চলনবিলে অবাধে মা-মাছ নিধন

বর্ষায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাবনাসহ চলনবিলের নদী ও বিলগুলোতে অবাধে ডিমওয়ালা মা-মাছ ও পোনা নিধন করা হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে এ ধরনের মাছ নিধন ও বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো নজর দিচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে দেশি অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বর্ষা মৌসুম মাছের প্রজনন সময়। নতুন পানি আসতে শুরু করলে নদী, খাল ও বিলে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনায় ভরে ওঠে খাল-বিল ও নদী। কিন্তু এই সময়ই মাছ ধরার ধুম পড়ে। এতে মিঠা পানির প্রায় ২৫ থেকে ৩০ প্রজাতির দেশি মাছ এখন বিলীন হওয়ার পথে। মাত্র ৯০ থেকে ১০০ দিন ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা বন্ধ রাখলে দেশের মাছ ঘাটতি অনেকটা পূরণ হতে পারে।
পাবনা জেলার বেশ কয়েকটি নদী ও বিলপাড়ের বাসিন্দারা জানান, প্রধানত নদী থেকে খাল ও বিলে পানি ঢোকার পথগুলোতে অবাধে মাছ শিকার করা হচ্ছে। চাটমোহর উপজেলার বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়কের ১০ নম্বর সেতুর নিচে, হান্ডিয়াল ইউনিয়নের সওয়ালদাহ জোলা, ছাইকোলা ইউনিয়নের জিয়েল খড়া জোলা, বিলচলন ইউনিয়নের খলশেগাড়ি জোলা, সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল ও স্লুইসগেট জোলা, বেড়া উপজেলার কাজিরহাটের পদ্মা ও যমুনার মিলনস্থল, দিয়ার ব্রামুন্দি জোলা, ভাঙ্গুড়া উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের রূপসী জোলাসহ বিভিন্ন স্থানে সুতিজাল, বাদাইজাল, ভেশাল, কোঁচ ও জুতি (মাছ শিকারের ধারালো অস্ত্র) দিয়ে মাছ শিকার চলছে।
চাটমোহরের হাটিকুমরুল এলাকার বাসিন্দা মিলন সরকার জানান, প্রতি রাতে বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়কের ১০ নম্বর সেতুর নিচ থেকে মৎস্য শিকারিরা ২০০-৩০০টি করে ডিমওয়ালা বোয়াল মাছ ধরছেন। রাতভর মাছ শিকারের পর বিল এলাকার সবচেয়ে বড় মাছের আড়ত মইষলুটিতে এসব চড়া দামে বিক্রি হয়।
চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া গ্রামের ফনি হালদার জানান, শুধু বোয়াল নয়, ডিমওয়ালা মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা ও পুঁটি মাছ ধরা হচ্ছে। এসব মাছের দামও বাজারে চড়া। মির্জাপুর গ্রামের নেপোল হালদারসহ কয়েকজন জানান, মাছ শিকার ছাড়া এই মৌসুমে জেলেদের বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই। ফলে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা অন্যায় জেনেও সবাই এ কাজটি করছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাস মাছের প্রজনন সময়। এই সময় ডিমওয়ালা মা-মাছ ও নয় ইঞ্চির নিচে পোনা ধরা নিষিদ্ধ। মাছ শিকারিদের সচেতনতা বাড়াতে প্রণোদনামূলক কর্মসূচি, আলোচনাসভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। শিকারিদের বিকল্প কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নদী ও খাল-বিলগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার জেলেরা জানান, গত সপ্তাহের শুরু থেকে সিংড়া, গুরুদাসপুর ও আত্রাই এলাকায় বন্যার পানি ঢুকছে। নতুন পানি আসায় মা-মাছ ডিম পাড়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ায় মাছ শিকারিদের হাতে ধরা পড়ছে। এসব মাছ প্রতিদিন সকালে সিংড়া, গুরুদাসপুর, আত্রাইয়ের মাছের আড়তগুলোতে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিমভর্তি টেংরা, পুঁটি, মলা, বোয়াল, শোল, শিং, মাগুরসহ দেশীয় প্রজাতির ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ এসব আড়তে বিক্রি করা হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সিংড়া মৎস্য আড়তে প্রতি কেজি টেংরা ৭০০, মলা ৫০০, বোয়াল ১০০০ ও শিং মাছ ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। চলনবিল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সদস্যসচিব ডেইজি আহমেদ বলেন, এখন মাছের প্রজনন কাল। এ সময় মা-মাছ ধরা হলে আগামী মৌসুমে এ অঞ্চলে মাছের তীব্র সংকট দেখা দেবে। ইতিমধ্যে চলনবিলের ৪০ প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। অথচ প্রশাসন এসব মাছ শিকারি ও মাছ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সিংড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অদ্বৈত চন্দ্র দাস বলেন, ‘চলনবিল একটি বড় এলাকা। এ এলাকায় মা-মাছ নিধন রোধে প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবার সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। আমরা আমাদের সাধ্যমতো মা-মাছ নিধন রোধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

No comments

Powered by Blogger.