ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন-পদোন্নতির অনিয়মে ক্ষুব্ধ ও হতাশ কর্মীরা by অমিতোষ পাল

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে চলছে আমলাতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেওয়ার মহোৎসব। অভিযোগ পাওয়া গেছে, গত কয়েক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩০ কর্মকর্তাকে 'সুপারসিট' করে উচ্চ পদে বসানো হয়েছে। এমনকি ২৯ জনকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে তাঁদের ওপরে বসানোর দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়েছে।


এতে করপোরেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে অফিসে গিয়ে কোনো রকম দায়িত্ব পালন করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কর্মকর্তাদের অনেকে পদোন্নতি না পাওয়ায় দায়সারাভাবে অফিস করছেন। তাঁদের ক্ষোভের কারণ, বাইরে থেকে প্রেষণে আসা সরকারি আমলারা তাঁদের পদগুলো দখল করে রেখেছেন। আর এসবের প্রভাব গিয়ে পড়ছে নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রমে।
আমলাতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক জিল্লার রহমান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানুল ইসলাম দুজনই সরকারের অতিরিক্ত সচিব। কিন্তু জিল্লার রহমান পদাধিকারবলে সুলতানুল ইসলাম চৌধুরীর চেয়ে জ্যেষ্ঠ এবং অনেক ক্ষমতাবান। জানা গেছে, সুলতানুল ইসলাম অতীতে মেধা তালিকায় জিল্লার রহমানের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। নিজের চেয়ে কম মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির অধীনে চাকরি করতে গিয়ে সুলতানুল ইসলাম চৌধুরী অস্বস্তিতে ভোগেন। দুজনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধও চলে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
অবশ্য জিল্লার রহমান বলেন, 'তাঁর (সুলতানুল ইসলাম) সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার কোনো সমস্যা নেই। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে কাজ করছেন। আমি আমার অবস্থান থেকে কাজ করছি। আর মেধা তালিকায় কে এগিয়ে ছিল, কে পিছিয়ে ছিল সেটা জানে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়।'
জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একই অবস্থা বিভাগীয় প্রধানদের ক্ষেত্রেও। যেকোনো কাজ করতে গেলে তাঁরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ফলে কোনো কাজই যথাসময়ে শেষ হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, আগে অঞ্চল থেকে ফাইল উপস্থাপন করলে মেয়র অনুমোদন দিয়ে দিতেন। এখন সেসব ফাইল অনুমোদন হয় না। আরেক কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে বিদেশে কর্মশালায় যান। পারিবারিক বা চিকিৎসাজনিত কাজেও বিদেশে যান। আগে মেয়রের অনুমোদনেই সবকিছু হয়ে যেত। এখন সেটা নানা হাত ঘুরে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এ জন্য লেগে যায় এক সপ্তাহ। অথচ আগে লাগত এক ঘণ্টা। এ প্রসঙ্গে জিল্লার রহমান বলেন, 'আমাকেও তো বিদেশে যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হয়। প্রকৃত প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় আপত্তি না করলে তো সমস্যা নেই।'
জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন : গত কয়েক মাসের ব্যবধানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অন্তত ৩০ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে পদোন্নতি দিয়ে দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বানানো হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৯ জনের জুনিয়র নিম্নমান সহকারী মোশারফ হোসেনকে উপকর কর্মকর্তা করা হয়েছে। চারজনকে ডিঙিয়ে কম্পিউটার অপারেটর জালাল হোসেন তালুকদারকে সহকারী প্রোগ্রামার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০ জনকে টপকে উপসহকারী প্রকৌশলী সালেকুজ্জামানকে সহকারী প্রকৌশলী করা হয়েছে। এ রকম ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণের উপসহকারী প্রকৌশলী মাহেব, উত্তরের মহিউদ্দিন, নিরাপত্তাকর্মী মো. সারোয়ার, সড়ক শ্রমিক কামাল হোসেন, স্প্রেম্যান খলিল, নিম্নমান সহকারী মীর সামাদ, কম্পিউটার অপারেটর সাহনাজ পারভীন, অফিস সহকারী মনোয়ার হোসেন, মো. আউয়ুব, লাইসেন্স সুপারভাইজার মঈন হোসেন, পিএ কামরুজ্জামান, স্টোরকিপার আ. বাসেদ প্রমুখের ক্ষেত্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনৈতিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হতাশ হয়ে অনেকে ঠিকমতো অফিস করেন না বলে জানা গেছে।
প্রেষণের কারণে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা : জনবল কাঠামো (অরগানোগ্রাম) অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনের মোট ১৬টি পদে প্রেষণে আসা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করার কথা। সেখানে প্রেষণে কাজ করছেন ৩৪ কর্মকর্তা। যেসব পদে প্রেষণে থাকার কথা নয়, বর্তমানে সেসব পদেও প্রেষণের লোক বসানো রয়েছে। অথচ বাইরে থেকে লোক এলে তাদের ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বেতন দিতে হয়। আর এই টাকা যায় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকেই। তার ওপর তাঁরা করপোরেশনকে কখনোই নিজের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবেন না বলে করপোরেশনের নিজস্ব কর্মীরা মনে করেন। তাঁদের মতে, বাইরে থাকা আসা কর্মকর্তারা সিটি করপোরেশনকে অনেকটা লুটপাটের জায়গা হিসেবে মনে করেন। বর্তমানে এই অবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা উত্তরের এক কর্মকর্তা। ফলে অন্য কর্মকর্তারা কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। তাঁদের অসন্তোষের প্রভাবও নগরীতে পড়ছে।
এসব বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব আবু শাহিদ শেখ কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে দক্ষিণের প্রশাসক জিল্লার রহমান বলেন, 'আমি নতুন এসেছি। এসব ঘটনা ঘটেছে কি না আমি জানি না। এখন আশা করছি সবকিছুই নিয়মমাফিক হবে। সেই চেষ্টাই করব।'

No comments

Powered by Blogger.