বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক-ট্রানজিট দিতে উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের চুক্তি!
ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চালুর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। নতুন প্রস্তাবের আওতায় দুই প্রতিবেশী দেশ একটি চুক্তি কিংবা প্রটোকল সইয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজি হয়েছে। আর এর মাধ্যমে ভারতকে কার্যত ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
নৌসচিবদের দুই দিনের বৈঠক শেষে গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ভারতের নৌসচিব প্রদীপ কুমার সিনহা এ তথ্য জানান।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের নৌসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, তাড়াতাড়ি ও কম খরচে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের জাহাজমালিকেরা উপকূলীয় জাহাজ চলাচল শুরুর প্রস্তাব দিয়েছেন। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই ভারতের বিশাখাপট্টনাম, হলদিয়া ও পারে দীপসহ সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো পরিদর্শনে যাবে।
তবে দুই সচিব বাংলাদেশের উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের উল্লেখ করলেও নতুন প্রস্তাবের আওতায় ভারতীয় জাহাজ চলবে কি না, সেটি স্পষ্ট করেননি। কারণ, দুই দেশের বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় দুই পক্ষের সমান হারে জাহাজ চলাচলের কথা রয়েছে। যদিও পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশেরই ৯৮ শতাংশ জাহাজ চলাচল করে থাকে।
গতকালের বৈঠকে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে ত্রিপুরায় পরিবহনের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। এ অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আশুগঞ্জ নৌবন্দরের অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ভারত অনুদান দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণেও অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশের নৌসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরীণ নৌপথ অতিক্রম ও জল-বাণিজ্য প্রটোকল বা পিআইডব্লিউটিটির মেয়াদ দুই বছর বেড়েছে। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আওতার এই নৌ-প্রটোকল ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া নৌ-প্রটোকলের আওতায় নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশকে দেওয়া অর্থের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা করা হয়েছে। তিনি জানান, নৌ-প্রটোকলে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার উল্লেখ করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নবায়ন করা প্রটোকল সই হবে।
সোনারগাঁও হোটেলে দুই দেশের নৌসচিবদের বৈঠকে বাংলাদেশের ১৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দুই দেশের নৌসচিবেরা।
উপকূলীয় জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গ: বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে দুই দেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের পাঁচটি প্রস্তাবের অন্যতম ছিল নৌ-প্রটোকলের সংশোধন, রক্ষণাবেক্ষণের পরিমাণ ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চালু। ভারতের আটটি প্রস্তাবের মধ্যে ছিল দীর্ঘ মেয়াদে নৌ-প্রটোকলের মেয়াদ বাড়ানো, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরে ট্রানশিপমেন্ট চালু, মংলায় স্থলবন্দর ও সুরমা নদীর মধ্য দিয়ে ছাতকে নতুন পোর্ট অফ কল চালু।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চালুর বিষয়টি উত্থাপনের সময় গত সেপ্টেম্বরে দুই দেশের শীর্ষনেতাদের বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই ঘোষণায় মনমোহন সিং বাংলাদেশের নৌ, সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় অঞ্চলে চলাচলকারী জাহাজের বাংলাদেশের মালিকেরা ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেওয়ার দাবি জানান। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দাবি, উপকূলীয় অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সক্ষম বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ জাহাজ অলস সময় কাটায়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃত করে বিষয়টি তোলা হয়। বলা হয়, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপকূলগামী জাহাজগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশাখাপট্টনাম, পারে দীপ ও হলদিয়া বন্দরে চলাচল করতে পারে বাংলাদেশের উপকূলগামী জাহাজ। তাই একটি চুক্তি বা প্রটোকল সইয়ের মাধ্যমে উপকূলীয় জাহাজের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের জাহাজমালিকেরা নতুন একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁদের প্রস্তাব হচ্ছে, শুধু অভ্যন্তরীণ নৌপথে নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যদি উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজ চালু করতে পারি বিশাখাপট্টনাম, পারে দীপ কিংবা হলদিয়া হয়ে মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দরে, তবে সেটি উভয় দেশের জন্য আরও লাভজনক হতে পারে। এটা তাড়াতাড়ি ও কম খরচে পণ্য আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। উভয় পক্ষ এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছি। তবে এর কিছু কারিগরি ও আইনগত বিষয় আছে। এ জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটি সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’
উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের জন্য চুক্তি হবে কি না—জানতে চাইলে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রবন্দর। উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের আওতায় যদি কোনো কেউ জাহাজ ভিড়াতে চায়, তবে একটি চুক্তি করে এটি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ভারতের নৌসচিব প্রদীপ কুমার সিনহা বলেন, ‘এটি একটি নতুন প্রস্তাব। প্রস্তাবটি বাংলাদেশ দিয়েছে। আমরা এটার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে চাই। দুই পক্ষের কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্ভাব্য পণ্য ও রুট নিয়ে ওই কমিটি দুই দেশের সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেবে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনে চুক্তি সই হতে পারে।’
ট্রানজিট আর সুফল নিয়ে প্রশ্ন: দুই প্রতিবেশী দেশের ট্রানজিট প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের দুই বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলে জাহাজ চলাচলে কার্যত ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ এ প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলে ভারত তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য পরিবহনের সুফল পাবে। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী সুবিধা পাবে, সেটি নিশ্চিত নয়। বিশেষ করে, সমন্বিত উপায়ে ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে মাশুল আদায়ের যে সুযোগ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা, সেটি এ প্রক্রিয়ায় ব্যাহত হবে।
ফের আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার!: নৌসচিব জানান, খাদ্যসংকট দূর করতে আশুগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ৩৫ হাজার টন চাল পরিবহনের অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। তিনি বলেন, ‘আমরা জানিয়েছি, এই পথে ত্রাণসামগ্রী হিসেবে কিংবা বিশেষ পণ্য হিসেবে বা বিশেষ সুবিধার আওতায় যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ অনুরোধ আসে, তবে এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দুই পক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ত্রিপুরার পালাটানার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বিনা মাশুলে বৃহদায়তনের পণ্য পরিবহন করা হয় আশুগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে। এতে তিতাস নদীর পথ রোধ করার পাশাপাশি সেতু ও কালভার্টের ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময়ে ট্রানশিপমেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালুর লক্ষ্যে তিনবার পণ্য পরিবহন করা হয়। অবকাঠামোগত প্রস্তুতি না থাকার পরও এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষামূলক পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
আশুগঞ্জ নৌবন্দর উন্নয়নে ভারতের অনুদান: ভারতের নৌসচিব বলেন, ‘আশুগঞ্জ নৌবন্দরে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে সমীক্ষা হবে খুব শিগগির। ওই সমীক্ষা শেষে প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এটি লাভজনক বিবেচিত হলে, এটির কাজ শুরু হবে। আমরা কাজ শুরু করতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে পুরো অর্থায়ন ভারত অনুদান হিসেবে দেবে।’
কাস্টমস সেবার হার প্রসঙ্গে: জানা গেছে, নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি ও সেবা মাশুল দাবি করা হলে তার বিরোধিতা করে ভারত।
এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, ‘আমরা ভারতকে জানিয়েছি, বাংলাদেশের এলাকায় থাকা অবস্থায় সেবা না দিলেও পণ্যের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাস্টমসের। এ ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের দাবি করা যেতে পারে। তবে এ হারটা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
সচিব বলেন, ‘এ ব্যাপারে দুই দেশের রাজস্ব বোর্ড সার্ভিস চার্জ, ব্যাংক গ্যারান্টি ও পণ্য পরিবহনের রুট প্রভৃতি বিষয়ে তিন মাস পর প্রতিবেদন দেবে।’
অন্যদিকে, বাংলাদেশের নৌসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, তাড়াতাড়ি ও কম খরচে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের জাহাজমালিকেরা উপকূলীয় জাহাজ চলাচল শুরুর প্রস্তাব দিয়েছেন। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই ভারতের বিশাখাপট্টনাম, হলদিয়া ও পারে দীপসহ সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো পরিদর্শনে যাবে।
তবে দুই সচিব বাংলাদেশের উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের উল্লেখ করলেও নতুন প্রস্তাবের আওতায় ভারতীয় জাহাজ চলবে কি না, সেটি স্পষ্ট করেননি। কারণ, দুই দেশের বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় দুই পক্ষের সমান হারে জাহাজ চলাচলের কথা রয়েছে। যদিও পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশেরই ৯৮ শতাংশ জাহাজ চলাচল করে থাকে।
গতকালের বৈঠকে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে ত্রিপুরায় পরিবহনের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। এ অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আশুগঞ্জ নৌবন্দরের অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ভারত অনুদান দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণেও অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশের নৌসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরীণ নৌপথ অতিক্রম ও জল-বাণিজ্য প্রটোকল বা পিআইডব্লিউটিটির মেয়াদ দুই বছর বেড়েছে। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আওতার এই নৌ-প্রটোকল ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া নৌ-প্রটোকলের আওতায় নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশকে দেওয়া অর্থের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা করা হয়েছে। তিনি জানান, নৌ-প্রটোকলে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তার উল্লেখ করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নবায়ন করা প্রটোকল সই হবে।
সোনারগাঁও হোটেলে দুই দেশের নৌসচিবদের বৈঠকে বাংলাদেশের ১৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দুই দেশের নৌসচিবেরা।
উপকূলীয় জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গ: বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে দুই দেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের পাঁচটি প্রস্তাবের অন্যতম ছিল নৌ-প্রটোকলের সংশোধন, রক্ষণাবেক্ষণের পরিমাণ ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চালু। ভারতের আটটি প্রস্তাবের মধ্যে ছিল দীর্ঘ মেয়াদে নৌ-প্রটোকলের মেয়াদ বাড়ানো, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরে ট্রানশিপমেন্ট চালু, মংলায় স্থলবন্দর ও সুরমা নদীর মধ্য দিয়ে ছাতকে নতুন পোর্ট অফ কল চালু।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চালুর বিষয়টি উত্থাপনের সময় গত সেপ্টেম্বরে দুই দেশের শীর্ষনেতাদের বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই ঘোষণায় মনমোহন সিং বাংলাদেশের নৌ, সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় অঞ্চলে চলাচলকারী জাহাজের বাংলাদেশের মালিকেরা ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেওয়ার দাবি জানান। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দাবি, উপকূলীয় অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সক্ষম বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ জাহাজ অলস সময় কাটায়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃত করে বিষয়টি তোলা হয়। বলা হয়, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপকূলগামী জাহাজগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশাখাপট্টনাম, পারে দীপ ও হলদিয়া বন্দরে চলাচল করতে পারে বাংলাদেশের উপকূলগামী জাহাজ। তাই একটি চুক্তি বা প্রটোকল সইয়ের মাধ্যমে উপকূলীয় জাহাজের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের জাহাজমালিকেরা নতুন একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁদের প্রস্তাব হচ্ছে, শুধু অভ্যন্তরীণ নৌপথে নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যদি উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজ চালু করতে পারি বিশাখাপট্টনাম, পারে দীপ কিংবা হলদিয়া হয়ে মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দরে, তবে সেটি উভয় দেশের জন্য আরও লাভজনক হতে পারে। এটা তাড়াতাড়ি ও কম খরচে পণ্য আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। উভয় পক্ষ এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছি। তবে এর কিছু কারিগরি ও আইনগত বিষয় আছে। এ জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটি সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’
উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের জন্য চুক্তি হবে কি না—জানতে চাইলে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রবন্দর। উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের আওতায় যদি কোনো কেউ জাহাজ ভিড়াতে চায়, তবে একটি চুক্তি করে এটি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ভারতের নৌসচিব প্রদীপ কুমার সিনহা বলেন, ‘এটি একটি নতুন প্রস্তাব। প্রস্তাবটি বাংলাদেশ দিয়েছে। আমরা এটার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে চাই। দুই পক্ষের কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্ভাব্য পণ্য ও রুট নিয়ে ওই কমিটি দুই দেশের সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেবে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনে চুক্তি সই হতে পারে।’
ট্রানজিট আর সুফল নিয়ে প্রশ্ন: দুই প্রতিবেশী দেশের ট্রানজিট প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের দুই বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলে জাহাজ চলাচলে কার্যত ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ এ প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলে ভারত তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য পরিবহনের সুফল পাবে। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী সুবিধা পাবে, সেটি নিশ্চিত নয়। বিশেষ করে, সমন্বিত উপায়ে ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে মাশুল আদায়ের যে সুযোগ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা, সেটি এ প্রক্রিয়ায় ব্যাহত হবে।
ফের আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার!: নৌসচিব জানান, খাদ্যসংকট দূর করতে আশুগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ৩৫ হাজার টন চাল পরিবহনের অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। তিনি বলেন, ‘আমরা জানিয়েছি, এই পথে ত্রাণসামগ্রী হিসেবে কিংবা বিশেষ পণ্য হিসেবে বা বিশেষ সুবিধার আওতায় যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ অনুরোধ আসে, তবে এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দুই পক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ত্রিপুরার পালাটানার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বিনা মাশুলে বৃহদায়তনের পণ্য পরিবহন করা হয় আশুগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে। এতে তিতাস নদীর পথ রোধ করার পাশাপাশি সেতু ও কালভার্টের ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময়ে ট্রানশিপমেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালুর লক্ষ্যে তিনবার পণ্য পরিবহন করা হয়। অবকাঠামোগত প্রস্তুতি না থাকার পরও এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষামূলক পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
আশুগঞ্জ নৌবন্দর উন্নয়নে ভারতের অনুদান: ভারতের নৌসচিব বলেন, ‘আশুগঞ্জ নৌবন্দরে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে সমীক্ষা হবে খুব শিগগির। ওই সমীক্ষা শেষে প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এটি লাভজনক বিবেচিত হলে, এটির কাজ শুরু হবে। আমরা কাজ শুরু করতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে পুরো অর্থায়ন ভারত অনুদান হিসেবে দেবে।’
কাস্টমস সেবার হার প্রসঙ্গে: জানা গেছে, নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি ও সেবা মাশুল দাবি করা হলে তার বিরোধিতা করে ভারত।
এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, ‘আমরা ভারতকে জানিয়েছি, বাংলাদেশের এলাকায় থাকা অবস্থায় সেবা না দিলেও পণ্যের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাস্টমসের। এ ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের দাবি করা যেতে পারে। তবে এ হারটা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
সচিব বলেন, ‘এ ব্যাপারে দুই দেশের রাজস্ব বোর্ড সার্ভিস চার্জ, ব্যাংক গ্যারান্টি ও পণ্য পরিবহনের রুট প্রভৃতি বিষয়ে তিন মাস পর প্রতিবেদন দেবে।’
No comments