চারদিক-‘এখন নাম লিখতে পারি’ by আকমল হোসেন

চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষ ও চা-গাছের পাতায় সন্ধ্যার রং লেগেছে। কাছে কোথাও বাঁশি বাজছে। কিছু পরেই বাঁশিওয়ালাকে দেখা যায়। আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে হাঁটছিল মনজু গোঁসাই (১৬)। নাম লিখতে পারে কি না, জানতে চাইলেই হাতের বাঁশিটা বাঁ হাতে চেপে চা-বাগানের বটতলার লালচে মাটিতেই ডান হাতের আঙুলে নিজের নাম লিখতে বসে।


মাটির বুকে আঙুলের রেখায় ফুটিয়ে তোলে তার ও বাগানের নাম। এরপর আপন মনে ‘পড়ালেখা হইলো গুপ্তধন। এটা হইল অমূল্য ধন। এটা জানা থাকতে হইব না!’ কথাগুলো বলতে বলতে লাইনের (চা-শ্রমিকদের বসতবাড়ি) দিকে হেঁটে গেল সে। কুলাউড়া উপজেলার সিরাজনগর চা-বাগানের একজন চা-শ্রমিকের সন্তান এই মনজু। শুধু সে নয়, এই গুপ্তধন সংরক্ষণ করতে সিরাজনগর চা-বাগানের স্কুলগামী শিশু লিপি রাজবংশী, মুন্না কানু, শিল্পী মিরধা থেকে শুরু করে ৮০ বছরের আনোয়ারা বেগম, ৭০ বছরের হেরিসন গারো—সবাই এখন আর কিছু না হোক, নিজের নামটি লিখতে পারে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত চা-বাগান হিসেবে সিরাজনগর চা-বাগানকে ঘোষণা করেছে গত ৭ মে।
এই অবস্থা মাস কয়েক আগেও ছিল না। বাগানের হয়তো ১০ শতাংশ লোক লেখাপড়া জানতেন। অন্যরা টিপ-সইনির্ভর। একটি বেসরকারি সংস্থা পল্লি উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের তরুণ বদরুল হোসেন খান ও তাঁর সহকর্মীদের আড়াই-তিন মাসের চেষ্টায় বাগানের প্রায় সবাই এখন নিজের নাম সই করতে পারে। বাগানের ১ নম্বর লাইনের রামসিং কৃষ্ণ গোয়ালা (৫০) বলেন, ‘কাজেকামে থাকি। লেখাপড়া শিখিনি। টেকা-পয়সা তুলতে দস্তখত চায়। খারাপ লাগত।’ ৩ নম্বর লাইনের চা-শ্রমিক সাপিয়া বেগমের (৩২) সঙ্গে চা-বাগানের বটতলা মাঠে দেখা। কোথাও যাচ্ছিলেন। আলাপ তুলতেই হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন নাম লিখতে পারি। কত ভালো লাগে!’ সাদা কাগজে চটজলদি লিখে ফেললেন ‘সাপিয়া’। ২ নম্বর লাইনের দুই সন্তানের মা বিশাখা কৈরী (৩০) বলেন, ‘নাম লিখতে পেরে খুউব ভালো লাগছে। মাস্টারনি শিখাইছে। কুনু টাকা-পয়সা নেয়নি। তাঁরা শিখানির সময় মিষ্টিও (বিস্কুট-জিলাপি) খাওয়াইছে।’ ৫ নম্বর লাইনের মালতি ভূমিজ বলেন, ‘এই দুই মাস হইল নাম দস্তখত শিখছি।’
এ অবস্থা তৈরি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বদরুল ইসলাম খানকে। তিনি জানান, পল্লি উন্নয়ন ফাউন্ডেশন চা-বাগানের বাইরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কাজ করে। তাঁর ইচ্ছা হলো চা-বাগানেও কিছু করার। বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করলে কর্তৃপক্ষ সম্মতি দিল। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাফিজুর রহমান চৌধুরীর উপস্থিতিতে নিরক্ষরমুক্ত করার কাজ শুরু হয়। প্রথমে চা-বাগানের একটি শিশুকেন্দ্রে নারী-পুরুষদের ডাকা হলো। কেউ এলেন না। লাইনের একটি স্থানে ডাকা হলো, তাতেও সাড়া মেলেনি। এরপর তাঁরা অন্যভাবে এগোলেন। কাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাগজে, স্লেটে ও মাটিতে—যখন যে রকম সুবিধা; সেভাবেই শ্রমিকদের নাম লেখাতে শুরু করলেন। ছুটলেন লাইনের ঘরে ঘরে। এতে কিছুটা সাড়া মিলল। কিন্তু সবাই আগ্রহী হলেন না। পরে বিনোদন ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হলো। এতেই লজ্জার খোলস ভেঙে পড়ে। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন। প্রায় আড়াই মাসেই সাফল্যের দেখা মেলে। বদরুল হোসেন খান বলেন, ‘প্রথমে তাঁরা আসতে চাননি। ঘরে ঘরে গিয়েছি। এতে আমরা সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা নিইনি। কিন্তু সহযোগিতা পেলে দেশের অন্যান্য চা-বাগানকেও এভাবে নিরক্ষরমুক্ত করতে পারব।’ বাগানটির জনসংখ্যা হচ্ছে ৪১৮।
চা-বাগানের ২ নম্বর লাইনের সর্দার শ্যামলাল পাঁশী (৩৭) বলেন, ‘৮০-৯০ শতাংশই নাম দস্তখত পারত না। বাগানে স্কুল নাই। দূরে স্কুল। ছোটদের এত দূর দেওয়া যায় না। এরা ঘরে ঘরে গিয়ে শিখাইছে। কোনো কিছু তুলতে গেলে দস্তখত লাগে। সবাই খুশি।’ চা-বাগান পঞ্চায়েত সর্দার অনিল গোয়ালা বলেন, ‘কিস্তি তুলতে, বোনাস তুলতে টিপ-সই লাগে। এখন দস্তখত দিব।’ পল্লি উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের এক কথা ছিল আমরা পাতিত (পাতা) তুলব। শিখার দরকার নাই।’ শিক্ষক সুমিত্রা গোয়ালা বলেন, ‘ঘরে ঘরে গিয়ে স্লেট দিয়ে চক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করেছি। এক সপ্তাহ চেষ্টার পর শরম ভেঙে গেছে।’ চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক কাজেম আলী কোরেশী রিজভী বলেন, ‘মোটামুটি ছোট থেকে বড় সবাই এখন স্বাক্ষর দিতে জানে। আগে এ রকম ছিল না।’
সিরাজনগর চা-বাগানের ব্যবস্থাপক মানবেন্দ্র কিশোর দেব তাঁর বাগানের কার্যালয়ে বসে বলেন, ‘যা কৃতিত্ব বদরুল হোসেন খানের। আমরা শুধু সমর্থন দিয়েছি। অনেকের ধারণা, বাগান কর্তৃপক্ষ চা-শ্রমিক লেখাপড়া জানুক—এটা চায় না। এই ধারণা ঠিক না। লেখাপড়া জানা থাকলে কমনসেন্স ডেভেলপ করে।’
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, সই করিয়েছি, পড়িয়েছি। দেখেছি ঠিক আছে। বেশ আনন্দের সঙ্গে নিয়েছে সবাই। বলেছে, এখন আর আমাদের ঠকাতে পারবে না। এটা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ।’
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.