসলিম পলিটিক্যাল এলিট ইন বেঙ্গল, যা ১৯৮০ সালে দি ডিনামিক্স অব বাংলাদেশ সোসাইটি নামে প্রকাশ করে ভারতে বিকাশ পাবলিশিং হাউজ।
অধ্যাপক নাজমুল করিমের বাংলা গ্রন্থ রয়েছে ৬টি, বাংলা প্রবন্ধ ৩০টি, ইংরেজি গ্রন্থ দুটি ও ইংরেজি প্রবন্ধ ১৯টি। এ ছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থে তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রয়েছে। তার তরুণ বয়সের রচনাগুলোই যেমন, 'ভূগোল ও ভগবান' (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী, ১৯৪৬); 'সাম অ্যাসপেক্টস অব পপুলার বিলিভ্স অ্যামং মুসলিম অব বেঙ্গল' (১৯৫৫) এবং 'চেনজিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান' (১৯৫৬)। পরে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় 'চেনজিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ' নামে (১৯৭৬ সালে)। বইটি তৎকালীন বোদ্ধা সমাজের সামনে তুলে ধরে সমাজকে নিয়ে ভাবনার নতুন দিগন্ত। চলি্লশ দশকে তার রচিত 'মুসলিম অভিজাত ও মধ্যবিত্ত' (সঠিক সন-তারিখ জানা যায়নি) প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে। সম্ভবত মুসলমানদের শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে রচিত এটিই সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম রচনা। তিনি বলেছেন, 'কৃষক, মজুর, তাঁতি, জোলা এ ধরনের অসংখ্য শ্রমিক-মজুরই মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশ, কিন্তু সমাজের নেতৃত্ব তাদের হাতে নয়।' তার জীবনব্যাপী রচনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে তাহলো সামাজিক পরিবর্তন। সংস্কৃতির রূপান্তরেও (ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত, সঠিক সন-তারিখ জানা যায়নি। সম্ভবত চলি্লশের দশকের শেষদিকে) তার বক্তব্য হলো, ভবিষ্যৎ সমাজের রূপ নিয়ে বলা কঠিন। তবে তার গড়ন যে ভিন্ন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মতে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থান সংস্কৃৃতির রূপ দেয়। চলি্লশের দশকের তরুণ নাজমুল করিম ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার যে বক্তব্য দেন তা আমাদের আশাবাদী করে_ 'হিন্দু তার হিন্দু পুনরুত্থানের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে, মুসলিম তার প্যান-ইসলামের দাবী ছেড়ে দিয়ে শত শত বছর ধরে বাংলার মাটিতে গড়া নিজের কালচারকে বড় করে দেখবে।' তার রচিত 'ভূগোল ও ভগবান' (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী, ১৯৪৬) প্রবন্ধেও সেই একই সুর প্রতিধ্বনিত_ 'মানুষের ধর্মীয় চেতনা নিতান্ত ব্যবহারিক বুদ্ধি থেকেই এসেছে। প্রাচীন যুগে কৃষিকার্যের সুবিধার জন্য জ্বর, ব্যাধি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তির জন্য ভগবানের দরকার হয়ে পড়ে। এ ব্যবহারিক বুদ্ধির সাথে পারলৌকিক বা ঐশ্বরিক প্রেরণার কোন সম্পর্ক নাই।'
নাজমুল করিমকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বিশেষত তার সহপাঠী ও সমবয়সীরা। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ গুহ, যিনি ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক করিমের সহপাঠী ছিলেন। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গুহের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালের এক স্মৃতিচারণে গুহ উল্লেখ করেন, 'সে সময় একজন হিন্দু ছেলের সঙ্গে মুসলিম ছেলের বন্ধুত্ব হওয়া সহজ ছিল না।' কারণ তখন সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তানের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন চলছিল। রবিগুহ তার স্মৃৃতিচারণে নাজমুল করিমের সঙ্গে তার পত্রবিনিময় প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, নিউইয়র্ক থেকে ১৯৫২ সালে নাজমুল করিমের লেখা চিঠি 'অমূল্য সম্পদ আমার কাছে এবং যারা তাকে জানতে চায় তাদের কাছেও।' চিঠির সারাংশ হচ্ছে_'পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা তারও আগে থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার পথ নেই জেনে মানসিক প্রস্তুতি ও চেতনার বিকাশে তার চেষ্টার বিরাম ছিল না। আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মুক্ত চিন্তা ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা হয় পরবর্তীকালে তার ঐতিহাসিক রূপ আমরা দেখেছি। সমস্ত আপাতঃ পরিচয়ের বাইরে এই গতিশীল যুগ-পরিবর্তনে এক স্থপতি হিসেবে তার পরিচয় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।'
ষাটের দশকে লন্ডন প্রবাসী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকরা সম্মিলিতভাবে আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের প্রতিবাদ জানাতে একটি সংগঠন গড়ে তোলে, যার নাম দেওয়া হয় 'কমিটি ফর দি রেস্টোরেশন অব ডেমোক্রেসি ইস্ট পাকিস্তান/সিআরডিপি'। এর নেতৃত্বে বেশিরভাগ ছিলেন বামধারার ছাত্র ও কর্মী। সংগঠনে 'পাকিস্তান টুডে'র সম্পাদক হামজা আলভী ছিলেন নেতৃস্থানীয় কিন্তু তিনি ও তার অনেক সহযোগী বাম রাজনীতি করলেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। তখন পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাঙালি সিআরডিপি সদস্যরা অনুভব করলেন সংগঠনটি বাঙালিদের স্বপ্নপূরণের আন্দোলনে ভূমিকা রাখছে না। তখন বাঙালিরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৬২ সালের ২৬ মে লন্ডনের ২৪ গ্রেট ইউন্ডমিল স্ট্রিটে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত করেন। গঠিত হয় সাত সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি, যার সভাপতির দায়িত্ব পান অধ্যাপক এ. কে. নাজমুল করিম। ১৬ জুন, ১৯৬২ সালে লন্ডনের ইস্টার্ন হেরাল্ড এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করে ও একাডেমীর বিস্তারিত কার্যক্রম তুলে ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সভাপতি হিসেবে বাংলা একাডেমীর যে শুভসূচনা করেন, সে সংবাদসহ ছাত্র, যুবক, শ্রমজীবী মানুষ ও ব্যবসায়ী সম্প্র্রদায়ের অংশগ্রহণে বাংলা একাডেমীর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুই হাজার পাকিস্তানি রুপির (১৫০ পাউন্ড) তহবিল গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথমবারের মতো পাঠ্যবই হিসেবে 'সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ' তুলে দেন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের হাতে।
দু'জন জাতীয় অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন ও সরদার ফজলুল করিমের রচনা ও বক্তৃতায় সমাজবিজ্ঞানী নাজমুল করিমকে উপলব্ধি করতে কিছুটা সক্ষম হই। তবুও তার ওপরে আমরা কোনো কোর্স রাখিনি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই। নাজমুল করিম মেমোরিয়াল লেকচার প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় না। প্রতিষ্ঠিত হয়নি নাজমুল করিম চেয়ার। শুধু স্মারকগ্রন্থটি (১৯৮৪) প্রকাশিত হয়েছে (এ তিনটি সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় ১৯৮২ সালের ১৮ নভেম্বর অধ্যাপক নাজমুল করিমের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির সভায়)। তাকে স্মরণের মাধ্যমে আমাদের এত গ্গ্নানি ঘুচবে না জানি।

No comments

Powered by Blogger.