জলাবদ্ধতা-ভবদহ এলাকায় শান্তি ফেরাও by ম. ইনামুল হক
সুদূর অতীতে (খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী) গ্রিক নাবিক টলেমি বর্ণিত গঙ্গা নদীর মোহনায় এর পাঁচটি শাখা নদীর একটি ছিল ভৈরব নদ। অন্যগুলোর নাম ভাগীরথী, কালীগঙ্গা, ভূবনেশ্বর ও ব্রহ্মপুত্র। বিগত দুই হাজার বছরে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ তার শাখাগুলোর কোনো একটি ধারায় গতি পরিবর্তন করেছে এবং শাখাগুলোও বিভিন্ন উপশাখার মাধ্যমে নদীর জাল বিস্তার করে গেছে।
এই সঙ্গে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদ মিলিতভাবে বঙ্গীয় সমতলের ওপর বছরে গড়ে এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন টন পলি এনে ভূমির উচ্চতা বাড়িয়েছে ও সাগরে বদ্বীপের প্রসার বাড়িয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার আখেরীগঞ্জের কাছে উৎপন্ন ভৈরব নদ অষ্টাদশ শতাব্দীতে জলঙ্গীর কাছে উৎপন্ন গঙ্গার শাখা নদী মাথাভাঙ্গার সঙ্গে মিলে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভৈরব তার আদি প্রবাহপথ হারিয়ে ফেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর দর্শনার ভাটিতে মাথাভাঙ্গার শাখা হিসেবে ভৈরবের অস্তিত্ব ছিল। ১৮৬১ সালের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণের পর এর অস্তিত্ব ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা জেলায় প্রবাহিত ভৈরবের শাখা ইছামতী, বেতনা, কপোতাক্ষ, শ্রীনদীর মধ্যে কেবল ইছামতী নদীই বর্তমানে মাথাভাঙ্গার মিষ্টি পানি পায়। কিন্তু বেতনা, কপোতাক্ষ ও শ্রীনদীতে বর্তমানে উজান থেকে মিষ্টি পানির জোগান না আসায় এগুলোর অববাহিকাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার বর্তমান জলাবদ্ধতাপূর্ণ এলাকাটি আগে জোয়ার-ভাটার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে তৎকালীন ওয়াপদা উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের নামে নদীগুলোর তীর দিয়ে অনেক বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে, যার ফলে দুই নদীর মধ্যবর্তী এলাকাগুলো জোয়ারের লোনা পানি থেকে মুক্ত হয়ে বৃষ্টির পানিতে ধৌত হয়ে ধান উৎপাদনের উপযোগী হয়। এরপর খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোরের এই এলাকাগুলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। ওই সময় কপোতাক্ষ নদ যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছা পর্যন্ত নাব্য ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর পানি সরিয়ে নিতে থাকলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত গড়াই নদীর পানি কমে যায়। এরপর মিষ্টি পানির অভাবে এ অঞ্চলের লবণাক্ততা ও জোয়ারের প্রভাব ক্রমশ উজানের দিকে এগোতে থাকে। আশির দশক থেকে কপোতাক্ষসহ আশপাশের কোদলা, বেতনা, চিত্রা, নবগঙ্গা, বেগবতী, মুক্তেশ্বরী, হরিহর, ভদ্রা, শ্রীনদী ইত্যাদি নদীগুলো ক্রমশ মরে যেতে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোর মরে যাওয়া এবং উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় ক্রমবর্ধমান জোয়ারের চাপ নদীর ভাটির তলদেশের মাটি কেটে উজানের দিকে ঠেলে দেয়। এভাবে জোয়ারের সঙ্গে ভাটি থেকে আসা ভাঙনের পলি নদীর উজানে সরু ব্রিজ বা রেগুলেটরের কাছে জমা হতে থাকে। বেতনা, কপোতাক্ষ ও শ্রীনদীর তলদেশ এভাবে উঁচু হয়ে গেলে বর্ষার বৃষ্টিপাতের পানি বিল এলাকাগুলো থেকে নিষ্কাশিত না হতে পেরে চরম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নব্বইয়ের দশক থেকে শ্রমিক ও ড্রেজারের মাধ্যমে এই নদীগুলোর পলি বারবার অপসারণ করে গেলেও নদীগুলোর নিষ্কাশন ক্ষমতা আগের অবস্থায় ফেরাতে পারেনি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভবদহ এলাকা বর্তমানে জলাবদ্ধতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত মুক্তেশ্বরী-টেকা-শ্রীনদী যশোর জেলার অভয়নগর, কেশবপুর ও মনিরামপুর এলাকার অনেক বিলের পানি নিষ্কাশন করে। ভবদহ নামক স্থানে এই নদীর ওপর একটি স্লুইসগেট আছে, যা ষাট ও সত্তরের দশকে উপকার দিলেও আশির দশকে বিরূপ আচরণ করতে থাকে ও জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে এই এলাকার দুঃখে পরিণত হয়। ওই সময় থেকে শ্রীনদীর নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য নদীটিকে শ্রমিক দিয়ে বারবার খনন করা হয় ও ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং করা হয়, কিন্তু নদীটি পুনরায় অতি