সময়ের প্রতিধ্বনি-তাহলে কি পদ্মা সেতু হবে না? by মোস্তফা কামাল
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের খবরটি ৩০ জুন সকালে প্রকাশ পায়। সকালেই জনৈক বিএনপি সমর্থক মহা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেন, 'জানেন! বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে দিয়েছে!' আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আবারও বললেন, 'আপনার বিশ্বাস হয় না?
সত্যি বলছি! টিভিতে স্ক্রল দিচ্ছে! পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার বড় বড় কথা বলেছে। এখন! সরকারের কারণে আমাদের জনগণের মুখে চুনকালি পড়ল!'
কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়। সরকারের যে ভুল ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের একগুঁয়েমি কিংবা উদাসীনতার খেসারত দিতে হলো এ দেশের সাধারণ মানুষকে। এটা সরকারও হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে। তবে ভুল বিশ্বব্যাংকও করেছে। সরকারের একজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি এ দেশের মানুষকে বঞ্চিত করতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে আমরা বিব্রত; ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিতও। তবে বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে সরকারের বিরোধীপক্ষ ভীষণ খুশি! কিন্তু কেন? এত উচ্ছ্বাস কেন তাদের? দেশের উন্নয়ন কি তারা চায় না? নাকি আওয়ামী লীগের শাসনামলে উন্নয়ন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে?
এটাই হচ্ছে আমাদের একটা বড় সমস্যা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপি যত ধরনের নেতিবাচক কাজ করা দরকার, তা করে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে জোর তৎপরতা চালায়। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও যে একই কাজ করেনি, তা নয়। পান থেকে চুন খসলেই উভয় দল বিদেশিদের কাছে নালিশ জানাতে ছুটে যায়। এতে যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা নিয়ে তারা ভাবে না। তারা ভাবে, যেকোনো উপায়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যাকে বলে!
পদ্মা সেতু দলীয় কোনো বিষয় নয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর উচিত ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ছিল। তাহলে তারা জনগণের কাছ থেকে বাহবা পেত। অথচ তারা তা করেনি। তারা চেয়েছে, বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করুক। তাহলে সরকারকে তুলোধুনো করা যাবে। তাতে যে দেশের বারোটা বেজে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শোনা যায়, বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের ব্যাপারে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ বেশ সক্রিয় ছিল। দুই পক্ষের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে দেশ যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের ঘটনা।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয় গত বছরের (২০১১) ২৮ এপ্রিল। পরে ২৮ মে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। ৯ সেপ্টেম্বর উইকিলিকস প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর ঠিক পর পরই ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। এতেই বোঝা যায়, আসলে এটা একটা ষড়যন্ত্রের খেলা।
যা হোক, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের অব্যবহিত পর ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ এবং ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে বদলি করা হয়। কিন্তু এতেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এখন শোনা যাচ্ছে, আবুল হোসেনকে শুধু সরিয়ে দেওয়াই নয়, তাঁর ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করার জন্যও বিশ্বব্যাংক সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার তাঁর ব্যাপারে এক ধরনের অনড় অবস্থান নিয়েছিল। অভিযোগের পর পরই আবুল হোসেনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার মন্ত্রণালয়ে ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে দাবি করেন। উল্টো তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করেছে, তার জন্য একদিন তারা লজ্জিত হবে।'
অথচ বিশ্বব্যাংক লজ্জিত হয়নি। বরং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করে। এর ফলে অভিযুক্ত মন্ত্রী আবুল হোসেন মারাত্মক চাপের মুখে পড়েন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আশা করা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক হয়তো তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকেও সে রকম আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিছুদিন আগেও সাংবাদিকদের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে শিগগির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। বিশ্বব্যাংক গত ৩০ জুন সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঋণচুক্তি বাতিল করে। চুক্তি বাতিলের কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তায় ১২০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।'
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করে ঋণচুক্তিটি বাতিল করল কেন? এ ক্ষেত্রে কোনো দুরভিসন্ধি ছিল কি না- সেই প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। আমরা জানতে পারলাম, সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দলকে গত সপ্তাহে ঢাকায় পাঠানো হয়। তারা সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তিনটি শর্ত দিয়েছিল। শর্ত তিনটি হচ্ছে- ১. অভিযুক্তদের ছুটি দিয়ে একটি বিকল্প পদ্ধতিতে সেতুর কাজ সম্পন্ন করতে হবে; ২. অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করতে হবে এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি থাকতে হবে। যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই শর্তগুলো মানতে সরকার রাজি হয়নি। এ ইস্যুতে আরো আলোচনা চলতে পারত। আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা যেত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বল্পসুদে (শর্তযুক্ত) ঋণ সহায়তা দিয়ে আসছে। সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ দেশের মানুষকে অপমান করার এখতিয়ার নেই বিশ্বব্যাংকের। এ জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রভাবশালী সদস্য দেশগুলোর উচিত বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। তিনি ঋণচুক্তি বাতিলের আগে কি বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিং করেছিলেন? সেখানে কি অধিকাংশ সদস্য দেশের মতামত ঋণচুক্তি বাতিলের পক্ষে ছিল?
