সমকালীন প্রসঙ্গ-সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থাতেই সমাধান by আবু সাঈদ খান

এখানে দেখা যায়, দুই লাখ ভোটে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। কিন্তু একটি দল সারাদেশে ১০ লাখ ভোট পেয়েছে, সে দলের সংসদে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এটি কি ওই দল ও ১০ লাখ ভোটারের প্রতি অবিচার নয়? জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিবর্তন করে এমন অবিচারের অবসান সম্ভব।


বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা ভোটদান প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবছি, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব বিধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখছি না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এখানে এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেছে, যা ব্রিটেন ও তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোয় অনুসৃত হচ্ছে, কিন্তু স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিকল্প প্রতিনিধিত্ব বিধান রয়েছে, যাকে বলা হয় প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন সিস্টেম। সে পদ্ধতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে

উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার আলো দেখা দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল পূর্বের অনড় অবস্থানে নেই। বিরোধী দল সংবিধানে হুবহু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি থেকে সরে এসেছে। বিরোধী দলের নেতাদের কথায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে রাজি। বিরোধী দলের উদ্দেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন_ যা প্রস্তাব আছে, সংসদে এসে বলুন। আলোচনা কোথায়, কখন, কীভাবে হবে_ সেই বিতর্কই এখন প্রধান। ইতিমধ্যে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধিকাংশ শরিক দলই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদ্ধতির দিকেই রাজনৈতিক হাওয়া বইছে। কোনো অদৃশ্য ঘটনায় নাজেল না হলে এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কি অর্থবহ নির্বাচন হবে?
১৯৯১ থেকে ৪টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্পন্ন হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ ছাড়া বলা যায়, এ নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দেশ-বিদেশের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা এর ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। বাইরে নির্বাচন প্রক্রিয়া যতই স্বচ্ছ হোক, সব ক'টি নির্বাচনেই নীরবে কালো টাকা ও পেশিশক্তির আধিপত্য যে ক্রিয়াশীল ছিল, তা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেছে। এতে পেশিশক্তি ও কালো টাকা ব্যবহারের কলাকৌশলে পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবহার বন্ধ হয়নি। কীভাবে বন্ধ হবে, সেটিই ভাববার বিষয়।
পেশিশক্তি ও কালো টাকার ব্যবহারের কারণ কারও অজানা নয়। আশির দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে 'নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন ও গণতন্ত্র' চালু করেন। সেই প্রক্রিয়ায় দলপ্রধানের আশীর্বাদে যে কারও সাংসদ ও মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকায় দলছুট-আদর্শছুটদের পাশাপাশি ব্যাপকসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি আমলা ও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করা দরকার যে, আমলা ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। তারা যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে আসীন হন, কর্মী থেকে নেতা হন তবে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে, রাজনীতিতে যোগ দিয়েই আমলা ও টাকাওয়ালারা হঠাৎ নেতা বনে যান। এদের হাতেই রাজনীতি হচ্ছে কলুষিত এবং দুর্বৃত্তায়িত। তবে সূচনাতেই তা রুখে দিতে পারত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু তারা তা না করে জেনারেলদের সৃষ্ট পথেই অগ্রসর হন। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হলেও টাকার বিনিময়ে নেতা হওয়ার নোংরা সংস্কৃতির অবসান ঘটেনি। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো টাকাওয়ালাদের জন্য খুলে দেয় দলের দরজা।
নির্বাচনে যে মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু হয়েছে তা যে কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য লজ্জার। কিন্তু এ লজ্জাজনক প্রক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে জাতীয় নির্বাচনে, এমনকি স্থানীয় নির্বাচনেও। এভাবে রাজনীতিতে কালো টাকাওয়ালা-আমলা-পেশিধারীদের দাপট বাড়ছে। ত্যাগী ও আদর্শবাদীদের হতে হচ্ছে বিতাড়িত। ক্ষমতামুখী দলগুলো সযত্নে এ সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো তফাত নেই।
মৌসুমি রাজনীতিকদের কাছে রাজনীতি ব্যবসা। তাই তাদের সংসদে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। তাদের প্রয়োজন সাংসদের তকমা, মন্ত্রিসভার আসন। সংসদে গিয়ে নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়নের চেয়ে সচিবালয়ে গিয়ে তদবির করাটাই তাদের পছন্দের ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, বিরোধী দলের সাংসদরা আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ বর্জন করছেন আর ক্ষমতাসীন দলের সাংসদদের একাংশ সংসদ বর্জন করছেন অনানুষ্ঠানিভাবে। সংসদে উপস্থিত হওয়ার নৈতিক তাগিদ তাদের মধ্যে অনুভূত হয় না। তাই আজ কার্যকর সংসদ গড়তে হলে রাজনীতিকদের কাছে রাজনীতির প্রত্যাবর্তন দরকার। কেউ বলতে পারেন যে, এ ব্যাপারে আইনি বাধা নেই। কথাটি আপেক্ষিক সত্য। কিন্তু দেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে বিধান রয়েছে তা কতটা যৌক্তিক ও সময়োপযোগী?
এখানে দেখা যায়, দুই লাখ ভোটে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। কিন্তু একটি দল সারাদেশে ১০ লাখ ভোট পেয়েছে, সে দলের সংসদে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এটি কি ওই দল ও ১০ লাখ ভোটারের প্রতি অবিচার নয়? জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিবর্তন করে এমন অবিচারের অবসান সম্ভব।
আমরা ভোটদান প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবছি, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব বিধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখছি না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এখানে এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেছে, যা ব্রিটেন ও তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোয় অনুসৃত হচ্ছে, কিন্তু স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিকল্প প্রতিনিধি নির্বাচন বিধান রয়েছে, যাকে বলা হয় প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন সিস্টেম। সে পদ্ধতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
এ বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী এলাকা। এখানে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। ধরা যাক, সমগ্র ভোটের হিসাবে এক শতাংশ ভোটে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। সে অনুযায়ী কোনো দল ১ শতাংশ ভোট পেলে একজন প্রার্থীকে সংসদে পাঠাতে পারবে। একইভাবে ২০ শতাংশ ভোট পেলে সে দলের
২০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।
জেলাগুলো নির্বাচনী এলাকা হতে পারে। তখন বাংলাদেশে নির্বাচনী এলাকা হবে ৬৪টি। ধরা যাক, ময়মনসিংহের ভোটার অনুযায়ী আসনসংখ্যা ১৬টি। তাই অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রার্থিতা তালিকায় ১৬টি করে নাম থাকবে। সেক্ষেত্রেও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সদস্য নির্বাচিত হবেন। নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে।
এ জনপ্রতিনিধিত্ব বিধানের সুবিধার দিক হচ্ছে, নির্বাচিত হতে কোনো ব্যক্তির এককভাবে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণেই টাকার খেলা হবে না। কমে আসবে পেশির দাপট। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের ওয়াশআউট হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে দেশের আদর্শভিত্তিক যেসব ছোট দল রয়েছে তাদের পার্লামেন্টে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। এভাবেই বর্তমানের নির্জীব সংসদ হতে পারে মেধাবীদের অংশগ্রহণে আরও প্রাণবন্ত। এ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে আঞ্চলিকতাসহ যেসব অরাজনৈতিক ও সুবিধাবাদী প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা লোপ পাবে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, হঠাৎ করে এ ধরনের বিধানে যাওয়াটা কতটুকু বাস্তবসম্মত? জনগণের কাছে মনে হতে পারে, প্রতিনিধি তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। জনগণ সাংসদদের নাগালের মধ্যে চায়। কারণ, তারা স্থানীয় সমস্যাগুলো তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, সমাধানও চাইতে পারে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি উন্নয়নের জন্য জনগণকে সাংসদদের কাছে যেতে হয়। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী এটি সাংসদদের কাজ নয়। সাংসদদের কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ। কিন্তু তা অবহেলা করে স্থানীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন তারা। এটি সংসদের প্রতি অমনোযোগের অন্যতম কারণ। এ প্রবণতার জন্য স্থানীয় সরকার কার্যক্রমেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সাংসদদের ভূমিকার বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। কোনোক্রমে তারা যাতে অন্যের কর্মসীমানায় প্রবেশ করতে না পারেন, সে আইনি পদক্ষেপও প্রয়োজন।
তারপর বলতে চাই, হঠাৎ করে একটি ভিন্ন ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে দুটি ব্যবস্থার সমন্বয় হওয়াটাই যৌক্তিক। সেটি হচ্ছে মিশ্র পদ্ধতি। এটি জার্মানি, মেক্সিকো, ইতালি, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব দুই-ই আছে। সদস্যের অর্ধেক বা নির্দিষ্টসংখ্যক প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। ধরা যাক, বাংলাদেশের সাংসদের সংখ্যা ৩০০ হলে তা হবে এলাকাভিত্তিক ১৫০ এবং ভোটের অনুপাতে ১৫০। কিংবা ৬০০ হলে তা হবে এলাকাভিত্তিক এবং ভোটের অনুপাত অনুযায়ী ৩০০+৩০০ = ৬০০। এমনই একটি যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতির কথা ভাবা যেতে পারে। বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবি প্রভৃতি দল এ ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে। কিন্তু এর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এ বিধান রাজনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে, প্রবর্তন করতে পারে আদর্শবাদী ধারা। এটি ভাবার সময় এখনই।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.