দ্রুত ভরাট হয়ে আগের চেয়েও খারাপ অবস্থা সৃষ্টি করে। এই এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ও চাষের মাঠ বর্তমানে পানিতে তলিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, এ সমস্যা দূর করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৯৩ সালে ‘খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। এ প্রকল্পটি বিল ডাকাতিয়াকে কেন্দ্র করে প্রধানত শ্রীনদী অববাহিকার নিষ্কাশন উন্নয়নের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রকল্পটি ভুল পরামর্শের কারণে ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্পটি ব্যর্থ হলে এলাকার মানুষ নিষ্কাশনের জন্য শ্রীনদীর প্রবাহপথে সব বাধা দূর করার দাবি জানাচ্ছিল। এরই একটা পর্যায়ে অক্টোবর ১৯৯৭-এ তারা ডুমুরিয়ার বিল ভায়নার বাঁধ কেটে দেয়; ফলে পলিমিশ্রিত পানি বিল এলাকায় ঢোকে ও দু-তিন বছরে বিলটির তলদেশ উঁচু হয়ে যায়। ২০০২ সাল নাগাদ পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকাবাসীর বাস্তব এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে Tidal River Management (TRM) বা ‘জোয়ারাধার’ প্রকল্প গ্রহণ করে ভবদহ স্লুইসগেটের উজানে মনিরামপুরের বিল কেদারিয়ায় এই কাজ শুরু করে। কিন্তু এক বছর বাদেই হঠাৎ করে ভবদহ স্লুইসগেট বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রীনদীর তলদেশ পলিতে ভরাট হয়ে যায় এবং প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এরপর ভবদহ স্লুইসগেটের ভাটিতে বিল ভায়নার উত্তরে বিল খুকশিয়াতে জোয়ারাধার প্রকল্প গ্রহণ করে। তবে প্রকল্প চলাকালীন চাষবাস বন্ধ রাখতে হবে বিধায় এলাকাবাসী এ প্রকল্পের অধীনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড চাষিদের ক্ষতিপূরণ দিয়েই প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয় ও জোয়ারাধার প্রকল্প শুরু করে।
খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার, বিশেষ করে কেশবপুর, মনিরামপুর, কলারোয়া, তালা ও পাইকগাছার এলাকার জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। মানুষের ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ও চাষের মাঠ এখন সারা বছর পানিতে তলিয়ে থাকছে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান কারণ, সমস্যা দূর করার জন্য নিয়োজিত পরামর্শকদের ভুল পরিকল্পনা, দুর্নীতি এবং বিবেচনাহীন ড্রেজিং কর্মকাণ্ড। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে কেবল নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নতিই নয়, উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ এনে জোয়ারের চাপ কমাতে হবে। যশোর-খুলনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শ্রীনদীর আশপাশের নিচু জমি উঁচু করার জন্য জোয়ারাধার ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। তবে এ নদীর প্রবাহে সব বাধা ও স্লুইসগেট তুলে দিয়ে কেবল যে বিল এলাকায় পলি পাতনের কাজ চলছে, সেখানকার বাঁধ কেটে দিয়ে প্রবাহ প্রবেশপথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শ্রীনদীর আদি উৎপত্তি ভৈরব নদ থেকে, যশোর শহরের কাছে এর নাম মুক্তেশ্বরী। এর উৎসমুখ বর্তমানে অবৈধভাবে দখল হয়ে একেবারেই বুজে গেছে। ভৈরব নদের মাধ্যমে এই নদীতে উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ জোগান দিতে পারলে নদীটিতে ভাটির জোয়ার ও পলির চাপ থেকে মুক্ত করা যাবে। তবে এই নদীর প্রবাহপথের সব অবৈধ দখল তুলে, সংকীর্ণ সেতু ও স্লুইসগেট সরিয়ে নদীকে তার প্রবাহের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে গৃহীত ‘জোয়ারাধার’ প্রকল্প জনগণের দাবিতেই নেওয়া হয়েছে বলা যায়। কিন্তু বিল কেদারিয়া ও বিল খুকশিয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নে পরামর্শকদের ত্রুটিপূর্ণ নির্দেশনা, ক্ষতিপূরণ প্রদানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনা এলাকাবাসীকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। জনগণের ক্ষোভের প্রতি তোয়াক্কা না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার অন্ধ উদ্যোগই এই অঘটন ঘটিয়েছে। তাই ‘জোয়ারাধার’ প্রকল্পটি পুনরায় শুরু করার আগে ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে জন-অসন্তোষের কারণ বের করা ও তা নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট
minamul@gmail.com
No comments