প্রাণবৈচিত্র্য-সংকটের পরিধি by দ্বিজেন শর্মা
বৃক্ষরোপণের মাসে এই ঢাকা শহরে এবার এমন গাছের একটি চারা লাগানো হয়েছে, বিজ্ঞানীরা যা এখনো পুরোপুরি শনাক্ত করতে পারেননি। জানা গেছে, এটি Mammea, কিন্তু প্রজাতি-নামটি কারও সঙ্গেই মিলছে না, হতে পারে কোনো নতুন প্রজাতি। কীভাবে পেলাম গাছটি, সে কথাই বলছি।
জীবনসায়াহ্নে ছেলেবেলার কথা বেশি বেশি মনে পড়ে, তবে সবই ছিন্নস্মৃতি। তিন মাইল দূরের স্কুলে যেতাম পায়ে হেঁটে, পথে পড়ত কয়েকটি টিলা, তাতে একহারা গড়নের কিছু গাছ। বহু বছর পর কেন জানি একদিন মনে হলো ওগুলো হতে পারে নাগকেশর (Mimmea suringa)। একটি ছিল বলধা বাগানের সাইকিতে, এখন নেই। নেই ওই সব টিলায়ও। শেষে পাথারিয়া পাহাড় থেকে একটি চারা এনে বাড়িতে লাগালাম। তিন বছরের মাথায় ফুল ফুটল, কিন্তু এ তো নাগকেশর নয়। ডালের আগায় সাদা রঙের ফুলের ছোট ছোট থোকা। নাগকেশরের ফুল গাঢ় কমলা, সুগন্ধি, থোকাগুলো ডালের আগার বদলে বেরোয় গাছের কাণ্ড থেকে। নমুনা এনে দিলাম বাংলাদেশ জাতীয় হার্বেরিয়ামে। তাঁরা বললেন, ওটি মামিয়া, তবে পুরো নাম জানতে আরও গবেষণা দরকার। এ গোত্রটি (guttiferae) সুদর্শন বৃক্ষের জন্য সুখ্যাত। এতে আরও আছে নাগেশ্বর (Mesua ferra) ও সুকলং (Mimmea nervosa)। প্রথমটি সহজলভ্য, রমনা পার্কে অঢেল, দ্বিতীয়টি দুষ্প্রাপ্য। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থমালার সপ্তম খণ্ডে সুকলং সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রজাতিটির অবস্থান নির্দেশ করা এবং যথাস্থানে ও বাইরে সংরক্ষণ প্রয়োজন।’ এ ধরনের বিপন্ন প্রজাতির তালিকা দীর্ঘ, কিন্তু সংরক্ষণের কাজটি করবে কে? বন বিভাগকে আগ্রহী মনে হয় না, বোটানিক গার্ডেনের অবকাঠামো ও আর্থিক সংগতি যথেষ্ট দুর্বল। তবে সেই সঙ্গে আছে অবহেলা ও অনীহা।
আরেকটি গাছের কথা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় পাথারিয়া পাহাড়ে দেখেছি। বড় গাছ, পাতাগুলো লম্বা-চওড়া, গ্রীষ্মে সাদা রঙের বড় বড় ঝুল ও ফুল ফুটত ডালের আগায়, ফল শরিফার মতো, নিচে পড়ে পড়ে গাঢ়-বাদামি অজস্র বীজসহ স্তূপাকার হয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে লোক লাগিয়েছিলাম খুঁজতে, পায়নি। তবে পেয়ে যাই আরেকটি দুষ্প্রাপ্য ও বিপন্ন প্রজাতি—ডুলিচাঁপা (Magnolia pterocarpa), লাগানো হয়েছে কার্জন হলের সামনের বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক গার্ডেনে ও রমনা পার্কে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বন রক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ, যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয়। বিশ্বে দৈনিক প্রজাতিলুপ্তির সংখ্যা ৪০ থেকে ১০০।
বিষয়টির মধ্যে স্ববিরোধিতাও রয়েছে। জীবের প্রতি ভালোবাসা ও করুণা প্রদর্শন একটি সুপ্রাচীন রেওয়াজ, আছে সব ধর্ম ও সংস্কৃতিতে। কিন্তু জীবনের জন্য সংগ্রাম এক রূঢ় বাস্তবতা। জীবজগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। যে জীবাণু রোগসংক্রমণ ঘটায়, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য তার বিনাশ অপরিহার্য। খাদ্যচক্রে উদ্ভিদ ও প্রাণী আমাদের ভক্ষ্য। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের মাধ্যমেই আমাদের সভ্যতার জন্ম ও বিকাশ। এতে দায়সারা প্রদর্শনের অবকাশ স্বল্প। এই বোধ আমাদের বংশগতিতে গ্রথিত। এভাবেই আমরা চালিত হয়েছি হাজার হাজার বছর। প্রকৃতির প্রত্যাঘাতের মুখোমুখি হয়ে রাতারাতি এই স্বভাব পাল্টানো কঠিন। নৈতিকতা ও বৈষয়িকতার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে সংশ্লেষ সুকঠিন।
