জবাবদিহি-পদ্মা ঋণচুক্তি ও বিশ্বব্যাংকের রোডম্যাপ by আনু মুহাম্মদ
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির আয়োজন নিয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে সত্যতা থাকারই কথা, মানুষ তো এগুলোই দেখছে হরদম। পুরো প্রকল্পই তো হজম হয়ে যায় কখনো কখনো। কিন্তু সরকারের মধ্যে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের মতো এই উত্তেজনা সত্যিই বিস্ময়কর! সুহার্তো, মবুতু, ইয়াহিয়া,
পিনোচেট, শাহানশাসহ বিশ্বের দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসকদের সঙ্গে, লোভী দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলা আর কনসালট্যান্টদের সঙ্গে যে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর নাড়ির সম্পর্ক, তারা দুর্নীতি নিয়ে এত উত্তেজিত, কারণ কী?
বিশ্বব্যাংক সব সময়ই বৃহৎ প্রকল্প পছন্দ করে। একেকটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ, সমীক্ষা আর পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন কোম্পানির দালাল বা লবিস্টদের তৎপরতাও শুরু হয়। যেসব লবিস্ট বিজয় অর্জন করে, প্রকল্প তাদের। আন্তর্জাতিক সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট গ্রাহাম হ্যানকক নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন, নাম লর্ডস অব পভার্টি। প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে লবিস্টদের ভূমিকাই নির্ধারক, তা তিনি বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন। কোটি ডলার ব্যয়ে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভাই এদের বার্ষিক মিলনক্ষেত্র। চেরিল পেয়ার তাঁর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রন্থে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন সিদ্ধান্ত ও বিদেশি ‘সাহায্য’ সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে এসব দেশের মন্ত্রী, সিনিয়র আমলা, ব্যবসায়ী ও কনসালট্যান্টরা দেশের অভ্যন্তরে বিশ্বব্যাংকেরই পঞ্চম বাহিনী হিসেবে কাজ করে। জন পারকিন্স তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখা কনফেশন অব এন ইকোনমিক হিটম্যান গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন প্রকল্প গছিয়ে দেওয়ার পেছনে বিশ্বদুর্বৃত্ত জাল কাজ করে।
পদ্মা সেতুসংক্রান্ত কিছু চিঠিপত্র আমি দেখেছি, বিভিন্ন পক্ষের কথাও সংবাদপত্রে পড়েছি। বিভিন্ন পক্ষের তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক একটি চীনা কোম্পানির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী কানাডীয় এক কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষিতে ব্যস্ত ছিলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত সম্ভবত এখানেই।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে নিয়ে বিশ্বব্যাংককে সমস্যায় পড়তে হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংক তথা বিশ্বপুঁজি নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি অর্থনীতি থেকে ভিন্নভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত তাঁকে করতে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েও তার তিন বছরের মাথায় তিনি সরকার থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
এখন জ্বালানি মন্ত্রণালয় যেমন বহুজাতিক কোম্পানির হাত হিসেবে কাজ করে, তেমনি অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সম্প্রসারিত হস্ত হিসেবেই। বিদেশি সাহায্যযুক্ত প্রকল্পের ব্যাপারে আমলা ও কনসালট্যান্টদের সব সময় বিশেষ আগ্রহ। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আমলা হিসেবে দীর্ঘকাল তাঁদের নিয়মেই কাজ করেছেন। এরপর এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বিশ্বব্যাংকীয় অর্থনীতির সংস্কার সূত্রপাতে ভূমিকা রাখেন। এই আশির দশকেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির সর্বাত্মক আগ্রাসন এবং দুর্নীতিবাজ সামরিক স্বৈরশাসকের আমল একই ছন্দে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলাফল আমাদের জানা। এখন অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে আছেন আরেকজন সাবেক আমলা ড. মসিউর রহমান। তাঁর উদ্যোগেই বিশ্বব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পের প্রধান অংশীদার বানানো হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবেই আবার তাঁকে প্রকল্পের ‘ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজার’ বানানো হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যখন তাদের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন শুরু করে, তখন সারা বিশ্বে তার ভূমিকার ফলাফল নিয়ে উল্টো পর্যালোচনা-সমালোচনাও অনেক বিস্তৃত হয়। এর মুখে বিশ্বব্যাংক নিজেই স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট রিভিউ ইনিশিয়েটিভ বা সাপরির উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশেও এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বত্রই দেখা যায়, কীভাবে তাদের সংস্কার বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান বিপর্যস্ত করেছে, টেকসই উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত করেছে, পরিবেশ বিপন্ন করেছে। এ রকম ফলাফল দেখে বিশ্বব্যাংক নিজেই এর কার্যক্রম একপর্যায়ে স্থগিত করে। ১৯৯৭ সালে বিশ্ব্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে জোসেফ স্টিগলিজ বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে এক জনবক্তৃতা প্রদান করেন। আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বাজারমুখী সংস্কারে অনেক দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এখন রাষ্ট্র ও বাজারের সমন্বয় করে তৃতীয় পথ নিতে হবে।’ আমার সরল একটি প্রশ্ন ছিল তাঁর কাছে, ‘বিশ্বব্যাংকের ভুল পথ অনুসরণ করে বহু দেশের কয়েক শ কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, এসব দেশের লক্ষ-কোটি ডলারের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই ভুল শনাক্ত করার পর এই ক্ষতিপূরণ দিতে কি তোমরা প্রস্তুত আছো?’ স্টিগলিজ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
দুই বছরের মাথায় আমরা দেখেছি, তিনি বিশ্বব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগ করে তিনিই দুনিয়াকে জানিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বিশ্বের বৃহৎ ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বিস্তার করে এবং দুর্বল দেশগুলোর সর্বনাশ ডেকে আনে। ২০০২ সালে তিনি আবার ঢাকা সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের সীমিত গ্যাস ভারতে রপ্তানির জন্য তখন মার্কিন তেল কোম্পানির পক্ষে মার্কিন দূতাবাস, এডিবি-বিশ্ব্বব্যাংকের প্রবল চাপ। তার বিপরীতে আমরা তখন গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধের অবস্থান নিয়েছি। স্টিগলিজ তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য গ্যাস রপ্তানি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।
শুধু জোসেফ স্টিগলিজ নন, একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের আরেকজন প্রধান অর্থনীতিবিদ রবি কানবুরও পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ, বিশ্বদারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট তৈরিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল হোয়াইট হাউস। যদিও বিশ্বব্যাংক ১৮৮টি দেশের সদস্যপদ নিয়ে গঠিত, কিন্তু তার পরিচালনা কাঠামো এমন যে, যুক্তরাষ্ট্রই তার প্রধান কর্তা।
২০০৭ সালে যখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন, তার আগের কয়েক বছর বিশ্বব্যাংক নিজেদের অপরাধ নিয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন উঠতে থাকায় দায়মুক্তি লাভের জন্য প্রাণপণ চাপ দিচ্ছিল। সে সময়ই আমরা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবির বিরুদ্ধে একটি গণ-আদালত গঠন করি এবং এক বছরের অধিক সময় কৃষি, পানি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, পাট, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করি।
এসব সমীক্ষা থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। দেখি, এসব সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা ক্রমাগত বললেও নিজেদের প্রকল্প কিংবা জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতসহ নানা ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা গোপন রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়। এসব প্রকল্প ও চুক্তির পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমলা, মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের বিদেশ সফর, কনসালট্যান্সি, অবসর-পরবর্তী উচ্চবেতনে চাকরি ইত্যাদি বন্দোবস্ত রেখে ঘুষ ও দুর্নীতির নতুন এক ধরন ও ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। পানি-বন-খনিজ সম্পদসহ সব সাধারণ সম্পত্তি মুনাফামুখী তৎপরতায় দিয়ে দেওয়া এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি, পরিবেশদূষণ, খাদ্য ও জ্বালানি-নিরাপত্তা নষ্ট করার মতো প্রকল্প গ্রহণের জন্য এসব সংস্থা হস্তক্ষেপ, ব্ল্যাকমেইল, চাপ ও লবিংয়ের নানা পথ অবলম্বন করে। আদমজী পাটকল, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, রেলওয়ে, পাবলিক হাসপাতাল, বিএডিসি, পিডিবি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর ইত্যাদির দুর্বলতা বা বিলুপ্তি এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের ফলাফল। বিভিন্ন ক্ষতিকর নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং সেই অজুহাতে সেসব সংস্থা বন্ধ করা বা বেসরকারীকরণ এদের বিভিন্ন প্রকল্পের লক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত। পাট খাত প্রকল্প তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। গ্যাস