সপ্তাহের হালচাল-জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পাহাড়ধসের মানুষেরা by আব্দুল কাইয়ুম
চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের প্রান্তর থেকে আকবর শাহ মাজারসংলগ্ন রেল-পাহাড়ের প্রান্তে সন্ধ্যা নামছে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। হঠাৎ একজন একটু উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘আর একটু পরে আসলে দেখতেন অন্তত ৭০-৮০ জন রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। এখন তো শেষরাতে একটু একটু কুয়াশা পড়ে। বৃষ্টিও আসে।
তখন আর কোনোখানে আমাদের যাওয়ার জায়গা থাকে না।’ উদ্ভ্রান্ত সেই যুবক সামনের দিকে দেখিয়ে দেয় একচিলতে খোলা জায়গা।
পাশেই সেই অভিশপ্ত পাহাড়ি খাদ, যেখানে গত ২৬ জুন সন্ধ্যায় পাহাড়ের উত্তর পাশের একটা বড় অংশ ধসে পড়ে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা একটি ঘনবসতির প্রায় ২৬টি টিনের ঘর পাহাড়ি ঢলে বিধ্বস্ত হয়। মারা যায় সাতজন। আহত হয় অন্তত তিনজন। কয়েকটি ঘর রক্ষা পায়। অবশ্য এর পর থেকে কেউ আর সেসব ঘরে থাকছে না। পাহাড়ধসে উদ্বাস্তু লোকজন রাতে পাহাড়-তলের খাদ ছেড়ে উঠে এসেছে। ঠাঁই নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে।
যারা সেদিন কাদামাটিতে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে, আর যারা বেঁচে গেছে, তারা সবাই ছিল এই পাহাড়ের অন্তত ২০-২৫ ফুট গভীর খাদে, পাহাড়ের গা-ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইয়াসিন কলোনি নামে বস্তির বাসিন্দা। ভিড়ের মধ্য থেকেই একজন বলে উঠলেন, ‘আরে না, প্রায় ৩০ বছর আগে শামসু জমিদার আমাদের কয়জনকে এখানে ঘর বেঁধে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমরা এখনো কয়েকজন এখানে নিজেদের ঘরে থাকি।’
পাহাড়ধসের প্রান্তরে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখেমুখে একটা আতঙ্কের ছায়া। উচ্ছেদের আতঙ্ক। একজন সেই নিথর পরিবেশ কাঁপানো গলায় বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে, কিন্তু বান্দারা মারতাছে!’ একটু অবাক হলাম। বললাম, ঘটনাটা কী? তিনি বললেন, ‘দেখেন, এখন যদি আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হয়, কোথায় যাব? বাঁচব কীভাবে? মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা আমাদের মতো আধমরাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করে মারতে চায় কিছু লোক।’
তাঁকে বললাম, কিন্তু পাহাড়ের খাদের নিচে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে তো বাঁচা যাবে না। একই সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বললাম, পুনর্বাসনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে অমানবিকভাবে কাউকে উচ্ছেদ করাও তো যাবে না। উচিতও না। আমাদের নগর ব্যবস্থাপনা যাঁদের দায়িত্বে, তাঁরা নিশ্চয়ই এ দিকটা দেখবেন। পাহাড়ধস থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কাউকে তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না।
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঝ বয়সী মোহাম্মদ কামাল। বললেন, সন্ধ্যার কিছু পরেই হঠাৎ বিকট শব্দ করে পাহাড়ের ওপর থেকে একটা গাছ উপড়ে পড়ল আমাদের ঘরের পাশেই। এর প্রায় পরপরই পাহাড়ের মাটি ধসে পড়তে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে ঘরগুলো বুকসমান মাটিতে চাপা পড়ে গেল। এরই মধ্যে যারা পেরেছে, ঘর ছেড়ে দূরে সরে গেছে। অনেকে বুক বা গলাসমান মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিলেন। তাদের অনেককে পরিবারের সদস্যরা ঝুঁকি নিয়ে টেনে তুলে বাঁচিয়েছে। কেউ কেউ আবার উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই মাটি চাপা পড়ে আর ফিরতে পারেননি। তিনি বললেন, ‘ওই দেখেন, ধসে পড়া পাহাড়টার পশ্চিম পাশটায় একটা বড় ফাটল ধরেছে, একটু বৃষ্টি হলেই ওই দিকটাও ধসে পড়বে।’
মহানগরের আরও পাঁচটি এলাকায় পাহাড়ধসে ১৯ জন, আর এর বাইরে দুটি উপজেলায় আরও সাতজন, শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই ২৬ জনের মৃত্যু। লামা ও অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায়ও অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে পাহাড়ধসে। এই গণমৃত্যু সবার মন ছুঁয়ে গেছে। এই কি নিয়তি? কর্তৃপক্ষের কি কিছুই করার নেই?
প্রায় সাত দিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল। বিশেষভাবে ২৬ জুন অঝোর ধারায় বৃষ্টি সবাইকে সচকিত করে তুলেছিল। পাহাড়ধসের আশঙ্কা সবাই করছিলেন। তখন তো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কর্মীরা বেছে বেছে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষজনকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন। ঠিক আছে, অপরিকল্পিতভাবে বা অবৈধভাবে গড়ে তোলা ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিতে তারা বসবাস করছে, এটা না হয় তাদের দোষ। কিন্তু এই অপরাধে তো কর্তৃপক্ষ বলতে পারে না যে, তোমরা যখন গেছ ওখানে, তাহলে মরো-বাঁচো, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই! একমাত্র বিবেকহীন মানুষেরাই ও রকম ভাবতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ তো বিবেকবানদের জন্য। একটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বাঁচার অধিকার সবার আছে। ওই সব নিরুপায় মানুষের থাকার জায়গা নেই, তাদের থাকার নিরাপদ একটা স্থান করে দাও না কেন?
তবে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে, কীভাবে দিনের পর দিন পাহাড়ের গা-বেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি গড়ে উঠছে? উত্তরটা সবাই জানেন। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, তাঁদের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা ক্যাডাররা, এমনকি প্রভাবশালী বিরোধী দলের বড় বড় নেতা-কর্মী, তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনই বেআইনিভাবে পাহাড় কাটে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাহাড় দখল করে তার গায়ে খাঁজ কেটে কেটে গড়ে তোলে বস্তি। তাঁরা কি এতই শক্তিশালী যে কিছু বলা যাবে না? যখন পাহাড় কেটে বস্তি গড়ে তোলা শুরু হয়, কেউ এসে দু-চারটা ঘর বানাতে শুরু করে, তখন কি অপরিকল্পিতভাবে বা অবৈধভাবে বস্তি গড়ে তোলায় বাধা দেওয়ার কেউ নেই? কর্তৃপক্ষ কী করছে? আজ বলা হচ্ছে বা প্রতিটি দুর্যোগের পরই বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি উচ্ছেদ করা হবে। কিন্তু বস্তি গড়ার শুরুতেই কেন উচ্ছেদ করা হয় না? তাহলে তো এত গণমৃত্যু হতো না। আর অমানবিকভাবে কাউকে উচ্ছেদও করতে হতো না।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির দশম সভা হয়ে গেল ২ জুলাই। প্রতিবারের মতো এবারও অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বস্তির বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। হয়তো সেখানে বসবাসরত মানুষগুলোকে জোর করে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু আসল কাজটিই হবে না। যাঁরা সেখানে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ বসতি গড়ে তুলে গরিব মানুষের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা কি নেবে কর্তৃপক্ষ? যদি না নেয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
এখন যারা পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বাস করছে, তাদের কীভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়টি খুব জটিল ও কঠিন। তাদের সরিয়ে নিতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যাটি যেহেতু এক দিনে তৈরি হয়নি, তাই এক দিনেই সমাধান হয়ে যাবে না। বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পেয়ারা বেগম। একটা হোস্টেলে কাজ করেন। পাহাড়ের খাদে গড়ে তোলা বস্তিতে থাকতেন। তিনি পাহাড়ধসের শিকার। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন কোথায় থাকবেন? পাশেই ঘর ভাড়া নিতে গিয়েছিলেন। অগ্রিম ১০ হাজার টাকা না দিলে ঘর পাওয়া যায় না। এত টাকা তো তাঁর কাছে নেই? অসহায়ভাবে বললেন, ‘তাহলে পাহাড়ের কোলেই থাকতে হবে, কপালে থাকলে মৃত্যু আমাকে মেরে শান্তি দেবে!’