প্রকৃতিকে আমরা মাতৃরূপ গণ্য করলেও বাস্তবতা ভিন্নতর। প্রকৃতি এক অন্ধ ও নির্মোঘ শক্তি। সে কাউকে ভালোও বাসে না, ঘৃণাও করে না। আমাদের তার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাকে আমাদের বড়ই প্রয়োজন। এও আরেক দ্বান্দ্বিকতা। এসব সমস্যার সুরাহা ব্যতীত কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়। যে অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর আমাদের সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা প্রকৃতিভুক ও পরিবেশবৈরী, তারও পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কখন কীভাবে এসব ঘটবে, আমরা কিছুই জানিনি। তেমন কোনো আলামতও দৃশ্যমান নয়।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
আরেকটি গাছের কথা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় পাথারিয়া পাহাড়ে দেখেছি। বড় গাছ, পাতাগুলো লম্বা-চওড়া, গ্রীষ্মে সাদা রঙের বড় বড় ঝুল ও ফুল ফুটত ডালের আগায়, ফল শরিফার মতো, নিচে পড়ে পড়ে গাঢ়-বাদামি অজস্র বীজসহ স্তূপাকার হয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে লোক লাগিয়েছিলাম খুঁজতে, পায়নি। তবে পেয়ে যাই আরেকটি দুষ্প্রাপ্য ও বিপন্ন প্রজাতি—ডুলিচাঁপা (Magnolia pterocarpa), লাগানো হয়েছে কার্জন হলের সামনের বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক গার্ডেনে ও রমনা পার্কে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বন রক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ, যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয়। বিশ্বে দৈনিক প্রজাতিলুপ্তির সংখ্যা ৪০ থেকে ১০০।
বিষয়টির মধ্যে স্ববিরোধিতাও রয়েছে। জীবের প্রতি ভালোবাসা ও করুণা প্রদর্শন একটি সুপ্রাচীন রেওয়াজ, আছে সব ধর্ম ও সংস্কৃতিতে। কিন্তু জীবনের জন্য সংগ্রাম এক রূঢ় বাস্তবতা। জীবজগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। যে জীবাণু রোগসংক্রমণ ঘটায়, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য তার বিনাশ অপরিহার্য। খাদ্যচক্রে উদ্ভিদ ও প্রাণী আমাদের ভক্ষ্য। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের মাধ্যমেই আমাদের সভ্যতার জন্ম ও বিকাশ। এতে দায়সারা প্রদর্শনের অবকাশ স্বল্প। এই বোধ আমাদের বংশগতিতে গ্রথিত। এভাবেই আমরা চালিত হয়েছি হাজার হাজার বছর। প্রকৃতির প্রত্যাঘাতের মুখোমুখি হয়ে রাতারাতি এই স্বভাব পাল্টানো কঠিন। নৈতিকতা ও বৈষয়িকতার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে সংশ্লেষ সুকঠিন।
প্রকৃতিকে আমরা মাতৃরূপ গণ্য করলেও বাস্তবতা ভিন্নতর। প্রকৃতি এক অন্ধ ও নির্মোঘ শক্তি। সে কাউকে ভালোও বাসে না, ঘৃণাও করে না। আমাদের তার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাকে আমাদের বড়ই প্রয়োজন। এও আরেক দ্বান্দ্বিকতা। এসব সমস্যার সুরাহা ব্যতীত কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়। যে অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর আমাদের সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা প্রকৃতিভুক ও পরিবেশবৈরী, তারও পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু কখন কীভাবে এসব ঘটবে, আমরা কিছুই জানিনি। তেমন কোনো আলামতও দৃশ্যমান নয়।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
No comments