নিভৃতে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ by রাশেদ মেহেদী
নিভৃতে বাংলাদেশ বদলে যাচ্ছে। নিত্যদিনের নাগরিক সংকটের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনায় বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার চিত্র খুব কমই চোখে পড়ছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের একশ'টির মধ্যে নিরানব্বইটিই বাস্তবায়ন না হতে পারে, কিন্তু একটি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার অবিচল রয়েছে শুরু থেকে।
খুব বেশি ডামাডোল কিংবা ঢাকঢোল পেটানো নেই, কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার পূরণে বর্তমান সরকার অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার বর্তমান গতিপথ অব্যাহত রাখতে পারলে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় এই অর্জনটিই হবে যে কোনো সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় মাইলফলক।
এক দশক আগেই বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে কম্পিউটার ছিল এক ধরনের বিস্ময়। ইন্টারনেট ব্যবহার করার বিষয় তো তিন-চার বছর আগেও সমাজের উঁচুতলার মানুষের আর দশটা ব্যয়বহুল বিলাস দ্রব্যই মনে করা হতো। গত সাড়ে তিন বছরে এখানেই সবচেয়ে বড় বিবর্তন ঘটে গেছে। দুর্গম গ্রামে যেখানে এখনও হারিকেনের আবছা আলোয় রাতের আঁধার কাটে, সেখানেও ছড়িয়ে গেছে ইন্টারনেটের অদৃশ্য উজ্জ্বল আলো। ইন্টারনেটের প্রযুক্তির অভ্যন্তরীণ জটিলতার বিষয়টি না বুঝলেও বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার কিশোর রোকন জানে কীভাবে ইন্টারনেট দিয়ে বিদেশে থাকা বাবার সঙ্গে হাসিমুখ দেখিয়ে কথা বলা যায়, কিংবা যশোরের নেহালপুরের মাঝবয়সী কৃষক হাসেন মিয়া জানেন, কীভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে জমির দলিলের নকল পাওয়া যায়। কোন জমিতে কতটা সার দিতে হবে, কীভাবে ভালো ফলন হবে, তার তথ্য ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্রে বসেই কৃষক সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন। কয়েক মাস আগে 'ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্র ব্লগ' খোলা হয়েছে। সামাজিক অপরাধ দমনে এই ব্লগ যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। চাঁদপুরে মেঘনার চর এলাকায় এক বাল্যবিয়ের আয়োজন চলছে। বাল্যবিয়ে আয়োজন করা সমাজপতিদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস কারও নেই। দেড়-দুই ঘণ্টার নদীপথ পার হয়ে চাঁদপুর সদরে প্রশাসনকেই-বা খবর দেবে কে। গ্রামের এক তরুণ ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্র থেকে বাল্যবিয়ে আয়োজনের খবর দিয়ে দিল তথ্যকেন্দ্র ব্লগে। সঙ্গে সঙ্গে খবরটি চোখে পড়ল একেবারে রাজধানী ঢাকার একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার। তিনি মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানালেন চাঁদপুরের স্থানীয় প্রশাসনকে। সন্ধ্যায় বিয়ের চূড়ান্ত আয়োজন শুরু হওয়ার আগেই স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সেই চরে হাজির হলেন। দশ বছরের এক কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের চরম নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেল। জেলা ই-সেবাকেন্দ্র খোলার পর দালালচক্রের আখড়া যশোর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের চিত্র বদলে গেছে। এখন প্রশাসনের সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষের টাকা নিয়ে দালালদের পেছনে ঘুরতে হয় না সাধারণ মানুষকে। উল্টো সেবাগ্রহীতাকে খুঁজে নেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই। প্রশাসনের টেবিলে টেবিলে ফাইলগুলো আর লাল ফিতার শক্ত বাঁধনে বাঁধা নেই। জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের বারান্দার কোনায়, ঘুণে খাওয়া ঝরঝরে আলমারির ভেতরে ফাইলের স্তূপও আর দেখা যায় না। বলতে গেলে এখন কাগজে আর কোনো কাজই হয় না। ৭০-৮০ ভাগ কাজ ওয়েবপেজেই হয়ে যায়। এই হচ্ছে প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের শক্তি। দুর্নীতি দমনের জন্য, নাগরিক হয়রানি বন্ধের জন্য প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারই সহজতম উপায় এবং এর উপযুক্ত বিকল্পও এখন পর্যন্ত নেই। শুধু যশোর নয়, দেশের আর সব জেলাতেও এই ই-সেবাকেন্দ্র দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা পেঁৗছে দেওয়ার এই অবিশ্বাস্য সাফল্য বর্তমান সরকারের সময়েই অর্জিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাপোর্ট টু ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এ টু আই) প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল নাগরিক সেবার এই যে বিশাল আয়োজন, তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ও এ টু আইয়ের যৌথ উদ্যোগে নেওয়া কার্যক্রমের মাধ্যমে। সমকালের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট করার জন্য তথ্য সংগ্রহের সূত্র ধরেই পুরো কার্যক্রমের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং কয়েকটি জেলায় সচক্ষে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয়। একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হিসেবে আমার উপলব্ধিতে সরকারের এই একটি ক্ষেত্রের সাফল্যের বিষয়টি ভালোভাবে তুলে ধরা সম্ভব হলে অসংখ্য নাগরিক সংকটের অযুত সমালোচনা ম্লান হয়ে যাবে।
No comments