খাতে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি এবং বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি কোম্পানির মালিকানা উৎসাহিত করে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি এবং সেই অজুহাতে আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাস বা কয়লা রপ্তানির সুপারিশ এর দৃষ্টান্ত। এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি খাতে বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি; কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান হ্রাস; পরিবেশদূষণ, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, জাতীয় উদ্যোগ বিনষ্টকরণ, মেধা পাচার; শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকোচন ও ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি কাজ করে বাঘের আগে ফেউয়ের মতো। ‘বিদেশি সাহায্য’ ‘টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্স’, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’, ‘রুটিন অ্যাডভাইজ’ ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে সাধারণ সম্পত্তিকে মুনাফার সামগ্রীতে পরিণত করা এবং জাতীয় সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির দখলে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী নীতি ও প্রতিষ্ঠান তথা রোডম্যাপ তৈরি করে তারা। সেই পথেই দেশি-বিদেশি মুনাফাখোরদের দখল-লুণ্ঠন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ হয়, বৈধতা লাভ করে। এখন পর্যন্ত যত সরকার আমরা পেয়েছি, তারা এই রোডম্যাপেই হেঁটেছে। যে সরকার এই রোডম্যাপে হাঁটবে, তার পক্ষে কী করে মাঝেমধ্যে বিশ্বব্যাংকের লাথি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব?
১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া আর ২০০৫ সালে টেংরাটিলায় মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির কারণে আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস সম্পদ নষ্ট হয়েছে, তাতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাদের ন্যূনতম পাওনা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তা দিয়ে দুটো পদ্মা সেতু করেও হাতে টাকা থাকার কথা। বিশ্বব্যাংক কখনো এই পাওনার কথা বলেনি। কোনো সরকারের মুখ থেকেও এই নিয়ে কোনো দাবি ওঠেনি। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব্বব্যাংককে যেসব পত্র লেখা হয়েছে, সেগুলো আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। কাকুতি-মিনতি ও হাতজোড় তাতে কম নেই। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যারা নৈতিকভাবে পরাজিত, দাসত্ব আর মেরুদণ্ডহীনতাই যাদের সম্বল, তাদের গলায় জোর থাকবে কী করে? এদের জন্যই বাংলাদেশকে, ১৬ কোটি মানুষকে, বারবার বিশ্বসমাজে অপমানিত হতে হয়।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বব্যাংক সব সময়ই বৃহৎ প্রকল্প পছন্দ করে। একেকটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ, সমীক্ষা আর পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন কোম্পানির দালাল বা লবিস্টদের তৎপরতাও শুরু হয়। যেসব লবিস্ট বিজয় অর্জন করে, প্রকল্প তাদের। আন্তর্জাতিক সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট গ্রাহাম হ্যানকক নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন, নাম লর্ডস অব পভার্টি। প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে লবিস্টদের ভূমিকাই নির্ধারক, তা তিনি বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন। কোটি ডলার ব্যয়ে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভাই এদের বার্ষিক মিলনক্ষেত্র। চেরিল পেয়ার তাঁর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রন্থে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন সিদ্ধান্ত ও বিদেশি ‘সাহায্য’ সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে এসব দেশের মন্ত্রী, সিনিয়র আমলা, ব্যবসায়ী ও কনসালট্যান্টরা দেশের অভ্যন্তরে বিশ্বব্যাংকেরই পঞ্চম বাহিনী হিসেবে কাজ করে। জন পারকিন্স তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখা কনফেশন অব এন ইকোনমিক হিটম্যান গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন প্রকল্প গছিয়ে দেওয়ার পেছনে বিশ্বদুর্বৃত্ত জাল কাজ করে।
পদ্মা সেতুসংক্রান্ত কিছু চিঠিপত্র আমি দেখেছি, বিভিন্ন পক্ষের কথাও সংবাদপত্রে পড়েছি। বিভিন্ন পক্ষের তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক একটি চীনা কোম্পানির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী কানাডীয় এক কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষিতে ব্যস্ত ছিলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত সম্ভবত এখানেই।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে নিয়ে বিশ্বব্যাংককে সমস্যায় পড়তে হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংক তথা বিশ্বপুঁজি নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি অর্থনীতি থেকে ভিন্নভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত তাঁকে করতে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েও তার তিন বছরের মাথায় তিনি সরকার থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