আরেক পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন তুহিনা। চার মেয়ে, এক ছেলে, স্বামী—সব মিলিয়ে আটজনের সংসার নিয়ে একটা টিনের ঘরে থাকতেন। ২৬টি ঘরের মধ্যে তাদের ঘরটিও পাহাড়ধসে চাপা পড়ে গেছে। তাদের সৌভাগ্য, একে অপরকে টেনে টেনে কাদামাটির নিচ থেকে তুলে আনতে পেরেছে। চোখেমুখে এখনো আতঙ্ক। তাঁর প্রশ্ন, আমাদের কি উচ্ছেদের নামে তাড়িয়ে দেওয়া হবে? জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তুহিনা তাঁর শক্তিশালী প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন। আমি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, আসুন, চট্টগ্রাম চেম্বার মিলনায়তনে, প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে। সেখানে বর্তমান ও সাবেক মেয়র থাকবেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চেয়ারম্যান থাকবেন। নগর পরিকল্পনাবিদেরা থাকবেন। আপনার প্রশ্নটা সবার কাছে তুলে ধরুন। তুহিনা অবশ্য আসতে পারেননি। গতকালের প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়র, চুয়েটের উপাচার্য, পরিবেশবিদসহ বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। তাঁরা প্রায় সবাই অবিলস্বে পাহাড় কাটা বন্ধে আইন কঠোরতর ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, কেউ আইন ভাঙলে, তিনি যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেন। একই সঙ্গে তাঁরা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিতদের পুনর্বাসনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলেন।
তুহিনারা এসব কথায় আশ্বস্ত হতে পারবেন কি না, সেটা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
পাশেই সেই অভিশপ্ত পাহাড়ি খাদ, যেখানে গত ২৬ জুন সন্ধ্যায় পাহাড়ের উত্তর পাশের একটা বড় অংশ ধসে পড়ে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা একটি ঘনবসতির প্রায় ২৬টি টিনের ঘর পাহাড়ি ঢলে বিধ্বস্ত হয়। মারা যায় সাতজন। আহত হয় অন্তত তিনজন। কয়েকটি ঘর রক্ষা পায়। অবশ্য এর পর থেকে কেউ আর সেসব ঘরে থাকছে না। পাহাড়ধসে উদ্বাস্তু লোকজন রাতে পাহাড়-তলের খাদ ছেড়ে উঠে এসেছে। ঠাঁই নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে।
যারা সেদিন কাদামাটিতে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে, আর যারা বেঁচে গেছে, তারা সবাই ছিল এই পাহাড়ের অন্তত ২০-২৫ ফুট গভীর খাদে, পাহাড়ের গা-ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইয়াসিন কলোনি নামে বস্তির বাসিন্দা। ভিড়ের মধ্য থেকেই একজন বলে উঠলেন, ‘আরে না, প্রায় ৩০ বছর আগে শামসু জমিদার আমাদের কয়জনকে এখানে ঘর বেঁধে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমরা এখনো কয়েকজন এখানে নিজেদের ঘরে থাকি।’
পাহাড়ধসের প্রান্তরে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখেমুখে একটা আতঙ্কের ছায়া। উচ্ছেদের আতঙ্ক। একজন সেই নিথর পরিবেশ কাঁপানো গলায় বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে, কিন্তু বান্দারা মারতাছে!’ একটু অবাক হলাম। বললাম, ঘটনাটা কী? তিনি বললেন, ‘দেখেন, এখন যদি আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হয়, কোথায় যাব? বাঁচব কীভাবে? মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা আমাদের মতো আধমরাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করে মারতে চায় কিছু লোক।’
তাঁকে বললাম, কিন্তু পাহাড়ের খাদের নিচে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে তো বাঁচা যাবে না। একই সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বললাম, পুনর্বাসনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে অমানবিকভাবে কাউকে উচ্ছেদ করাও তো যাবে না। উচিতও না। আমাদের নগর ব্যবস্থাপনা যাঁদের দায়িত্বে, তাঁরা নিশ্চয়ই এ দিকটা দেখবেন। পাহাড়ধস থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কাউকে তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না।
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঝ বয়সী মোহাম্মদ কামাল। বললেন, সন্ধ্যার কিছু পরেই হঠাৎ বিকট শব্দ করে পাহাড়ের ওপর থেকে একটা গাছ উপড়ে পড়ল আমাদের ঘরের পাশেই। এর প্রায় পরপরই পাহাড়ের মাটি ধসে পড়তে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে ঘরগুলো বুকসমান মাটিতে চাপা পড়ে গেল। এরই মধ্যে যারা পেরেছে, ঘর ছেড়ে দূরে সরে গেছে। অনেকে বুক বা গলাসমান মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিলেন। তাদের অনেককে পরিবারের সদস্যরা ঝুঁকি নিয়ে টেনে তুলে বাঁচিয়েছে। কেউ কেউ আবার উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই মাটি চাপা পড়ে আর ফিরতে পারেননি। তিনি বললেন, ‘ওই দেখেন, ধসে পড়া পাহাড়টার পশ্চিম পাশটায় একটা বড় ফাটল ধরেছে, একটু বৃষ্টি হলেই ওই দিকটাও ধসে পড়বে।’
মহানগরের আরও পাঁচটি এলাকায় পাহাড়ধসে ১৯ জন, আর এর বাইরে দুটি উপজেলায় আরও সাতজন, শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই ২৬ জনের মৃত্যু। লামা ও অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায়ও অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে পাহাড়ধসে। এই গণমৃত্যু সবার মন ছুঁয়ে গেছে। এই কি নিয়তি? কর্তৃপক্ষের কি কিছুই করার নেই?
প্রায় সাত দিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল। বিশেষভাবে ২৬ জুন অঝোর ধারায় বৃষ্টি সবাইকে সচকিত করে তুলেছিল। পাহাড়ধসের আশঙ্কা সবাই করছিলেন। তখন তো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কর্মীরা বেছে বেছে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষজনকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন। ঠিক আছে, অপরিকল্পিতভাবে বা অবৈধভাবে গড়ে তোলা ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিতে তারা বসবাস করছে, এটা না হয় তাদের দোষ। কিন্তু এই অপরাধে তো কর্তৃপক্ষ বলতে পারে না যে, তোমরা যখন গেছ ওখানে, তাহলে মরো-বাঁচো, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই! একমাত্র বিবেকহীন মানুষেরাই ও রকম ভাবতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ তো বিবেকবানদের জন্য। একটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বাঁচার অধিকার সবার আছে। ওই সব নিরুপায় মানুষের থাকার জায়গা নেই, তাদের থাকার নিরাপদ একটা স্থান করে দাও না কেন?
তবে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে, কীভাবে দিনের পর দিন পাহাড়ের গা-বেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি গড়ে উঠছে? উত্তরটা সবাই জানেন। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, তাঁদের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা ক্যাডাররা, এমনকি প্রভাবশালী বিরোধী দলের বড় বড় নেতা-কর্মী, তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনই বেআইনিভাবে পাহাড় কাটে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাহাড় দখল করে তার গায়ে খাঁজ কেটে কেটে গড়ে তোলে বস্তি। তাঁরা কি এতই শক্তিশালী যে কিছু বলা যাবে না? যখন পাহাড় কেটে বস্তি গড়ে তোলা শুরু হয়, কেউ এসে দু-চারটা ঘর বানাতে শুরু করে, তখন কি অপরিকল্পিতভাবে বা অবৈধভাবে বস্তি গড়ে তোলায় বাধা দেওয়ার কেউ নেই? কর্তৃপক্ষ কী করছে? আজ বলা হচ্ছে বা প্রতিটি দুর্যোগের পরই বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি উচ্ছেদ করা হবে। কিন্তু বস্তি গড়ার শুরুতেই কেন উচ্ছেদ করা হয় না? তাহলে তো এত গণমৃত্যু হতো না। আর অমানবিকভাবে কাউকে উচ্ছেদও করতে হতো না।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির দশম সভা হয়ে গেল ২ জুলাই। প্রতিবারের মতো এবারও অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বস্তির বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। হয়তো সেখানে বসবাসরত মানুষগুলোকে জোর করে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু আসল কাজটিই হবে না। যাঁরা সেখানে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ বসতি গড়ে তুলে গরিব মানুষের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা কি নেবে কর্তৃপক্ষ? যদি না নেয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
এখন যারা পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বাস করছে, তাদের কীভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়টি খুব জটিল ও কঠিন। তাদের সরিয়ে নিতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যাটি যেহেতু এক দিনে তৈরি হয়নি, তাই এক দিনেই সমাধান হয়ে যাবে না। বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পেয়ারা বেগম। একটা হোস্টেলে কাজ করেন। পাহাড়ের খাদে গড়ে তোলা বস্তিতে থাকতেন। তিনি পাহাড়ধসের শিকার। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন কোথায় থাকবেন? পাশেই ঘর ভাড়া নিতে গিয়েছিলেন। অগ্রিম ১০ হাজার টাকা না দিলে ঘর পাওয়া যায় না। এত টাকা তো তাঁর কাছে নেই? অসহায়ভাবে বললেন, ‘তাহলে পাহাড়ের কোলেই থাকতে হবে, কপালে থাকলে মৃত্যু আমাকে মেরে শান্তি দেবে!’
আরেক পাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন তুহিনা। চার মেয়ে, এক ছেলে, স্বামী—সব মিলিয়ে আটজনের সংসার নিয়ে একটা টিনের ঘরে থাকতেন। ২৬টি ঘরের মধ্যে তাদের ঘরটিও পাহাড়ধসে চাপা পড়ে গেছে। তাদের সৌভাগ্য, একে অপরকে টেনে টেনে কাদামাটির নিচ থেকে তুলে আনতে পেরেছে। চোখেমুখে এখনো আতঙ্ক। তাঁর প্রশ্ন, আমাদের কি উচ্ছেদের নামে তাড়িয়ে দেওয়া হবে? জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তুহিনা তাঁর শক্তিশালী প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন। আমি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, আসুন, চট্টগ্রাম চেম্বার মিলনায়তনে, প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে। সেখানে বর্তমান ও সাবেক মেয়র থাকবেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চেয়ারম্যান থাকবেন। নগর পরিকল্পনাবিদেরা থাকবেন। আপনার প্রশ্নটা সবার কাছে তুলে ধরুন। তুহিনা অবশ্য আসতে পারেননি। গতকালের প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়র, চুয়েটের উপাচার্য, পরিবেশবিদসহ বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। তাঁরা প্রায় সবাই অবিলস্বে পাহাড় কাটা বন্ধে আইন কঠোরতর ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, কেউ আইন ভাঙলে, তিনি যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেন। একই সঙ্গে তাঁরা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিতদের পুনর্বাসনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলেন।
তুহিনারা এসব কথায় আশ্বস্ত হতে পারবেন কি না, সেটা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
No comments