বিশ্বব্যাংক নিশ্চয়ই অবগত আছে যে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলবাসী দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে। মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকার উদ্যোগ নেয়। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা একটি সমীক্ষাও করে। তারই ভিত্তিতে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৭ সালে ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। বিশ্বব্যাংক যেহেতু চুক্তি বাতিল করেছে, সেহেতু এডিবিও একই নীতি অনুসরণ করেছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। দুটি ব্যাংক একই নীতি-আদর্শ অনুসরণ করে বিধায় এডিবিকে বিকল্প ভাবার সুযোগ নেই। আর চুক্তিটি উন্নয়ন সহযোগীদের কনসোর্টিয়ামের অংশ বলে জাইকার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটিও অকার্যকর হয়ে যায়।
তবে আমরা মনে করি, এখনো সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি। সরকার হাল ছেড়ে না দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে পারে। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি বিশেষ টিম পাঠাতে পারে। ঢাকার কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গেও আলোচনা চলতে পারে। তিনি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি পদ্মা সেতু প্রকল্পে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অবশ্য সরকারের একটি অংশ বলতে চায়, বিশ্বব্যাংক অর্থই ছাড় করেনি; দুর্নীতি হলো কিভাবে? এর জবাব হচ্ছে, ক্ষমতার অপব্যবহারও দুর্নীতি।
একই সঙ্গে সরকারের উচিত বিকল্প অর্থের সন্ধান করা। যেকোনো মূল্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। এটা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থেই দরকার। আর এটা করতে পারলে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াও ক্ষমতাসীন দলের জন্য সহজ হবে। সরকারের হাতে এখন মালয়েশিয়ার একটি প্রস্তাব রয়েছে। সরকার চীনকেও সঙ্গে নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে প্রকল্প শুরু করলে খরচ অনেক বেশি পড়বে। আবার মালয়েশিয়ার ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। এতে মানুষের ওপর ঋণের বোঝা বাড়বে। এ বিষয়ে সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে আবারও আলোচনা করতে পারে। সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করতে পারে। বন্ধুপ্রতিম মালয়েশিয়া বা চীন নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতির মূল্য দেবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়। সরকারের যে ভুল ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের একগুঁয়েমি কিংবা উদাসীনতার খেসারত দিতে হলো এ দেশের সাধারণ মানুষকে। এটা সরকারও হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে। তবে ভুল বিশ্বব্যাংকও করেছে। সরকারের একজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি এ দেশের মানুষকে বঞ্চিত করতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে আমরা বিব্রত; ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিতও। তবে বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে সরকারের বিরোধীপক্ষ ভীষণ খুশি! কিন্তু কেন? এত উচ্ছ্বাস কেন তাদের? দেশের উন্নয়ন কি তারা চায় না? নাকি আওয়ামী লীগের শাসনামলে উন্নয়ন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে?
এটাই হচ্ছে আমাদের একটা বড় সমস্যা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপি যত ধরনের নেতিবাচক কাজ করা দরকার, তা করে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে জোর তৎপরতা চালায়। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও যে একই কাজ করেনি, তা নয়। পান থেকে চুন খসলেই উভয় দল বিদেশিদের কাছে নালিশ জানাতে ছুটে যায়। এতে যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা নিয়ে তারা ভাবে না। তারা ভাবে, যেকোনো উপায়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যাকে বলে!
পদ্মা সেতু দলীয় কোনো বিষয় নয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর উচিত ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ছিল। তাহলে তারা জনগণের কাছ থেকে বাহবা পেত। অথচ তারা তা করেনি। তারা চেয়েছে, বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করুক। তাহলে সরকারকে তুলোধুনো করা যাবে। তাতে যে দেশের বারোটা বেজে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শোনা যায়, বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের ব্যাপারে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ বেশ সক্রিয় ছিল। দুই পক্ষের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে দেশ যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের ঘটনা।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয় গত বছরের (২০১১) ২৮ এপ্রিল। পরে ২৮ মে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। ৯ সেপ্টেম্বর উইকিলিকস প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর ঠিক পর পরই ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। এতেই বোঝা যায়, আসলে এটা একটা ষড়যন্ত্রের খেলা।
যা হোক, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের অব্যবহিত পর ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ এবং ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে বদলি করা হয়। কিন্তু এতেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এখন শোনা যাচ্ছে, আবুল হোসেনকে শুধু সরিয়ে দেওয়াই নয়, তাঁর ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করার জন্যও বিশ্বব্যাংক সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার তাঁর ব্যাপারে এক ধরনের অনড় অবস্থান নিয়েছিল। অভিযোগের পর পরই আবুল হোসেনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার মন্ত্রণালয়ে ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে দাবি করেন। উল্টো তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করেছে, তার জন্য একদিন তারা লজ্জিত হবে।'
অথচ বিশ্বব্যাংক লজ্জিত হয়নি। বরং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করে। এর ফলে অভিযুক্ত মন্ত্রী আবুল হোসেন মারাত্মক চাপের মুখে পড়েন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আশা করা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক হয়তো তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকেও সে রকম আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিছুদিন আগেও সাংবাদিকদের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে শিগগির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। বিশ্বব্যাংক গত ৩০ জুন সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ঋণচুক্তি বাতিল করে। চুক্তি বাতিলের কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তায় ১২০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।'
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করে ঋণচুক্তিটি বাতিল করল কেন? এ ক্ষেত্রে কোনো দুরভিসন্ধি ছিল কি না- সেই প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। আমরা জানতে পারলাম, সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দলকে গত সপ্তাহে ঢাকায় পাঠানো হয়। তারা সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তিনটি শর্ত দিয়েছিল। শর্ত তিনটি হচ্ছে- ১. অভিযুক্তদের ছুটি দিয়ে একটি বিকল্প পদ্ধতিতে সেতুর কাজ সম্পন্ন করতে হবে; ২. অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করতে হবে এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি থাকতে হবে। যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই শর্তগুলো মানতে সরকার রাজি হয়নি। এ ইস্যুতে আরো আলোচনা চলতে পারত। আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা যেত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বল্পসুদে (শর্তযুক্ত) ঋণ সহায়তা দিয়ে আসছে। সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ দেশের মানুষকে অপমান করার এখতিয়ার নেই বিশ্বব্যাংকের। এ জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রভাবশালী সদস্য দেশগুলোর উচিত বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। তিনি ঋণচুক্তি বাতিলের আগে কি বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিং করেছিলেন? সেখানে কি অধিকাংশ সদস্য দেশের মতামত ঋণচুক্তি বাতিলের পক্ষে ছিল?
বিশ্বব্যাংক নিশ্চয়ই অবগত আছে যে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলবাসী দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে। মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকার উদ্যোগ নেয়। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা একটি সমীক্ষাও করে। তারই ভিত্তিতে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৭ সালে ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। বিশ্বব্যাংক যেহেতু চুক্তি বাতিল করেছে, সেহেতু এডিবিও একই নীতি অনুসরণ করেছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। দুটি ব্যাংক একই নীতি-আদর্শ অনুসরণ করে বিধায় এডিবিকে বিকল্প ভাবার সুযোগ নেই। আর চুক্তিটি উন্নয়ন সহযোগীদের কনসোর্টিয়ামের অংশ বলে জাইকার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটিও অকার্যকর হয়ে যায়।
তবে আমরা মনে করি, এখনো সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি। সরকার হাল ছেড়ে না দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে পারে। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি বিশেষ টিম পাঠাতে পারে। ঢাকার কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গেও আলোচনা চলতে পারে। তিনি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি পদ্মা সেতু প্রকল্পে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অবশ্য সরকারের একটি অংশ বলতে চায়, বিশ্বব্যাংক অর্থই ছাড় করেনি; দুর্নীতি হলো কিভাবে? এর জবাব হচ্ছে, ক্ষমতার অপব্যবহারও দুর্নীতি।
একই সঙ্গে সরকারের উচিত বিকল্প অর্থের সন্ধান করা। যেকোনো মূল্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। এটা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থেই দরকার। আর এটা করতে পারলে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াও ক্ষমতাসীন দলের জন্য সহজ হবে। সরকারের হাতে এখন মালয়েশিয়ার একটি প্রস্তাব রয়েছে। সরকার চীনকেও সঙ্গে নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে প্রকল্প শুরু করলে খরচ অনেক বেশি পড়বে। আবার মালয়েশিয়ার ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। এতে মানুষের ওপর ঋণের বোঝা বাড়বে। এ বিষয়ে সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে আবারও আলোচনা করতে পারে। সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করতে পারে। বন্ধুপ্রতিম মালয়েশিয়া বা চীন নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতির মূল্য দেবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments