বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৪৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. মতিউর রহমান, বীর প্রতীক কুশলী এক মুক্তিযোদ্ধা কাঁচপুর সেতু পেরিয়ে বামে নরসিংদীগামী সড়ক। এই সড়কের বাবুরহাট থেকে জিনারদীর দূরত্ব আনুমানিক সাত মাইল।
এর মাঝামাঝি পাঁচদোনা। নরসিংদী থেকে জিনারদীর দূরত্ব তিন মাইল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাঁচদোনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মো. মতিউর রহমান। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য তাঁর নেতৃত্বে তাঁরা ময়মনসিংহ থেকে সেখানে সমবেত হন।
পাঁচদোনায় সড়কের দুই ধারে ছিল ঝোপঝাড়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন স্থানীয় দুঃসাহসী কয়েকজন গ্রামবাসী। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন।
মো. মতিউর রহমান নিজেই ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে সড়কে নজর রেখেছিলেন। সেদিন সড়ক জনশূন্য। একসময় তিনি দেখতে পান, সড়কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোটা পাঁচেক সেনাবাহী লরি। পেছনে আরও কয়েকটি সেনাবাহী গাড়ি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাবুরহাটের দিক থেকে।
গত কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় তেমন কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। সেদিনও কোথাও হয়নি। জনশূন্য পথে তারা বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আসছিল। সামনের লরিগুলো অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র মো. মতিউর রহমান সংকেত দেন। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত পল্লি-প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার দলের ছোড়া তিনটি মর্টারের গোলার একটা গোলা পড়ে লরির ওপর। একই সময় গর্জে ওঠে তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে থাকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র।
তখন পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এমন অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে পড়তে হবে, তা ওরা ভাবতেই পারেনি। প্রথম ধাক্কাতেই হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা অবশ্য কিছুক্ষণ পর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
মো. মতিউর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। তাঁর সাহসিকতা দেখে সহযোদ্ধারা আরও উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলে কয়েক ঘণ্টা।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। হতাহত হয় শতাধিক সেনা। তিনটি লরি অচল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে হতাহত সেনাদের সচল লরি ও গাড়িতে নিয়ে তারা সন্ধ্যার আগেই পশ্চাদপসরণ করে বাবুরহাটে। পরদিন সেখানে আবার যুদ্ধ হয়।
মো. মতিউর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ বালুচ রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে সমবেত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে পুনর্গঠিত হয়ে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। নলুয়া চা-বাগান, আখাউড়া ও আশুগঞ্জসহ আরও কয়েকটি স্থানের যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বেশির ভাগ যুদ্ধেই তিনি অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. মতিউর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪।
মো. মতিউর রহমান স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা বি ১৫৪, লেন ২২, মহাখালী ডিওএইচএস ঢাকা। তাঁর বাবার নাম তোরাব আলী। মা আফিয়া খাতুন। স্ত্রী মিনা রহমান। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মিনা রহমান, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
ছবির সংশোধনী: গতকাল ২ জুলাই ধারাবাহিক এই কলামে এ আর আজম চৌধুরী বীর বিক্রমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ভুলে ছবি আরেকজনের ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত। আজ এ আর আজম চৌধুরীর ছবি প্রকাশ করা হলো।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাঁচদোনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মো. মতিউর রহমান। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য তাঁর নেতৃত্বে তাঁরা ময়মনসিংহ থেকে সেখানে সমবেত হন।
পাঁচদোনায় সড়কের দুই ধারে ছিল ঝোপঝাড়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন স্থানীয় দুঃসাহসী কয়েকজন গ্রামবাসী। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন।
মো. মতিউর রহমান নিজেই ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে সড়কে নজর রেখেছিলেন। সেদিন সড়ক জনশূন্য। একসময় তিনি দেখতে পান, সড়কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোটা পাঁচেক সেনাবাহী লরি। পেছনে আরও কয়েকটি সেনাবাহী গাড়ি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাবুরহাটের দিক থেকে।
গত কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় তেমন কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। সেদিনও কোথাও হয়নি। জনশূন্য পথে তারা বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আসছিল। সামনের লরিগুলো অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র মো. মতিউর রহমান সংকেত দেন। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত পল্লি-প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার দলের ছোড়া তিনটি মর্টারের গোলার একটা গোলা পড়ে লরির ওপর। একই সময় গর্জে ওঠে তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে থাকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র।
তখন পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এমন অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে পড়তে হবে, তা ওরা ভাবতেই পারেনি। প্রথম ধাক্কাতেই হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা অবশ্য কিছুক্ষণ পর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
মো. মতিউর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। তাঁর সাহসিকতা দেখে সহযোদ্ধারা আরও উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলে কয়েক ঘণ্টা।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। হতাহত হয় শতাধিক সেনা। তিনটি লরি অচল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে হতাহত সেনাদের সচল লরি ও গাড়িতে নিয়ে তারা সন্ধ্যার আগেই পশ্চাদপসরণ করে বাবুরহাটে। পরদিন সেখানে আবার যুদ্ধ হয়।
মো. মতিউর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ বালুচ রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে সমবেত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে পুনর্গঠিত হয়ে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। নলুয়া চা-বাগান, আখাউড়া ও আশুগঞ্জসহ আরও কয়েকটি স্থানের যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বেশির ভাগ যুদ্ধেই তিনি অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. মতিউর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪।
মো. মতিউর রহমান স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা বি ১৫৪, লেন ২২, মহাখালী ডিওএইচএস ঢাকা। তাঁর বাবার নাম তোরাব আলী। মা আফিয়া খাতুন। স্ত্রী মিনা রহমান। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মিনা রহমান, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
ছবির সংশোধনী: গতকাল ২ জুলাই ধারাবাহিক এই কলামে এ আর আজম চৌধুরী বীর বিক্রমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ভুলে ছবি আরেকজনের ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত। আজ এ আর আজম চৌধুরীর ছবি প্রকাশ করা হলো।
No comments