ধর নির্ভয় গান-আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে একবার ভেবে দেখবেন কি? by আলী যাকের
রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন রয়েছে রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে জনসাধারণ। উভয়ের মধ্যে অতিসত্বর একটি এমন বোঝাপড়ার সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রাজনীতিবিদদের দ্বারা গৃহীত কোনো পদক্ষেপ অথবা তাদের কোনো ব্যর্থতা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কোনো ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি না হতে পারে।
তা না হলে রাজনীতিবিদদের একদিন জনসাধারণ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। এরপর যা ঘটতে পারে, সেটি এমন
ভয়াবহ যে তা ভাবতেও আমরা শিউরে উঠি
আজকাল তরুণদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। সম্প্রতি ফেসবুকের কল্যাণে তাদের এমন মত আরও বেশি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়। শুনলে মনে হয়, রাজনীতি যেন একটা অচ্ছুত বিষয়। আমি যখন বলি, আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি, ওদের ভাষায় ও যধঃব ঢ়ড়ষরঃরপং, তখন আমি রাজনীতির প্রতি আমার অনীহা প্রকাশ করি না। বরং ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করে ফেলি। রাজনীতিকে যারা ঘৃণা করে তাদেরও একটা রাজনীতি আছে বৈকি। পক্ষে মত এবং বিপক্ষে মতের মধ্যে খুব বেশি ফারাক থাকে না।
আমি এমন স্কুল এবং কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, যেসব বিদ্যায়তনে ছাত্ররাজনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আমার বাবা স্বয়ং একজন সরকারি আধিকারিক হওয়ার কারণে আমাদের বাড়িতেও রাজনীতি খুব একটা আলোচিত হতো না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর ছাত্ররাজনীতিই আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। প্রথমত, প্রতিটি দল একবার করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান করল, যেখানে আমাদের সবাইকে উপস্থিত থাকতে হতো। এরপরই নিয়মিতভাবে মধুদার ক্যান্টিনে কিংবা বলাইয়ের ক্যান্টিনে বিভিন্ন দলের সদস্যরা নবীনদের তাদের দলে টানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। বেশ কিছুদিন এ বিষয়ে আমি শক্ত অবস্থানেই স্থির হয়ে ছিলাম। ছাত্ররাজনীতি? নৈবচ নৈবচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের বছর দুয়েকের সিনিয়র এক ছাত্রের প্ররোচনায় আমি তার সঙ্গে তৎকালীন বামপন্থি এক নেতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন, রাজনীতি আর কিছু নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই অধিকার থেকে কেউ যদি কাউকে বঞ্চিত করে, সে বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। তিনি অবশ্য এত কাঠখোট্টাভাবে কথাগুলো বলেননি। তিনি খুব গুছিয়ে, একেবারে গল্পের মতো উপমা দিয়ে কথাগুলো আমায় বলেছিলেন। তার কথাগুলো মনে ধরেছিল নিশ্চয়ই। কেননা সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমি ওই বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবো।
এরপর থেকে ইউনিভার্সিটি জীবনে আমি ছাত্ররাজনীতিতে ব্যাক বেঞ্চার হলেও যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে যখন জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লাম, তখন রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়ি। তবে মতবাদ একটা ছিলই এবং সেই মতবাদটি থাকার ফলেই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে যখন আন্দোলন শুরু হলো, আমি ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। এটি যে কেবল আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়। আমাদের সহপাঠী অনেক বন্ধু, যাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চতর প্রশাসনিক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি শুরু করেছেন তারাও রাস্তায় নেমে এলেন। আমরা হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও যখন একটি স্বাধীন দেশের তরুণ-তরুণীদের দেখি, তারা অবলীলায় দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য ভুলে গিয়ে খোলাখুলি বলে, তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, তখন মনে বড় দুঃখ পাই। এই সেদিনও ফেসবুকে এক তরুণী রাজনীতি পছন্দ না করার কারণ হিসেবে বলেছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদের বাকবিতণ্ডার কথা, যা তার ভাষায় নিতান্ত অশালীন। সে বোধহয় জানে না যে রাজনীতিতে পক্ষে ও বিপক্ষে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়, সেটি রাজনীতির ইতিহাসে সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমনসের চামড়া মোড়ানো সুদৃশ্য বেঞ্চগুলো মেঝের সঙ্গে নাটবল্টু দিয়ে আটকানো। কথিত আছে, যখন ওগুলো আলগা ছিল তখন দুই দলের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির সময় এক দল অন্য দলের দিকে বেঞ্চ ছুড়ে মারত। ওয়েস্ট মিনস্টার-খ্যাত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি এই ধরনের উত্তাপ সঞ্চারিত হতে পারে, তাহলে আমাদের আর দোষ কী? আমরা তো কেবল হাঁটি হাঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছি।
