মানুষের মুখ-সব থেকেও কিছু নেই যাঁর by শর্মিলা সিনড্রেলা

মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি। বিকেলবেলা খুব মন খারাপ। কী যে করি! বন্ধু সুর আর মামা মোস্তাকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার চৌডালার ছোট্ট একটা ব্রিজে। মাথার ওপর বিস্তৃত আকাশ আর পায়ের নিচে সীমাহীন জল দেখে নিমেষেই ভালো হয়ে যায় মন। মামার আরও কিছু বন্ধুবান্ধব এসে জড়ো হয়েছেন ইতিমধ্যেই।


ব্রিজের এই মাথা থেকে ওই মাথা ছুটে বেড়িয়ে আমরা নেমে আসি নিচে ছোটবেলায় রচনা লেখা নৌকা ভ্রমণ বাস্তবে উপভোগ করার জন্য। এই সময় আতাউর মামা প্রশ্ন করেন, ‘আম্মু, পটলপাতার বড়া খাবে?’ হ্যাঁ বলার আগেই আমি বড়া বিক্রেতার সামনে। ৬০ বছর বয়সী এক লোক বড়া ভাজছেন নিবিষ্ট মনে। আর তাঁরই চারপাশে ভিড় করে আছে প্রায় ১০-১২ জন, বড়া খাওয়ার জন্য। ঘুঁটে দিয়ে জ্বালানো উনুনের ওপর একটা ছোট তাওয়ায় কয়েকটা বড়া। হাতে তাঁর ছোট একটা প্লাস্টিকের বোতল, যার মুখটা খুবই সরু। অল্প অল্প করে সেই বোতল দিয়ে তেল ঢেলে দিচ্ছেন তিনি বড়ার ওপর। মনে মনে ভাবি, কেন তিনি একা একা বড়া ভাজছেন? হাতের কাছে তো অন্তত কেউ থাকবে। ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রী বা নাতি-নাতনি। কেউ তো? আমাদের কৌতূহল মেটান তিনি, ‘থাকবে না কেনে (কেন), আছে। স্ত্রী আছে কিন্তু অর তো প্যারালাইস। চলাফেরা করে কিন্তু কোনো কাজ করতে পারে না। মেয়েদের তো বিয়ে দিয়েছি আর ছেলে রহে (থাকে) আলাদা, খাইও আলাদা। ও মিষ্টির দোকানে কাজ করে, কীভাবে আমার কাছে থাকবে? অরও তো সংসার আছে।’ একা একা কাজ করছেন তিনি তবুও বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই বরং রয়েছে ভালোবাসা। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হই।
নাম তাঁর মনজুর আলী। বাড়ি এই ব্রিজের পাশেই, নন্দলালপুরে। ‘আগে নদীতে নৌকা বাহিতুং আর এই বড়া, চা বিক্রি করতুং এই নদীর ধারে। এখন তো সব রাস্তা হয়ে গেছে, তাই নৌকা আর চালানো হয় না। ৩০ বছর নৌকা বেহেছি। পাঁচ-ছয় বছর থেকে এই ব্যবসা করছি।’
দুই মেয়ে ও এক ছেলে মনজুর আলীর। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরও বিয়ে দিয়েছিলেন বড় সাধ করে কিন্তু ছেলের বউ তাঁর সঙ্গে থাকতে চাইল না। ‘ছোট মেয়ে টকির পাঁচ-ছয় বছরের দুটা ছেল্যা (ছেলে) সোহাগ আর আরমান থাকে আমার সঙ্গে। রোজ পহাতে (সকালে) অদের, নিজের আর বউয়ের জন্য রান্না করি। আর বৈকালে পাঁচটা থেকে এই বড়া বিক্রি করি। এই বড়া করার লেগে (জন্য) রোজ পটলপাতা, খেসারির ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ বাটতে হয়। হামি পারি না এত জিনিস বাটতে। বউর তো অসুখ, তাই একটা লোক রেখে দিয়েছি। রোজ বেটে দ্যায় আর বিশ টাকা ল্যায়। র‌্যাতে (রাতে) আর রান্না করতে পারি না, শুকনা খাবার খেয়ে লি।’ এই বয়সে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে যে তাঁর কতটা কষ্ট হয় তা ভাবতেও ভয় হয়। কিন্তু কী-ই বা করার আছে তাঁর, ভাগ্য যে তাঁকে এমনই বিড়ম্বনায় ফেলেছে।
জমি-জায়গা বলতে কিছুই নেই তাঁর। থাকেন এই মহানন্দা নদীর তীরে একটা ছাউনি তুলে। তাই এই নদীর সঙ্গেই তাঁর ভাব-ভালোবাসা। এই নদীতেই রয়েছে তাঁর স্বপ্ন-স্মৃতি আর এই নদীতেই মিশে রয়েছে তাঁর হাসি-কান্না। আমাদের গল্প শোনানোর আশায় স্মৃতি হাতড়ান তিনি, ‘যখন নদীতে নৌকা বাহিতাম, তখন একদিন আমের টুকরি লিয়ে যাচ্ছি। দেখি একটা জেলে মাছ ধরছে জাল ফেলে। হঠাৎ কী হলো নদীর ভেতর থেকে কী যেন একটা তার জাল ধরে টান দিল আর সে পড়ে গেল পানিতে। পরে আর লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
নিজের বলতে এখন আর কিছুই নেই, তাই করুণ স্বরে বলছিলেন, ‘পটলপাতার বড়া বিক্রি করি। এই পটলপাতাও তো হামার না, অন্য একজনার ভুঁই (খেত) থেকে লিয়ে আসি। যার কাছ থেকে আনি, তাকে রোজ বড়া খিলিয়ে দিই। বাড়িঘর আর আমি দিতে পারব কীভাবে? রোজ ৩০০ টাকা খরচ করি, দেখা যায় লাভ থাকে ৯০ বা ৮০ টাকা। তা দিয়ে খাওয়া-পরা চলে যায় কিন্তু জমাতে পারি না কিছুই। আমার ছেলে মনে হয় জায়গা কিনবে। ও কিছু টাকা জমিয়েছে।’ হ্যাঁ, ছেলের ঘর হবে তার কয়েক দিন পর কিন্তু সেই ঘরে কি তাঁর থাকা হবে? না হয়তো।
কাউকে তো জোর করে বেঁধে রাখা যায় না, তাই হয়তো নিজের ভাগ্যকে মেনে নিছেন মনজুর আলী। এবং এতেই খুশি হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই তো এখন তাঁর বেশি কিছু চাওয়া নেই, শুধু এ কাজটাই করে যেতে চান। খোলা আকাশের নিচে বসে কাজ করতে বেশ সমস্যাও হয় তাঁর। অনেক সময় বৃষ্টি এলে ভিজে যায় সবকিছু। তখন আশ্রয় নেন একটা ছাউনির নিচে, যেটা তাঁর না। সকালে সেখানে এক লোক সবজি বিক্রি করে। বিকেলে সেটা ফাঁকা থাকে বলেই হয়তো মাথাটুকু গুঁজতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.