এখন জ্বালানি মন্ত্রণালয় যেমন বহুজাতিক কোম্পানির হাত হিসেবে কাজ করে, তেমনি অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সম্প্রসারিত হস্ত হিসেবেই। বিদেশি সাহায্যযুক্ত প্রকল্পের ব্যাপারে আমলা ও কনসালট্যান্টদের সব সময় বিশেষ আগ্রহ। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আমলা হিসেবে দীর্ঘকাল তাঁদের নিয়মেই কাজ করেছেন। এরপর এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বিশ্বব্যাংকীয় অর্থনীতির সংস্কার সূত্রপাতে ভূমিকা রাখেন। এই আশির দশকেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির সর্বাত্মক আগ্রাসন এবং দুর্নীতিবাজ সামরিক স্বৈরশাসকের আমল একই ছন্দে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলাফল আমাদের জানা। এখন অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে আছেন আরেকজন সাবেক আমলা ড. মসিউর রহমান। তাঁর উদ্যোগেই বিশ্বব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পের প্রধান অংশীদার বানানো হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবেই আবার তাঁকে প্রকল্পের ‘ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজার’ বানানো হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যখন তাদের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন শুরু করে, তখন সারা বিশ্বে তার ভূমিকার ফলাফল নিয়ে উল্টো পর্যালোচনা-সমালোচনাও অনেক বিস্তৃত হয়। এর মুখে বিশ্বব্যাংক নিজেই স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট রিভিউ ইনিশিয়েটিভ বা সাপরির উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশেও এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বত্রই দেখা যায়, কীভাবে তাদের সংস্কার বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান বিপর্যস্ত করেছে, টেকসই উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত করেছে, পরিবেশ বিপন্ন করেছে। এ রকম ফলাফল দেখে বিশ্বব্যাংক নিজেই এর কার্যক্রম একপর্যায়ে স্থগিত করে। ১৯৯৭ সালে বিশ্ব্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে জোসেফ স্টিগলিজ বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে এক জনবক্তৃতা প্রদান করেন। আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বাজারমুখী সংস্কারে অনেক দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এখন রাষ্ট্র ও বাজারের সমন্বয় করে তৃতীয় পথ নিতে হবে।’ আমার সরল একটি প্রশ্ন ছিল তাঁর কাছে, ‘বিশ্বব্যাংকের ভুল পথ অনুসরণ করে বহু দেশের কয়েক শ কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, এসব দেশের লক্ষ-কোটি ডলারের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই ভুল শনাক্ত করার পর এই ক্ষতিপূরণ দিতে কি তোমরা প্রস্তুত আছো?’ স্টিগলিজ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
দুই বছরের মাথায় আমরা দেখেছি, তিনি বিশ্বব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগ করে তিনিই দুনিয়াকে জানিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বিশ্বের বৃহৎ ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বিস্তার করে এবং দুর্বল দেশগুলোর সর্বনাশ ডেকে আনে। ২০০২ সালে তিনি আবার ঢাকা সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের সীমিত গ্যাস ভারতে রপ্তানির জন্য তখন মার্কিন তেল কোম্পানির পক্ষে মার্কিন দূতাবাস, এডিবি-বিশ্ব্বব্যাংকের প্রবল চাপ। তার বিপরীতে আমরা তখন গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধের অবস্থান নিয়েছি। স্টিগলিজ তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য গ্যাস রপ্তানি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।
শুধু জোসেফ স্টিগলিজ নন, একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের আরেকজন প্রধান অর্থনীতিবিদ রবি কানবুরও পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ, বিশ্বদারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট তৈরিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল হোয়াইট হাউস। যদিও বিশ্বব্যাংক ১৮৮টি দেশের সদস্যপদ নিয়ে গঠিত, কিন্তু তার পরিচালনা কাঠামো এমন যে, যুক্তরাষ্ট্রই তার প্রধান কর্তা।
২০০৭ সালে যখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন, তার আগের কয়েক বছর বিশ্বব্যাংক নিজেদের অপরাধ নিয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন উঠতে থাকায় দায়মুক্তি লাভের জন্য প্রাণপণ চাপ দিচ্ছিল। সে সময়ই আমরা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবির বিরুদ্ধে একটি গণ-আদালত গঠন করি এবং এক বছরের অধিক সময় কৃষি, পানি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, পাট, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করি।
