এক খণ্ড মেঘের আকাশে লাল-নীল রং কে ফিরিয়ে দেবে by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

মেঘ' শব্দটা আমাদের নাগরিক জীবনে সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছিল ১৯৭৬ সালে, যখন হারুন আর রশিদের পরিচালনায় 'মেঘের অনেক রঙ' ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবির নায়িকা ছিলেন নেপালি মেয়ে মাথিন এবং বাংলাদেশের ওমর আলী। সেই থেকে মেঘ শব্দটা কেন জানি আমাদের হৃদয়কে বড় বেশি ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ করে।


সত্যিই তো মেঘ আর রং- শব্দ দুটি বড় কাছাকাছি, বড় আপন। শব্দ দুটি বড্ড ব্যঞ্জনামুখর। আকাশে চোখ মেললে নানা রকম মেঘের ছড়াছড়ি দেখা যায়। সাদা, কালো, ধূসর, লাল, নীল আরো কত রঙের মেঘ! সেই মেঘের রং কার না মনে নতুন উৎফুল্লতা আনে! কার না মনে নব আনন্দের ঢেউ তোলে!
অনুমানেই বলছি, 'মেঘের অনেক রঙ' এমন সুন্দর নামে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তোবা নিহত হওয়া আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি রুনি-সাগর তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারের নাম রেখেছিল 'মেঘ'। নিশ্চিত দুজনের স্বপ্ন বিস্তৃত ছিল এ রকম- প্রিয় সন্তান মেঘ আস্তে আস্তে বড় হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা রং ছড়াবে। ঝলমল হবে মেঘের আকাশ। মেধায়-মননে, বিশুদ্ধতায়-উৎকর্ষে, সংগ্রামে-সৃজনে মেঘ দ্রষ্টব্য হয়ে উঠবে সর্বত্র। মেঘের জীবনের শত সফলতার নানা রং তাঁদের দুজনের জীবনে এনে দেবে পরিপূর্ণতা। মানুষ দেখবে, এক খণ্ড মেঘের জীবনে কত রং, কত বর্ণচ্ছটা, কত আনন্দের অবগাহন। কিন্তু এসব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে অকস্মাৎ যেন বজ্রপাতের মতো। মেঘের আকাশ থেকে সরে গেছে সব রং। সব স্বপ্ন আর আনন্দ। ছোট্ট মেঘ এখন একা, নিঃসঙ্গ। সহস্র, লক্ষ জন চারপাশে থাকলেও মেঘের আকাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। স্বভাবতই আকাশ না থাকলে মেঘ কোথায় উড়বে? যে আকাশজুড়ে মেঘ নিত্য আহ্লাদে, আবদারে, ভালোবাসায় লুটোপুটি খেত, সেই মেঘ নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাসে এক করুণ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। মেঘ যেন সবার কাছেই এখন কান্না ও শোকের এক উপলক্ষ। মেঘ যেন বেদনা আর দীর্ঘশ্বাসের আহাজারি। মেঘের কোলে কোনো রোদ, কোনো আলো নেই। এক রহস্যময় নির্মম নিষ্ঠুরতায় মেঘ প্রিয় মা-বাবাকে হারানোর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে। মুহূর্তেই বদলে গেছে এই কোমল শিশুর জীবন। মেঘের যে জীবনে রং ছিল, আনন্দ-উল্লাস ছিল, স্বপ্ন ছিল- সেই জীবন এখন বড্ড বিপদাপন্ন-সংকটময়। মেঘ আগে যে চেয়ারে বসে লেখাপড়া করত, যে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেত, যে বিছানায় মা-বাবার কোলে ঘুমিয়ে থাকত; তার সব কিছু নিষ্ঠুর ঘাতকরা বদলে দিয়েছে। মেঘের মা-বাবাকে কারা খুন করেছে, কেন খুন করেছে- এ সবই রহস্যাবৃত। পুলিশ, মিডিয়াকর্মীরাও কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। পুলিশের দক্ষ গোয়েন্দারাও মূল রহস্য অনুসন্ধানে, উন্মোচনে হিমশিম খাচ্ছেন। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। সে সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। চারদিকে নানা গুঞ্জন ও গুজব। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও আম-জনতা জানতে পারেনি এই নির্মম হত্যা কারা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে। হত্যার কারণই বা কী। কেনইবা এভাবে দুটি সাংবাদিকের প্রাণ ঝরে গেল। কেনই বা ছোট্ট মেঘকে এভাবে মা-বাবাকে চিরজীবনের জন্য হারাতে হলো। মেঘের জন্য দেশের সব মানুষের মন-প্রাণ কাঁদছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমার নিজেরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, পরিচিতজন ফোন করে জানতে চান মেঘের কথা। কেমন আছে মেঘ? এ প্রশ্নের উত্তর সবাই কমবেশি প্রত্যাশা করেন। আমিও অসংখ্যবার মেঘের কথা ভেবে ভেবে আনমনা হই। ভাবি, কতটা আচমকা এই শিশুটি চিরকালের জন্য মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত হলো। কতটা সংকটাপন্ন হলো তার জীবন। মেঘ একদিন বড় হবে। বড় হয়ে এ সমাজকে সে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? আত্মীয়-স্বজনের প্রতিই বা তার দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? একসময় মেঘও তো বলবে, মা-বাবার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রত্যাশী সে। টেলিভিশন পর্দায় মেঘকে দেখালে কমবেশি সবাই বেদনার্ত হন। মেঘের কোমল অথচ আশ্চর্যবোধক চাহনি আমাদের বাকরুদ্ধ করে। আমাদের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। নিঃসঙ্গ আকাশে মেঘ আস্তে আস্তে বড় হবে। লেখাপড়া শিখবে। কিন্তু মা-বাবা হারানোর স্মৃতি সে কোনো দিন হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না- এটাই সত্য। সারা জীবনই তাকে এক অনন্ত কষ্টের পাহাড়সম ভার বহন করতে হবে। কিন্তু কেন এই মাসুম শিশুকে আমরা এমন এক দুঃসহ পরিস্থিতির ভেতর নিপতিত করলাম? কেন আমরা মেঘের আকাশ থেকে তার স্বপ্নের সবটুকু লাল-নীল রং কেড়ে নিলাম? এর জন্য কি দায়ী শুধুই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র-না কি অন্য কিছু। আমাদের বোধ হয় অনেক কিছুই এখন ভাবার এবং বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। সময় এসেছে সামাজিক সম্পর্কগুলোও একটু নেড়েচেড়ে দেখার। কেন ঠুনকো কারণে অযথা আমাদের সম্পর্কের বন্ধন দ্রুতই ঢিলা হয়ে পড়ে, ভেবে দেখতে হবে। কেন আমাদের প্রিয় সন্তান মেঘরা এত অল্প বয়সে বিপদাপন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়- এ সবই ভেবে দেখতে হবে। মেঘের আকাশে লাল-নীল রং কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে কি? আমাদের মেঘরা যাতে আমাদের কারণে বিপদাপন্ন না হয়, সেই সামাজিক সতর্কতা খুবই জরুরি। মেঘ আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। সবশেষে বলব, আমাদের মাহির সরওয়ার মেঘ আকাশ হারালেও আমরা তার জীবনের লাল-নীল রং ফিরিয়ে দিতে চাই। বেঁচে থাকুক মেঘ আমাদের সবার শুভ কামনায়। মেঘ, তুমি ক্ষমা করো আমাদের সবাইকে। আমরা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, অনেক কষ্ট...।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.