পরিবেশ-চা বাগান সম্প্রসারণ = খাসিপুঞ্জি উচ্ছেদ by পাভেল পার্থ
এক একটি পানগাছ থেকে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়। কিন্তু খাসি পানজুম এবং যাপিত জীবনের কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া এভাবে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত যেন ফসল রেখে ফসলের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা।
যার কোনো বিচার মেলেনি আজও বলা হয়ে থাকে, চা পানে ক্লান্তি দূর হয়। কিন্তু এক পেয়ালা চায়ের জন্য কতটুকু প্রাকৃতিক বনভূমিকে প্রাণ দিতে হয়েছে তা কি কখনও আন্দাজ করেছি আমরা? সিলেট অঞ্চলের বর্ষারণ্যগুলো প্রধানত নিশ্চিহ্ন হয়েছে করপোরেট চা-বাণিজ্য ও খননের কারণেই। চা বাগানকে কেন্দ্র করে সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ টিলাভূমি নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় আদিবাসী, চা বাগানি ও প্রভাবশালীদের ভেতর দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই আছে; যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতি। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে চা বাগান বাদে আশপাশের প্রাকৃতিক বনভূমি ও টিলা এলাকায় পান-সুপারি-লেবু-আদা-ফলফলাদি-গোলমরিচ জুম আবাদ করে ঐতিহাসিকভাবে বসবাস করে আসছে খাসি আদিবাসী জনগণ। বন বিভাগ, চা বাগান কিংবা স্থানীয় ভূমি দখলদার প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে খাসিরা ছোট ছোট টিলাগ্রাম গড়ে মূলত পান জুম করে বসবাস করে। খাসিরা নিজেদের এই বনটিলার বসতকে পুঞ্জি এবং পুঞ্জিপ্রধানকে মন্ত্রী নামে আখ্যায়িত করে। দেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বর্ষারণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার নাহার চা বাগান-কাইলিন-আসলম খাসি পানপুঞ্জি এলাকাটি এককালে প্রাকৃতিক বর্ষারণ্যের অংশ থাকলেও করপোরেট চা-বাণিজ্য প্রসারের জন্য এখানকার বনভূমি বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে যায়। পরে পুঞ্জি এলাকার ৪ হাজার বৃক্ষ হত্যার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মাত্র পঁচিশ দিনের মাথায় ২০০৮ সালের ৩০ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নাহার চা বাগানের খাসি পানপুঞ্জি এলাকার গাছ কাটার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির চার হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বন বিভাগ। নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ লিখিত আগস্ট ২০০৮ তারিখের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নাহার চা বাগানের ৪ হাজার গাছের ভেতর ৩ হাজার ৭৪৫টি গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে। গাছগুলো থেকে মোট ৮৭ হাজার ১৭৪ ঘনফুট কাঠ এবং ৭৫ হাজার ৫০৮ ঘনফুট জ্বালানি লাকড়ি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষ কাঠ ব্যবসায়ী মোঃ সেলিম উদ্দিন মহালদারের মেসার্স সালিম টিম্বার অ্যান্ড ট্রেডার্সের কাছে দেড় কোটি টাকায় গাছগুলো বিক্রি করে দেয়। ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে গাছ কাটা শুরু হলে স্থানীয় খাসি আদিবাসীদের বন ও বসতি রক্ষার আন্দোলনের ফলে বিষয়টি দেশব্যাপী মনোযোগ তৈরি করে। খাসি আদিবাসীদের সঙ্গে গাছ রক্ষার এই আন্দোলনে জড়িত হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), গণমাধ্যম, পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় জনগণ। পরে ১৯ অক্টোবর ২০০৮ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গাছ কাটার অনুমোদন বন্ধ করে। ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি এলাকাটি পরিদর্শন করে। পরবর্তীকালে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ দেলোয়ার হোসেন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আবারও খাসিপুঞ্জির ৪৫০টি গাছ বাদে ২ হাজার ৩৫০টি গাছ কাটার প্রশ্নহীন অনুমতি দেন মেসার্স সালিম ট্রেডার্সকে। ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও গাছ কাটার পক্ষে সাম্প্রতিক প্রতিবেশবিনাশী রায় ঘোষণা করেন। বিস্ময়করভাবে আবারও ১৩ মার্চ ২০১০ থেকে নাহার চা বাগান এলাকার জীবনমরণের শঙ্কা নিয়ে প্রহর গুনতে থাকা গাছের শরীর ধারালো করাতের কোপে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। এরই মধ্যে নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ হাজার বৃক্ষ হত্যা করেছে। এর ভেতর মাথা নিচু করে চলে গেছে অনেকগুলো ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস, ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। কিন্তু কোনো দিবসই নাহার পুঞ্জির বৃক্ষ ও মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে আমল দেয়নি।
নিহত গাছেদের ভেতর অধিকাংশই ছিল চাম, গামার, গর্জন, জাম, কড়ই, বনাক, রঙ্গি, শিমুল, আওয়াল, খামি, লুদ, বেলপই, ডুমুরের মতো প্রাকৃতিক বনভূমি বাস্তুসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিপন্নপ্রায় বৃক্ষপ্রজাতি। নিহত গাছগুলোর ভেতর ছ্রেঙগান (ঝপযরসধ ধিষষরপযর) আদিধর্ম পালনকারী জেন্টিল খাসিদের কাছে এক পবিত্র বৃক্ষপ্রজাতি। এই গাছটি জেন্টিল খাসিরা কোনো সময়ই কাটেন না। নাহার পুঞ্জি এলাকায় দুটি প্রবীণ বটবৃক্ষকেও কেটে ফেলা হয়েছে। চাম, চামকাঁঠাল বা চাপালিশকে খাসিরা বলে সহ্ চাম (অৎঃড়পধৎঢ়ঁং পযধঢ়ষধংযধ জড়ীন.)। চামের পাকা ফল খাওয়া যায়, বীজ পুড়িয়ে খাওয়া যায় এবং এই গাছটি লতানো খাসি গাছপানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। পাশাপাশি বনের বানর-হনুমানসহ পাখপাখালির খাবারও জোগান দেয় এই গাছ। নিহত গাছের ভেতর ডুমুর বা সহ্ রহং (ঋরপঁং যরংঢ়রফধ)-এর পাকা ফল খাওয়া যায়, এর কচি ডগা, কচি পাতা ও সবুজ ফল রান্না করে খান খাসিরা। হাত-পা কেটে গেলে এর কচি পাতার প্রলেপ লাগানো একটি ঐতিহ্যবাহী খাসি চিকিৎসারীতি। পানচাষি খাসিয়াদের গাছপান চাষের জন্য এই গাছগুলো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ লতানো খাসি গাছপান এসব দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতিকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে। আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস-ম্যাঞ্জিয়ামের মতো আগ্রাসী প্রজাতির শরীরের বাকল খাসি গাছপান লতিয়ে উঠবার জন্য একেবারেই বেমানান। নিহত গাছগুলো ছিল খাসি পানজুমের এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফসলি জমিন। এক একটি পানগাছ হতে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়। কিন্তু খাসি পানজুম এবং যাপিত জীবনের কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া এভাবে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত যেন ফসল রেখে ফসলের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা। যার কোনো বিচার মেলেনি আজও। অথচ বিশ্বদরবারে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিজ দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে চেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে।
১৯৮৪ সালে নাহার চা বাগানের তৎকালীন মালিকের কাছ থেকে ৪৫০ একর টিলাভূমি ইজারা নিয়ে বসবাসকারী খাসি জনগণ দীর্ঘসময় ধরে উচ্ছেদ আতঙ্কের ভেতর আছেন। নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপক পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সরকারের নীতি অনুযায়ী প্রতবছর আড়াই শতাংশ হারে চা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। চা চাষ সম্প্রসারণের জন্য খাসিয়াদের ভূমি ছাড়তেই হবে। তবে তারা চাইলে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে এখানে থাকতে পারে (৯ মে ২০১১)। নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক এই ধৃষ্টতাপূর্ণ উস্কানিমূলক বক্তব্য চা বাগান, খাসি জনগণ, সরকার এবং সর্বোপরি দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ সরকার কখনোই কোনো মানুষকে উচ্ছেদ করে চা চাষ সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেনি। আর এক স্বাধীন জাতিকে 'চা শ্রমিক' হয়ে যাওয়ার মতো কোনো ধৃষ্টতাও তিনি দেখাতে পারেন না। বর্তমান সরকার 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০' প্রণয়ন করেছে। বির্তির্কত হলেও ওই আইনের অনুচ্ছেদ ৯. ক ধারায় 'সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, কারুশিল্প, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে।' বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এ আদিবাসী ও বননির্ভর জনগণের প্রথাগত বন অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নাহার পুঞ্জির খাসি জনগণই কেবল নয়, পুঞ্জি দুটির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অনেক বাঙালি ও চাবাগানী পরিবার। ক্লান্তিবিনাশী পানীয় চা চাষের জন্য বাগান