এসব সমীক্ষা থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। দেখি, এসব সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা ক্রমাগত বললেও নিজেদের প্রকল্প কিংবা জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতসহ নানা ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা গোপন রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়। এসব প্রকল্প ও চুক্তির পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমলা, মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের বিদেশ সফর, কনসালট্যান্সি, অবসর-পরবর্তী উচ্চবেতনে চাকরি ইত্যাদি বন্দোবস্ত রেখে ঘুষ ও দুর্নীতির নতুন এক ধরন ও ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। পানি-বন-খনিজ সম্পদসহ সব সাধারণ সম্পত্তি মুনাফামুখী তৎপরতায় দিয়ে দেওয়া এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি, পরিবেশদূষণ, খাদ্য ও জ্বালানি-নিরাপত্তা নষ্ট করার মতো প্রকল্প গ্রহণের জন্য এসব সংস্থা হস্তক্ষেপ, ব্ল্যাকমেইল, চাপ ও লবিংয়ের নানা পথ অবলম্বন করে। আদমজী পাটকল, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, রেলওয়ে, পাবলিক হাসপাতাল, বিএডিসি, পিডিবি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর ইত্যাদির দুর্বলতা বা বিলুপ্তি এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের ফলাফল। বিভিন্ন ক্ষতিকর নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং সেই অজুহাতে সেসব সংস্থা বন্ধ করা বা বেসরকারীকরণ এদের বিভিন্ন প্রকল্পের লক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত। পাট খাত প্রকল্প তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। গ্যাস খাতে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি এবং বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি কোম্পানির মালিকানা উৎসাহিত করে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি এবং সেই অজুহাতে আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাস বা কয়লা রপ্তানির সুপারিশ এর দৃষ্টান্ত। এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি খাতে বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি; কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান হ্রাস; পরিবেশদূষণ, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, জাতীয় উদ্যোগ বিনষ্টকরণ, মেধা পাচার; শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকোচন ও ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি কাজ করে বাঘের আগে ফেউয়ের মতো। ‘বিদেশি সাহায্য’ ‘টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্স’, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’, ‘রুটিন অ্যাডভাইজ’ ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে সাধারণ সম্পত্তিকে মুনাফার সামগ্রীতে পরিণত করা এবং জাতীয় সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির দখলে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী নীতি ও প্রতিষ্ঠান তথা রোডম্যাপ তৈরি করে তারা। সেই পথেই দেশি-বিদেশি মুনাফাখোরদের দখল-লুণ্ঠন স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ হয়, বৈধতা লাভ করে। এখন পর্যন্ত যত সরকার আমরা পেয়েছি, তারা এই রোডম্যাপেই হেঁটেছে। যে সরকার এই রোডম্যাপে হাঁটবে, তার পক্ষে কী করে মাঝেমধ্যে বিশ্বব্যাংকের লাথি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব?
১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া আর ২০০৫ সালে টেংরাটিলায় মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির কারণে আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস সম্পদ নষ্ট হয়েছে, তাতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাদের ন্যূনতম পাওনা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তা দিয়ে দুটো পদ্মা সেতু করেও হাতে টাকা থাকার কথা। বিশ্বব্যাংক কখনো এই পাওনার কথা বলেনি। কোনো সরকারের মুখ থেকেও এই নিয়ে কোনো দাবি ওঠেনি। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব্বব্যাংককে যেসব পত্র লেখা হয়েছে, সেগুলো আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। কাকুতি-মিনতি ও হাতজোড় তাতে কম নেই। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যারা নৈতিকভাবে পরাজিত, দাসত্ব আর মেরুদণ্ডহীনতাই যাদের সম্বল, তাদের গলায় জোর থাকবে কী করে? এদের জন্যই বাংলাদেশকে, ১৬ কোটি মানুষকে, বারবার বিশ্বসমাজে অপমানিত হতে হয়।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments