বসবাসযোগ্য ঢাকা চাই by মোহাম্মাদ রিয়াজউদ্দিন
পৃৃথিবীর সব প্রধান শহরের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি সাম্প্রতিক জরিপে বের হয়ে এসেছে যে ঢাকা ক্রমান্বয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এবং বর্তমানে এর অবস্থান খারাপের দিক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষে। একেবারে শীর্ষে রয়েছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী শহর 'হারারে'। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পৃথিবীর দেড় শতাধিক শহর নিয়ে এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
আমাদের রাজধানী শহরের এহেন মূল্যায়ন প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। ঢাকা শহর বসবাসের জন্য কী রকম কঠিন হয়ে যাচ্ছে, ক্রমেই তা আমরা যারা নগরবাসী, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তা কাউকে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। অনিয়মিত বিদুৎ, অকল্পনীয় ট্রাফিক জ্যাম, পানি ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অব্যাহত চারপাশের নদীগুলোর প্রায় মৃত অবস্থা, তীব্র বায়ুদূষণ আর কংক্রিটের জঙ্গল_এসব নিয়েই আমাদের 'ঢাকা' শহর। সুস্থভাবে বাঁচার প্রায় সব উপাদান এখন কল্পনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাস্টার প্লান আছে শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ বা প্রতিফলন নেই। ক্রমেই অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সচল করতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন দাওয়াই দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাঝে মাঝে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা লাঘবে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগের কথা শোনা যায়। তা ওই পর্যন্তই। তারপর আর কিছু দেখা যায় না। ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে, আমরা যেন এটাকে নিয়তি হিসেবেই ধরে নিয়েছি এবং একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছি।
এককালে বলা হতো, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এখন মনে হয়, আমাদের সময় এসেছে বলার, 'ঢাকা বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে'। আমাদের 'ঢাকা' দেশের ঐতিহ্যের, প্রশাসনের, বাণিজ্যের এবং জীবন ও জীবিকার প্রাণকেন্দ্র। ঢাকাকে কেন্দ্র করেই আমাদের সব কর্মকাণ্ডের বিস্তার। তাই ঢাকাকে আমাদের বাঁচাতেই হবে। বর্তমানে ঢাকায় বিনিয়োগকারীরা এসে যে চিত্র দেখেন, তাতে করে কোনো বিনিয়োগের চিন্তা তখন আর মাথায় থাকে না। তাই বিনিয়োগকারীদের মন ভরাতে হলেও ঢাকাকে বাঁচানো দরকার। এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য অস্থায়ী কর্মকাণ্ড নয়, দরকার একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা। এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরীর যোগাযোগব্যবস্থা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে খুব দ্রুত। এর জন্য শুধু ব্যবস্থাপনার টোটকা দাওয়াই দিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বিভিন্নমুখী যোগাযোগব্যবস্থা চালু করতে হবে। চক্রাকার পানিপথের ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। সম্ভব হলে পাতাল রেলও চালু করতে হবে। এ সবই পরিকল্পনায় আছে বটে, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমাদের এ মহানগরীর জনসংখ্যা সোয়া কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে যানজটের যা অবস্থা, সামনে তা আরো বাড়বে। নগরবাসীর চলাচলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে না পারলে কেবল এ একটি কারণেই ঢাকা মহানগরীর মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাবে।একটা রাজধানী শহরে বহু বাড়িঘরের কোনো স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই_এটা ভাবতে বিস্ময় লাগে। তারপর নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। আমরা কেন এত দিনেও এর সুবন্দোবস্ত করতে পারিনি, তার কোনো সদুত্তর নেই। শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যও এ দুটি ক্ষেত্রে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন প্রয়োজন। বিদ্যুতের চাহিদা সারা দেশেই বেড়েছে, তবে ঢাকায় বেড়েছে বহু গুণ। উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার বিদ্যুৎ। এটা নিয়ে এতকাল কাজের চেয়ে বিতর্কই হয়েছে বেশি। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, কয়লা সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমরা নাকি আমাদের সব বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারি। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আমরা কয়লা উত্তোলন থেকে বিরত রয়েছি। এ সম্পদকে অবশ্যই আমাদের কাজে লাগাতে হবে_এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাই মাটির নিচের কয়লাকে পরিবেশসম্মত কলাকৌশলের সহায়তায় তুলে আনতে হবে। এ জন্য যাঁরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তাঁদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় নিতে হবে সর্বোচ্চমানের সতর্কতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভর হলে সারা দেশের উন্নয়ন ঘটবে, ঢাকাও বাঁচবে। একজন নগরবাসী হিসেবে লোডশেডিংবিহীন ঢাকা মহানগরী আমাদের বড় প্রত্যাশিত একটি বিষয়, আর এটা কি খুব বড় কিছু চাওয়া? আমাদের কৃষক শ্রেণী তাঁদের শ্রম দিয়ে, প্রবাসী শ্রমিকরা তাঁদের উপার্জন দেশে পাঠিয়ে দেশটাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর সঙ্গে যদি আমরা চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারি, আর ঢাকাকে তিলোত্তমা না হোক অন্তত বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে হয়তো ২০২৫ সালের বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভিত্তি পেতে পারে।
লেখক : পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক
এককালে বলা হতো, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এখন মনে হয়, আমাদের সময় এসেছে বলার, 'ঢাকা বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে'। আমাদের 'ঢাকা' দেশের ঐতিহ্যের, প্রশাসনের, বাণিজ্যের এবং জীবন ও জীবিকার প্রাণকেন্দ্র। ঢাকাকে কেন্দ্র করেই আমাদের সব কর্মকাণ্ডের বিস্তার। তাই ঢাকাকে আমাদের বাঁচাতেই হবে। বর্তমানে ঢাকায় বিনিয়োগকারীরা এসে যে চিত্র দেখেন, তাতে করে কোনো বিনিয়োগের চিন্তা তখন আর মাথায় থাকে না। তাই বিনিয়োগকারীদের মন ভরাতে হলেও ঢাকাকে বাঁচানো দরকার। এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য অস্থায়ী কর্মকাণ্ড নয়, দরকার একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা। এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরীর যোগাযোগব্যবস্থা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে খুব দ্রুত। এর জন্য শুধু ব্যবস্থাপনার টোটকা দাওয়াই দিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বিভিন্নমুখী যোগাযোগব্যবস্থা চালু করতে হবে। চক্রাকার পানিপথের ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। সম্ভব হলে পাতাল রেলও চালু করতে হবে। এ সবই পরিকল্পনায় আছে বটে, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমাদের এ মহানগরীর জনসংখ্যা সোয়া কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে যানজটের যা অবস্থা, সামনে তা আরো বাড়বে। নগরবাসীর চলাচলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে না পারলে কেবল এ একটি কারণেই ঢাকা মহানগরীর মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাবে।একটা রাজধানী শহরে বহু বাড়িঘরের কোনো স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই_এটা ভাবতে বিস্ময় লাগে। তারপর নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। আমরা কেন এত দিনেও এর সুবন্দোবস্ত করতে পারিনি, তার কোনো সদুত্তর নেই। শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যও এ দুটি ক্ষেত্রে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন প্রয়োজন। বিদ্যুতের চাহিদা সারা দেশেই বেড়েছে, তবে ঢাকায় বেড়েছে বহু গুণ। উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার বিদ্যুৎ। এটা নিয়ে এতকাল কাজের চেয়ে বিতর্কই হয়েছে বেশি। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, কয়লা সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমরা নাকি আমাদের সব বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারি। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আমরা কয়লা উত্তোলন থেকে বিরত রয়েছি। এ সম্পদকে অবশ্যই আমাদের কাজে লাগাতে হবে_এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাই মাটির নিচের কয়লাকে পরিবেশসম্মত কলাকৌশলের সহায়তায় তুলে আনতে হবে। এ জন্য যাঁরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তাঁদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় নিতে হবে সর্বোচ্চমানের সতর্কতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভর হলে সারা দেশের উন্নয়ন ঘটবে, ঢাকাও বাঁচবে। একজন নগরবাসী হিসেবে লোডশেডিংবিহীন ঢাকা মহানগরী আমাদের বড় প্রত্যাশিত একটি বিষয়, আর এটা কি খুব বড় কিছু চাওয়া? আমাদের কৃষক শ্রেণী তাঁদের শ্রম দিয়ে, প্রবাসী শ্রমিকরা তাঁদের উপার্জন দেশে পাঠিয়ে দেশটাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর সঙ্গে যদি আমরা চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারি, আর ঢাকাকে তিলোত্তমা না হোক অন্তত বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে হয়তো ২০২৫ সালের বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভিত্তি পেতে পারে।
লেখক : পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক
No comments