সম্প্রসারণ করতে গিয়ে সরকার কোনোভাবেই কোনো জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিকর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে না। নাহার পুঞ্জির খাসি জনগণের জান ও জীবনের বিকাশমানতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অবিলম্বে নাহারপুঞ্জি উচ্ছেদ করে চা বাগান সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক। নাহারপুঞ্জির বৃক্ষ, মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জীবনধারার প্রতি প্রতিষ্ঠিত হোক রাষ্ট্রের প্রতিবেশীয় ন্যায়বিচার। কারণ চা পানের চাইতেও জরুরি মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার নিরন্তর লড়াই। বৈষম্যের চায়ের পেয়ালা হাত থেকে সরিয়ে রাষ্ট্র যদি নাহারপুঞ্জির খাসি জনগণের জীবনযন্ত্রণাকে ন্যায়পরায়ণতার চুমুকে চুমুকে আয়ত্ত না করতে পারে তবে নিম্নবর্গের ক্লান্তিময়তা কখনোই দূর হবে না।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ animistbangla@gmail.com
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মাত্র পঁচিশ দিনের মাথায় ২০০৮ সালের ৩০ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নাহার চা বাগানের খাসি পানপুঞ্জি এলাকার গাছ কাটার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির চার হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বন বিভাগ। নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ লিখিত আগস্ট ২০০৮ তারিখের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নাহার চা বাগানের ৪ হাজার গাছের ভেতর ৩ হাজার ৭৪৫টি গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে। গাছগুলো থেকে মোট ৮৭ হাজার ১৭৪ ঘনফুট কাঠ এবং ৭৫ হাজার ৫০৮ ঘনফুট জ্বালানি লাকড়ি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষ কাঠ ব্যবসায়ী মোঃ সেলিম উদ্দিন মহালদারের মেসার্স সালিম টিম্বার অ্যান্ড ট্রেডার্সের কাছে দেড় কোটি টাকায় গাছগুলো বিক্রি করে দেয়। ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে গাছ কাটা শুরু হলে স্থানীয় খাসি আদিবাসীদের বন ও বসতি রক্ষার আন্দোলনের ফলে বিষয়টি দেশব্যাপী মনোযোগ তৈরি করে। খাসি আদিবাসীদের সঙ্গে গাছ রক্ষার এই আন্দোলনে জড়িত হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), গণমাধ্যম, পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় জনগণ। পরে ১৯ অক্টোবর ২০০৮ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গাছ কাটার অনুমোদন বন্ধ করে। ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি এলাকাটি পরিদর্শন করে। পরবর্তীকালে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ দেলোয়ার হোসেন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আবারও খাসিপুঞ্জির ৪৫০টি গাছ বাদে ২ হাজার ৩৫০টি গাছ কাটার প্রশ্নহীন অনুমতি দেন মেসার্স সালিম ট্রেডার্সকে। ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও গাছ কাটার পক্ষে সাম্প্রতিক প্রতিবেশবিনাশী রায় ঘোষণা করেন। বিস্ময়করভাবে আবারও ১৩ মার্চ ২০১০ থেকে নাহার চা বাগান এলাকার জীবনমরণের শঙ্কা নিয়ে প্রহর গুনতে থাকা গাছের শরীর ধারালো করাতের কোপে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। এরই মধ্যে নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ হাজার বৃক্ষ হত্যা করেছে। এর ভেতর মাথা নিচু করে চলে গেছে অনেকগুলো ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস, ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। কিন্তু কোনো দিবসই নাহার পুঞ্জির বৃক্ষ ও মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে আমল দেয়নি।
নিহত গাছেদের ভেতর অধিকাংশই ছিল চাম, গামার, গর্জন, জাম, কড়ই, বনাক, রঙ্গি, শিমুল, আওয়াল, খামি, লুদ, বেলপই, ডুমুরের মতো প্রাকৃতিক বনভূমি বাস্তুসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিপন্নপ্রায় বৃক্ষপ্রজাতি। নিহত গাছগুলোর ভেতর ছ্রেঙগান (ঝপযরসধ ধিষষরপযর) আদিধর্ম পালনকারী জেন্টিল খাসিদের কাছে এক পবিত্র বৃক্ষপ্রজাতি। এই গাছটি জেন্টিল খাসিরা কোনো সময়ই কাটেন না। নাহার পুঞ্জি এলাকায় দুটি প্রবীণ বটবৃক্ষকেও কেটে ফেলা হয়েছে। চাম, চামকাঁঠাল বা চাপালিশকে খাসিরা বলে সহ্ চাম (অৎঃড়পধৎঢ়ঁং পযধঢ়ষধংযধ জড়ীন.)। চামের পাকা ফল খাওয়া যায়, বীজ পুড়িয়ে খাওয়া যায় এবং এই গাছটি লতানো খাসি গাছপানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। পাশাপাশি বনের বানর-হনুমানসহ পাখপাখালির খাবারও জোগান দেয় এই গাছ। নিহত গাছের ভেতর ডুমুর বা সহ্ রহং (ঋরপঁং যরংঢ়রফধ)-এর পাকা ফল খাওয়া যায়, এর কচি ডগা, কচি পাতা ও সবুজ ফল রান্না করে খান খাসিরা। হাত-পা কেটে গেলে এর কচি পাতার প্রলেপ লাগানো একটি ঐতিহ্যবাহী খাসি চিকিৎসারীতি। পানচাষি খাসিয়াদের গাছপান চাষের জন্য এই গাছগুলো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ লতানো খাসি গাছপান এসব দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতিকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে। আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস-ম্যাঞ্জিয়ামের মতো আগ্রাসী প্রজাতির শরীরের বাকল খাসি গাছপান লতিয়ে উঠবার জন্য একেবারেই বেমানান। নিহত গাছগুলো ছিল খাসি পানজুমের এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফসলি জমিন। এক একটি পানগাছ হতে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়। কিন্তু খাসি পানজুম এবং যাপিত জীবনের কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া এভাবে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত যেন ফসল রেখে ফসলের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা। যার কোনো বিচার মেলেনি আজও। অথচ বিশ্বদরবারে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিজ দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে চেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে।
১৯৮৪ সালে নাহার চা বাগানের তৎকালীন মালিকের কাছ থেকে ৪৫০ একর টিলাভূমি ইজারা নিয়ে বসবাসকারী খাসি জনগণ দীর্ঘসময় ধরে উচ্ছেদ আতঙ্কের ভেতর আছেন। নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপক পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সরকারের নীতি অনুযায়ী প্রতবছর আড়াই শতাংশ হারে চা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। চা চাষ সম্প্রসারণের জন্য খাসিয়াদের ভূমি ছাড়তেই হবে। তবে তারা চাইলে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে এখানে থাকতে পারে (৯ মে ২০১১)। নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক এই ধৃষ্টতাপূর্ণ উস্কানিমূলক বক্তব্য চা বাগান, খাসি জনগণ, সরকার এবং সর্বোপরি দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ সরকার কখনোই কোনো মানুষকে উচ্ছেদ করে চা চাষ সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেনি। আর এক স্বাধীন জাতিকে 'চা শ্রমিক' হয়ে যাওয়ার মতো কোনো ধৃষ্টতাও তিনি দেখাতে পারেন না। বর্তমান সরকার 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০' প্রণয়ন করেছে। বির্তির্কত হলেও ওই আইনের অনুচ্ছেদ ৯. ক ধারায় 'সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, কারুশিল্প, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে।' বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এ আদিবাসী ও বননির্ভর জনগণের প্রথাগত বন অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নাহার পুঞ্জির খাসি জনগণই কেবল নয়, পুঞ্জি দুটির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অনেক বাঙালি ও চাবাগানী পরিবার। ক্লান্তিবিনাশী পানীয় চা চাষের জন্য বাগান সম্প্রসারণ করতে গিয়ে সরকার কোনোভাবেই কোনো জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিকর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে না। নাহার পুঞ্জির খাসি জনগণের জান ও জীবনের বিকাশমানতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অবিলম্বে নাহারপুঞ্জি উচ্ছেদ করে চা বাগান সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক। নাহারপুঞ্জির বৃক্ষ, মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জীবনধারার প্রতি প্রতিষ্ঠিত হোক রাষ্ট্রের প্রতিবেশীয় ন্যায়বিচার। কারণ চা পানের চাইতেও জরুরি মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার নিরন্তর লড়াই। বৈষম্যের চায়ের পেয়ালা হাত থেকে সরিয়ে রাষ্ট্র যদি নাহারপুঞ্জির খাসি জনগণের জীবনযন্ত্রণাকে ন্যায়পরায়ণতার চুমুকে চুমুকে আয়ত্ত না করতে পারে তবে নিম্নবর্গের ক্লান্তিময়তা কখনোই দূর হবে না।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ animistbangla@gmail.com
No comments