মহাস্থানগড়কে রক্ষা করা হোক

বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্বসম্পন্ন যে কয়টি স্থান আছে, তার মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড় অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এখানে গড়ে উঠেছিল পুণ্ড্র নগরী। পরবর্তীকালে অনেক সামন্ত রাজা এটিকে তাঁদের রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আজ থেকে ৫০০ বছর আগেও এই নগরীর অস্তিত্বের বিবরণ পাওয়া যায়।


কালক্রমে এর অধিকাংশ নিদর্শনই মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। যথাযথ খননের মাধ্যমে পুণ্ড্র নগরীর অনেক নিদর্শনই উদ্ধার করা সম্ভব। আর তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রত্নতাত্তি্বক কার্যক্রম ছাড়া সেখানে সব ধরনের খননকাজ নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু একটি মহল রাতের আঁধারে খননকাজ চালিয়ে সেখানকার মূল্যবান নিদর্শন ধ্বংস ও পাচারের কাজে নিয়োজিত বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর ও দুঃখজনক।
নাম বা বংশপরিচয়হীন মানুষ যেমন সমাজে কিছুটা অপাঙ্ক্তেয় থেকে যায়, তেমনি ঐতিহ্যহীন দেশ বা জাতিগোষ্ঠীও পৃথিবীতে অনেকটাই কদরহীন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। বিশ্ববাসীর সামনে তারা গর্বের সঙ্গে সেসব ঐতিহ্য তুলে ধরে। তারা যে একটি প্রাচীন সভ্য জাতিসত্তার উত্তরাধিকারী, সেটা তারা অহংকারের সঙ্গে প্রচার করে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিচয় তুলে ধরার জন্যও তারা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে। কিন্তু আমরা কেমন জাতি? একের পর এক আমরা আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তিগুলোকে ধ্বংস করে চলেছি! এগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের হলেও রাষ্ট্র বরাবরই এ ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। নামে মাত্র একটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থাকলেও তাদের লোকবল ও কাজ করার ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। কেন পুণ্ড্র নগরীর ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি? কেন সেগুলোকে সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিভাবে আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ব্যাপক হারে পাচার হয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর জাদুঘরে বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সংগ্রহে বাংলাদেশের যে পরিমাণ পুরাকীর্তি রয়েছে, সম্ভবত তার কিয়দংশও আমাদের রাষ্ট্রীয় জাদুঘরে নেই। ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এ ধরনের উদাসীনতার মূলে রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা ব্যক্তিদের অজ্ঞতা ও চিত্তের দৈন্য। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পাশাপাশি, দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণে সচেতন জনগোষ্ঠীরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। চোখের সামনে প্রাচীন নিদর্শনের ক্ষতি করতে দেখলেও আমরা অনেক সময়ই চোখ ফিরিয়ে নিই। স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়সহ বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদ-মন্দিরের জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরি করছে, অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই। রাষ্ট্রও নির্বিকার। এসব জমি ও নিদর্শনের এলাকা চিহ্নিত করে তাকে রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ নেই। মন্দিরের টেরাকোটা পর্যন্ত খুলে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, অথচ তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। আমরা আশা করি, রাতের আঁধারে খননকাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। পাশাপাশি, সরকার অবিলম্বে পুণ্ড্র নগরীর নিদর্শনগুলো উদ্ধার এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে।

No comments

Powered by Blogger.