যুক্তি তর্ক গল্প-ভুল বা বিলম্বের সুযোগ কম by আবুল মোমেন

নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই জনগণ সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অর্থাৎ কোনো দলই পরপর দুই মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারেনি, বড় দুই দলের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে।


এ থেকে সহজেই দুটি সিদ্ধান্ত টানা যায়—১. জনগণ পরিবর্তনকামী এবং ২. বর্তমান নিয়ে সবার মধ্যে বরাবর অসন্তোষ ও হতাশা থেকে যাচ্ছে। এরই প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পূর্ববর্তী সরকারি দলের বিরুদ্ধে জনগণ অত্যন্ত কঠোর ও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফলে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তাদের ভাগে জুটেছে মাত্র ৩২টি আসন। বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
এই বিপুল বিজয় ও বিপুল পরাজয় থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যাবে না যে জনগণ বিএনপিকে চিরকালের জন্য জবাব দিয়েছে বা আওয়ামী লীগকে দীর্ঘকালের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। মানুষ সর্বক্ষণ সরকারের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে থাকে। এই সূত্রে মনে রাখা দরকার, এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবেই সরকারের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষের ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছে সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে। কারণ, সেই স্বাধীনতা ও পাকিস্তান রাষ্ট্র নিয়ে সে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে জনগণ বাঙালির বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। একাত্তরে অনেক প্রত্যাশা ও অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। এবার যেহেতু প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল আরও জোরালো, তাই আশাভঙ্গ হতেও দেরি হয়নি। নব্বইতে মানুষ আস্থা রেখেছিল স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় গণতান্ত্রিক দলগুলোর ওপর। কিন্তু এবারও তার আশা ভঙ্গ হতে দেরি হয়নি, স্বপ্ন ফিকে হয়েছে দ্রুত। হয়তো দীর্ঘ ষাট বছরের পুঞ্জীভূত হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এ দেশের মানুষকে আরও অস্থির করে তুলেছে। কোনো নেতা বা দলের ওপর তার আস্থা দৃঢ় নয়, গভীর নয়। এর জন্য মানুষকে দোষ দেওয়া যাবে না। তারা বারবার বঞ্চিত, প্রবঞ্চিত হয়েছে।
ফলে পরিবর্তনের সময়োপযোগী স্লোগান দিয়ে বিপুল জনসমর্থন ও সাংসদ নিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নিশ্চিন্তে সময় কাটানোর সুযোগ নেই। আমরা বলব, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের সামনে ক্ষমতায় পাঠানোর জন্য যে দুটি বিকল্প ছিল তার মধ্যে সঠিক দলটিকেই তারা বাছাই করেছে। জনগণ পাঁচ বছরের দুঃশাসনের শাস্তি দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোটকে। আওয়ামী লীগকে এটা মনে রাখতে হবে বিএনপিকে এই শাস্তি দিতে গিয়েই মূলত তাদের জনগণ পুরস্কৃত করেছে। তবে এটাকে সবটাই নেতিবাচক ভোট হিসেবে গণ্য করলে ঠিক হবে না। কারণ, মানুষ সর্বান্তকরণে পরিবর্তন চাইছে, তাই আওয়ামী লীগের স্লোগানে বিশ্বাস করেছে। এর মধ্যে একটা বারতাও আছে ক্ষমতাসীন দলের জন্য—মানুষ দুঃশাসন তো বরদাশত করেই না, ব্যর্থতাকেও মেনে নেবে না।
জনগণ গত ষাট বছরে রাজনীতিবিদদের মুখ থেকে বহু কথা শুনেছে। মনে হয়, কথামালার রাজনীতির দিন এবার শেষ। এখন কাজের রাজনীতি করা ছাড়া জনমতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো পথ নেই। জনগণকে বোকা বানিয়ে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে আর জেতা যাবে না, ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতল না হারল, এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হতে থাকুক কিন্তু ক্ষমতায় থেকে কে কেমন ভূমিকা পালন করল, কাকে তারা ক্ষমতায় পাঠাবে, সে ব্যাপারে জনগণ কিন্তু হুঁশিয়ার হয়ে উঠেছে। বড় নেতাকেও ক্ষমতা থেকে বাদ দিতে আর কুণ্ঠিত হবে না মানুষ। এই নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন অনেকটা স্বাধীন ও প্রায় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে। জনগণ তাদের রায় নির্বাচনে প্রতিফলিত হতে দেখছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে।
এটা নিশ্চয় একটা প্রমাণ যে আমাদের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি অর্জন করে চলেছে। কিন্তু যদি সরকারের বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও স্বজনতোষণ অব্যাহতই থাকে তাহলে শেষ বিচারে এই গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বা ভোটাধিকার পেয়ে এবং তা প্রয়োগ করে জনগণের কী লাভ হবে? সে এটা প্রয়োগ করে কেবল জ্বলন্ত চুলা ও তপ্ত তাওয়ার মধ্যে অদলবদল করে না পাবে স্বস্তি না পাবে শান্তি।
অবশ্যই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এক নয়, মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়, রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা স্তিমিত থাকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণ কিছুটা হলেও সরকারি আনুকূল্য পায়, বাঙালি সংস্কৃতির রুদ্ধতা ঘোচে, কৃষি ও দেশীয় উদ্যোগ আনুকূল্য পায়। এও কম প্রাপ্তি নয়।
কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৬ কোটি যার ১০ কোটিই অতি দরিদ্র, তাদের সবার জীবনযাত্রার মান মানবেতর পর্যায়ে, দেশের শিক্ষার মান ভয়াবহ রকমের নিচে নেমে গেছে এবং দুর্নীতি প্রশাসন ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল সরকারের পরিবর্তন ঘটানো বা একদল ব্যক্তির পরিবর্তে আরেক দল ব্যক্তি ক্ষমতায় এল—পরিবর্তন এটুকু হলে তাতে জনগণের আকাঙ্ক্ষিত পথে পরিবর্তন আসবে না।
এবারে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকারে, প্রশাসনে, রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনা এভাবে সার্বিক ও মৌলিক পরিবর্তনের পক্ষে তাঁর সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পরিবর্তন ও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান, মন্ত্রিসভায় ও দলে নতুন মুখের নির্বাচন ও পুরোনো পরিচিত অনেকের নির্বাসনের মধ্যে মানুষ কাজে তাঁর কথার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছে। আমার বিশ্বাস, তিনি এখনো সেই পথেই আছেন। কিন্তু এই সঙ্গে অনেক বিষয়ে সরকারের দ্বিধা, দীর্ঘসূত্রতা, আপস এবং গা ভাসিয়ে দেওয়ার মনোভাবে মানুুষ কিন্তু শঙ্কিত না হয়ে পারছে না।
এ দেশের মানুষের এক নম্বর দুশ্চিন্তা ও শত্রুর নাম দুর্নীতি। কিছু ভুলভ্রান্তি ও অনেক সমালোচনা থাকলেও মানুষ কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে গত তত্ত্বাবধায়ক আমলেই এ দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছিল। বর্তমান সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে স্পষ্টত দুর্বল ও এর গতি ধীর করে দিয়েছেন। তাতে দুর্নীতির ও দুর্নীতিবাজের প্রতি সরকারের নমনীয়তা ও আপসকামিতার প্রমাণ পায় জনগণ। যখন দুর্নীতি দমন কমিশনকেও সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালদের ধরা ও বিচারের ক্ষেত্রে নানা শর্ত যুক্ত হতে থাকে, তখন জনগণ আশাহত হয়।
প্রধানত দুর্নীতির কারণে এবং দ্বিতীয়ত ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও মনোভাব অপরিবর্তিত থেকে যাওয়ার ফলে জনগণ কিন্তু প্রশাসনযন্ত্রের নাগাল পায় না, একদল উদ্ধত জনবিরোধী ক্ষমতাধরকে পায়, প্রকৃত জনদরদি জনসেবককে পায় না। সরকারের অনেক সদিচ্ছার অপমৃত্যু ঘটে এ কারণেই।
আমরা বুঝতে পারছি বিদ্যুৎ, দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দুর্নীতি দমনসহ অনেকগুলো বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। কিন্তু সরকারও সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে কাজ শুরু হতে দীর্ঘসূত্রতা চলছে, জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে, সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, জনগণের আশা ও আস্থা টলে যাচ্ছে।
বিরোধী দল অপেক্ষায় আছে কখন জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবে, কখন তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করবে। বিরোধী দল বিরোধিতার রাজনীতি শুরু করার জন্য মুখিয়ে আছে।
আমাদের ধারণা, জনগণের মধ্যে কিছু হতাশা কিছু গুঞ্জন শুরু হলেও এখনই সরকারের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা হারায়নি তারা। তা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের স্মৃতি এখনো তাদের মনে স্পষ্টই আছে। তা ছাড়া আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ষাট বছরের এই কথামালার তথা প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুতিভঙ্গ বা প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার রাজনীতির যবনিকা টানতে হবে। আর এটাই তার উপযুক্ত সময়। রাজনীতিবিদেরা সত্যিই পরিবর্তনের জন্য কতটা প্রস্তুত, আমরা জানি না। কিন্তু জনগণের মধ্যে সেই প্রস্তুতি পুরো মাত্রায় আছে। ফলে পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে তা ঘটাতে ব্যর্থ হলে জনগণ দ্রুত তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। একটা নতুন সমাজ তৈরির জন্য গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে মোটা দাগে প্রধানত চারটি ক্ষেত্রে—শিক্ষা, রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতিতে। সব ক্ষেত্রকেই যুগোপযোগী, গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ, কার্যকর এবং জনবান্ধব করতে হবে।
এই গুণগত পরিবর্তনের জন্য এর যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন—প্রধানত নির্বাচিত ক্ষমতাসীন সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা—তাঁদের অনেক পুরোনো ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে নতুন বা ওই পাঁচটি শর্ত পূরণের কথা মাথায় রেখে নিশ্চয় মনোজগতে বদল ঘটাতে হবে। সেদিক থেকে বলব, প্রশাসন থেকে ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি দূর করতে চাইলে রাজনীতি থেকেও তা দূর করতে হবে। ক্ষমতা এক বা সরকারের বিভিন্ন কেন্দ্রে পুঞ্জীভূত হলে কেবল যে গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হয় তা নয় জনগণের অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়।
রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবার সমানাধিকার ও সমান মর্যাদা নিশ্চিত করাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল শক্তি ও সৌন্দর্য। আমরা তার বিপরীতে চলছি কি না, সেটা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভাবতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.