এই পর্যন্ত যা বললাম সেটি সুস্থ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংবলিত দেশের কথা। কিন্তু আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের দেশের তরুণরা যদি রাজনীতিবিমুখ হয়, তবে এর পেছনে অসুস্থ রাজনীতির অশুভ পদচারণা সত্যিকার অর্থেই দায়ী। একটা সময় ছিল যখন অবিভক্ত বাংলায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের মতো নিঃস্বার্থ জনদরদি রাজনৈতিক নেতা আমাদের রাজনীতিকে অলঙ্কৃত করে রেখেছিলেন। এরপরের প্রজন্মে এসে রাজনীতিবিদরা ক্রমান্বয়ে নিজ স্বার্থের দিকে আকৃষ্ট হতে লাগলেন। দেশ তো দূরের কথা, এমনকি দলের প্রতিও তাদের আনুগত্য অথবা কর্তব্যবোধ ক্রমেই ধসে যেতে লাগল। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে, যা উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমত, পাকিস্তান যারা সৃষ্টি করেছিলেন তারা আমাদের পূর্ববঙ্গের প্রতি আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। কেবল নিজের শক্তিকে সংহত করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাহুবলকে ব্যবহার করতেন। ফলে আমরা অবৈধ সেনাশাসন দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছি প্রতিনিয়ত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানি সেনাশাসনের ঐতিহ্য আমরা পরিহার করতে পারিনি। এই ক্রমাগত সেনাশাসন কিছু স্বার্থপর, অর্থগৃধ্নু এবং সেনাধ্যক্ষের উচ্ছিষ্টলোভী তথাকথিত রাজনীতিবিদদের জন্ম দিয়েছে। এরাই আজকের রাজনীতির দুষ্টচক্র। এদেরই সহায়তায় সেনা প্রশাসকরা বিভিন্ন সময় জনকল্যাণকামী রাজনীতিবিদদের নির্বিচারে হত্যাও করেছে। এই যে কলঙ্কময় ইতিহাস, এরই সৃষ্টি আজকের রাজনৈতিক আবহ। এখানে রাজনীতির সাহায্যে অর্থ সমাগম এখন প্রথাসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই আজ যদি জনগণ তথা আমাদের তরুণ সম্প্রদায় রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করে তাহলে তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। তবে আশার কথা হলো, সব শেষ হয়ে যায়নি। কখনোই সব শেষ হয়ে যায় না। সুস্থ রাজনীতির ধারক এবং বাহক এখনও কিছু অবশিষ্ট আছেন, যারা নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতিকে সবচেয়ে ওপরে স্থান দেন। তাদের হাতকে আমাদের শক্ত করতে হবে। এবং তা করতে হলে রাজনীতিকে ঘৃণা করলে চলবে না। আমাদের সদলবলে তাদের কাছে পেঁৗছে যেতে হবে এবং মন খুলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরা এখনও আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। তবে তারা, এই সৎ রাজনীতিবিদরা যদি অসৎ রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে দেশকে ক্রমেই অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেবেন। এখানে সাধারণ মানুষেরও কিছু কর্তব্য আছে, যারা নিজ নিজ এলাকা থেকে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে এবং সংসদে পাঠিয়েছে তাদের কথা বলার জন্য, তাদের উচিত হবে এই প্রতিনিধিদের এলাকায় নিয়মিতভাবে আসতে আহ্বান করা। বস্তুতপক্ষে বাধ্য করা; যেন এলাকার প্রতি তারা নজর দেন। এটি হচ্ছে ভোটারদের কাজ। আর যারা এই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেন, অর্থাৎ দলের মাথায় যারা আছেন, তাদের কর্তব্য হচ্ছে এ বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা, যেন কনিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা তাদের নিজ এলাকায় নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকেন এবং জনগণের আশা-নিরাশা কিংবা সুখ-দুঃখের কথা শোনেন।
রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন রয়েছে রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে জনসাধারণ। উভয়ের মধ্যে অতিসত্বর একটি এমন বোঝাপড়ার সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রাজনীতিবিদদের দ্বারা গৃহীত কোনো পদক্ষেপ অথবা তাদের কোনো ব্যর্থতা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কোনো ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি না হতে পারে। তা না হলে রাজনীতিবিদদের একদিন জনসাধারণ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। এরপর যা ঘটতে পারে, সেটি এমন ভয়াবহ যে তা ভাবতেও আমরা শিউরে উঠি।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ভয়াবহ যে তা ভাবতেও আমরা শিউরে উঠি
আজকাল তরুণদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। সম্প্রতি ফেসবুকের কল্যাণে তাদের এমন মত আরও বেশি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়। শুনলে মনে হয়, রাজনীতি যেন একটা অচ্ছুত বিষয়। আমি যখন বলি, আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি, ওদের ভাষায় ও যধঃব ঢ়ড়ষরঃরপং, তখন আমি রাজনীতির প্রতি আমার অনীহা প্রকাশ করি না। বরং ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করে ফেলি। রাজনীতিকে যারা ঘৃণা করে তাদেরও একটা রাজনীতি আছে বৈকি। পক্ষে মত এবং বিপক্ষে মতের মধ্যে খুব বেশি ফারাক থাকে না।
আমি এমন স্কুল এবং কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, যেসব বিদ্যায়তনে ছাত্ররাজনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আমার বাবা স্বয়ং একজন সরকারি আধিকারিক হওয়ার কারণে আমাদের বাড়িতেও রাজনীতি খুব একটা আলোচিত হতো না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর ছাত্ররাজনীতিই আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। প্রথমত, প্রতিটি দল একবার করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান করল, যেখানে আমাদের সবাইকে উপস্থিত থাকতে হতো। এরপরই নিয়মিতভাবে মধুদার ক্যান্টিনে কিংবা বলাইয়ের ক্যান্টিনে বিভিন্ন দলের সদস্যরা নবীনদের তাদের দলে টানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। বেশ কিছুদিন এ বিষয়ে আমি শক্ত অবস্থানেই স্থির হয়ে ছিলাম। ছাত্ররাজনীতি? নৈবচ নৈবচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের বছর দুয়েকের সিনিয়র এক ছাত্রের প্ররোচনায় আমি তার সঙ্গে তৎকালীন বামপন্থি এক নেতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন, রাজনীতি আর কিছু নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই অধিকার থেকে কেউ যদি কাউকে বঞ্চিত করে, সে বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। তিনি অবশ্য এত কাঠখোট্টাভাবে কথাগুলো বলেননি। তিনি খুব গুছিয়ে, একেবারে গল্পের মতো উপমা দিয়ে কথাগুলো আমায় বলেছিলেন। তার কথাগুলো মনে ধরেছিল নিশ্চয়ই। কেননা সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমি ওই বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবো।
এরপর থেকে ইউনিভার্সিটি জীবনে আমি ছাত্ররাজনীতিতে ব্যাক বেঞ্চার হলেও যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে যখন জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লাম, তখন রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়ি। তবে মতবাদ একটা ছিলই এবং সেই মতবাদটি থাকার ফলেই বাঙালির স্বাধিকার নিয়ে যখন আন্দোলন শুরু হলো, আমি ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। এটি যে কেবল আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়। আমাদের সহপাঠী অনেক বন্ধু, যাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চতর প্রশাসনিক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি শুরু করেছেন তারাও রাস্তায় নেমে এলেন। আমরা হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও যখন একটি স্বাধীন দেশের তরুণ-তরুণীদের দেখি, তারা অবলীলায় দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য ভুলে গিয়ে খোলাখুলি বলে, তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, তখন মনে বড় দুঃখ পাই। এই সেদিনও ফেসবুকে এক তরুণী রাজনীতি পছন্দ না করার কারণ হিসেবে বলেছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদের বাকবিতণ্ডার কথা, যা তার ভাষায় নিতান্ত অশালীন। সে বোধহয় জানে না যে রাজনীতিতে পক্ষে ও বিপক্ষে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়, সেটি রাজনীতির ইতিহাসে সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমনসের চামড়া মোড়ানো সুদৃশ্য বেঞ্চগুলো মেঝের সঙ্গে নাটবল্টু দিয়ে আটকানো। কথিত আছে, যখন ওগুলো আলগা ছিল তখন দুই দলের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির সময় এক দল অন্য দলের দিকে বেঞ্চ ছুড়ে মারত। ওয়েস্ট মিনস্টার-খ্যাত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি এই ধরনের উত্তাপ সঞ্চারিত হতে পারে, তাহলে আমাদের আর দোষ কী? আমরা তো কেবল হাঁটি হাঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছি।
এই পর্যন্ত যা বললাম সেটি সুস্থ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংবলিত দেশের কথা। কিন্তু আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের দেশের তরুণরা যদি রাজনীতিবিমুখ হয়, তবে এর পেছনে অসুস্থ রাজনীতির অশুভ পদচারণা সত্যিকার অর্থেই দায়ী। একটা সময় ছিল যখন অবিভক্ত বাংলায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের মতো নিঃস্বার্থ জনদরদি রাজনৈতিক নেতা আমাদের রাজনীতিকে অলঙ্কৃত করে রেখেছিলেন। এরপরের প্রজন্মে এসে রাজনীতিবিদরা ক্রমান্বয়ে নিজ স্বার্থের দিকে আকৃষ্ট হতে লাগলেন। দেশ তো দূরের কথা, এমনকি দলের প্রতিও তাদের আনুগত্য অথবা কর্তব্যবোধ ক্রমেই ধসে যেতে লাগল। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে, যা উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমত, পাকিস্তান যারা সৃষ্টি করেছিলেন তারা আমাদের পূর্ববঙ্গের প্রতি আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। কেবল নিজের শক্তিকে সংহত করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাহুবলকে ব্যবহার করতেন। ফলে আমরা অবৈধ সেনাশাসন দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছি প্রতিনিয়ত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানি সেনাশাসনের ঐতিহ্য আমরা পরিহার করতে পারিনি। এই ক্রমাগত সেনাশাসন কিছু স্বার্থপর, অর্থগৃধ্নু এবং সেনাধ্যক্ষের উচ্ছিষ্টলোভী তথাকথিত রাজনীতিবিদদের জন্ম দিয়েছে। এরাই আজকের রাজনীতির দুষ্টচক্র। এদেরই সহায়তায় সেনা প্রশাসকরা বিভিন্ন সময় জনকল্যাণকামী রাজনীতিবিদদের নির্বিচারে হত্যাও করেছে। এই যে কলঙ্কময় ইতিহাস, এরই সৃষ্টি আজকের রাজনৈতিক আবহ। এখানে রাজনীতির সাহায্যে অর্থ সমাগম এখন প্রথাসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই আজ যদি জনগণ তথা আমাদের তরুণ সম্প্রদায় রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করে তাহলে তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। তবে আশার কথা হলো, সব শেষ হয়ে যায়নি। কখনোই সব শেষ হয়ে যায় না। সুস্থ রাজনীতির ধারক এবং বাহক এখনও কিছু অবশিষ্ট আছেন, যারা নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতিকে সবচেয়ে ওপরে স্থান দেন। তাদের হাতকে আমাদের শক্ত করতে হবে। এবং তা করতে হলে রাজনীতিকে ঘৃণা করলে চলবে না। আমাদের সদলবলে তাদের কাছে পেঁৗছে যেতে হবে এবং মন খুলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরা এখনও আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। তবে তারা, এই সৎ রাজনীতিবিদরা যদি অসৎ রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে দেশকে ক্রমেই অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেবেন। এখানে সাধারণ মানুষেরও কিছু কর্তব্য আছে, যারা নিজ নিজ এলাকা থেকে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে এবং সংসদে পাঠিয়েছে তাদের কথা বলার জন্য, তাদের উচিত হবে এই প্রতিনিধিদের এলাকায় নিয়মিতভাবে আসতে আহ্বান করা। বস্তুতপক্ষে বাধ্য করা; যেন এলাকার প্রতি তারা নজর দেন। এটি হচ্ছে ভোটারদের কাজ। আর যারা এই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেন, অর্থাৎ দলের মাথায় যারা আছেন, তাদের কর্তব্য হচ্ছে এ বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা, যেন কনিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা তাদের নিজ এলাকায় নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকেন এবং জনগণের আশা-নিরাশা কিংবা সুখ-দুঃখের কথা শোনেন।
রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন রয়েছে রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে জনসাধারণ। উভয়ের মধ্যে অতিসত্বর একটি এমন বোঝাপড়ার সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রাজনীতিবিদদের দ্বারা গৃহীত কোনো পদক্ষেপ অথবা তাদের কোনো ব্যর্থতা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে কোনো ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি না হতে পারে। তা না হলে রাজনীতিবিদদের একদিন জনসাধারণ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। এরপর যা ঘটতে পারে, সেটি এমন ভয়াবহ যে তা ভাবতেও আমরা শিউরে উঠি।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments