ঝুঁকিপূর্ণ পেশা-নজরুলদের নীরব মৃত্যু by মশিউল আলম
১১ জুন ‘বার্ন ইউনিটের পোড়া কপাল’ শিরোনামের লেখায় একজন নজরুলের কথা উল্লেখ করেছিলাম। ২৫ বছর বয়সী তরুণ। দরিদ্র নির্মাণশ্রমিক। তাকে প্রথম দেখেছিলাম জুনের ৬ তারিখে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে; নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের শিকার হওয়া রোগীদের দেখতে গিয়ে। নজরুল অবশ্য নিমতলীর রোগী ছিল না।
ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সে ভর্তি হয়েছিল বার্ন ইউনিটে।
৬ জুনের পর থেকে প্রতিদিন টেলিফোনে নজরুলের খোঁজ নিয়েছি তার খালাতো ভাই জাহাঙ্গীরের কাছে। ভোলার লালমোহন থেকে আসা নজরুলের এই এক খালাতো ভাই ছাড়া ঢাকায় তার আর কেউ নেই। জাহাঙ্গীর জানাচ্ছিলেন, নজরুলের অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটছে। ৯ জুন তিনি জানালেন, তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে। ১০ জুন দুপুরে বার্ন ইউনিটে আবার গিয়েছিলাম; তখন আইসিইউতে নজরুলকে দেখেছি দুই চোখ বন্ধ। ঘুমাচ্ছিল সে। ১২ তারিখ বিকেল তিনটায় জাহাঙ্গীরকে ফোন করে জানতে চাই, ‘নজরুলের অবস্থা কী?’ জাহাঙ্গীর বললেন, ‘ভালো না, মারা গেছে। ডেড।’
বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম জাহাঙ্গীরের কাছে। তাঁর কণ্ঠে অবশ্য বিস্ময় ছিল না, তিনি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলেন, দিনরাত অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে তিলে তিলে মারা যাচ্ছে তাঁর খালাতো ভাইটি, যার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর, যার সামনে পড়ে ছিল জীবনের দীর্ঘ পথ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যেসব পোড়া রোগী চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ নজরুলের মতো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট রোগী। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা বিভিন্ন রকম। নজরুল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিল একটি বাড়ি তৈরির কাজ করতে করতে। ভূমি থেকে লোহার রড তিনতলার ছাদে তোলার সময় ৪৪০ কেভি বিদ্যুতের লাইনের সঙ্গে রডের স্পর্শের ফলে তার পরনের জামা-লুঙ্গি তো বটেই, গায়ের চামড়াও পুড়ে গিয়েছিল। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল সে। তাকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করিয়েছিলেন সেই বাড়ির মালিক। ৬ জুন বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে তার সংজ্ঞা ছিল, সে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন ধারণা করতে পারিনি, সে বাঁচবে না। কিন্তু সে সময় এইচডিইউতে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স তপন কুমার আমাকে বলেছিলেন, নজরুলের পোড়া ৪১ শতাংশ, তাও ফ্লেম বার্ন বা আগুনে পোড়া নয়, ইলেকট্রিক বার্ন। এমন রোগীকে বাঁচানো খুব কঠিন।
তার পাঁচ দিনের মাথায় নজরুল বিদায় নিল। অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে গেল এক বছর ১০ দিন বয়সী একটি শিশুসন্তান আর তার অসহায় মাকে। নজরুল চলে গেল নীরবে, কোনো সংবাদ শিরোনাম হলো না সে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের শিকার জীবিত, চিকিৎসারত রোগীদের চেয়ে নজরুল অনেক অভাগা। কারণ, নিমতলীর রোগীরা কেমন আছেন সে খবর এখনো নেওয়া হচ্ছে। নজরুলের খবর কেউ নিতে যায়নি। যেসব মানুষ নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত, তাদের অনেকেই এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। কেবল তখনই তারা সংবাদ শিরোনাম হতে পারে, যখন একসঙ্গে অনেকে দুর্ঘটনায় পড়ে প্রাণ হারায়। কিন্তু যদি সারা দেশে গড়ে দৈনিক একজন করেও মারা যায়, তাহলে এক বছরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৫। নিমতলীর মৃতের তালিকার (এ পর্যন্ত ১২৩) চেয়ে কিন্তু ঢের লম্বা হয়ে যায় এই ভাবে মৃতদের তালিকা। কিন্তু নিমতলীর মতো দুর্ঘটনা ঘটে খুব কদাচিৎ, নজরুলের মতো নীরব মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন।
১৩ জুন বেলা ১১টায় বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক সামন্তলাল সেনের সঙ্গে হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখার পর তাঁর কক্ষে বসে আলাপের একপর্যায়ে তিনি মন্তব্য করলেন, পোড়া রোগীদের চিকিৎসা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রিভেনশান—পোড়া ঠেকানো। কারণ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে, আগুনে বা এসিডে পুড়লে কেউ যদি মারা না-ও যায়, পুরোপুরি সুস্থ আর সে কখনোই হয় না। একটি অ্যালবাম খুলে তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট অনেক রোগীর ছবি দেখালেন, যাদের চিকিৎসা দিয়ে, অস্ত্রোপচার করে তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু তাদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই। আগুনে ও এসিডে পোড়া রোগীদেরও বেশির ভাগই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় না। সারা জীবন যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়; কর্মক্ষমতা হারিয়ে তারা বেঁচে থাকে পরিবারের ওপর একটা বোঝার মতো।
তাই দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ডা. সামন্তলাল সেন। তিনি দেখেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের শ্রমিকেরা খালি হাতে, বিপজ্জনক উচ্চতায় উঠে প্রয়োজনীয় প্রিকশান বা সতর্কতাপূর্ণ ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করেন; এবং শুধু শ্রমিকেরা নয়, প্রকৌশলীদেরও অনেকে হাতে গ্লাভস না পরেই কাজ করেন। ডা. সেন আরও জানালেন, বিভিন্ন কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের শিকার হয়ে অনেক শ্রমিক বার্ন ইউনিটে আসেন। অর্থাৎ যেসব কারখানায় বয়লার থাকে, সেগুলোতে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। বয়লার নির্মাণে ও ব্যবহারেও নিশ্চয়ই ত্রুটি থাকে, নইলে কেন সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ডেকে আনবে, তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন করে দেবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে মাঝেমধ্যেই বার্ন ইউনিটে যেতে হয়। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা দীর্ঘ দিন ধরে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। সেখানকার শ্রমিকেরা প্রায়ই কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে (প্রাণ না হারালে) বার্ন ইউনিটে আসেন চিকিৎসা নিতে। জাহাজভাঙা শিল্প কেবল সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে না; প্রতিবছর অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি, অঙ্গহানি ও স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। কারণ, সেখানেও শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই। সেখানকার শ্রমিকেরা বিষাক্ত পুরোনো জাহাজের লোহা কাটেন মুখে মুখোশ না পরে, হাতে গ্লাভস না পরে, খালি পায়ে, খালি গায়ে। বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের নীরব বিষক্রিয়া তো আছেই, সরবে ট্যাংকার বিস্ফোরণে একসঙ্গে অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও সেখানে মাঝেমধ্যেই ঘটে।
ডা. সামন্তলাল সেন জোর দিয়ে বলেন: দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। বাংলাদেশে যত ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তা নিয়মিত মনিটর করার জন্য সরকারের একটি সংস্থা থাকা উচিত। তৈরি পোশাকশিল্পের মতো আনুষ্ঠানিক শিল্পখাত ছাড়াও অনেক পেশা রয়েছে যেগুলো ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। নজরুলের মতো নির্মাণশ্রমিকেরা বাঁশ-দড়ির সাহায্যে বহুতল ভবনের অনেক উঁচুতে উঠে দেয়াল প্লাস্টার করেন, রং লাগান। তাঁদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এই শ্রমিকেরা এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন কেবল সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে (একজন তরুণ শ্রমিকের ভাষ্য: আল্লাহ আছে, কিছু হইব না)।
নজরুলের খালাতো ভাই বাংলাদেশ বিমানে মোটর ট্রান্সপোর্ট অপারেটর হিসেবে কর্মরত জাহাঙ্গীরকে আবার যখন ফোন করি (১৫ জুন), সেদিন নজরুলের মিলাদ। তার লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামে, ভোলার লালমোহনে। সেখানে নজরুলের মা আছেন। লাশ পাঠানোর খরচ বাবদ ১৪ হাজার টাকা দিয়েছেন নজরুল যে বাড়ি নির্মাণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন, তার মালিক ১০২ মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার সঞ্জয় রায় বাবু। তিনি নজরুলের চিকিৎসার সময় ১৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর জানালেন, চিকিৎসা বাবদ মোট খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা, এ টাকা গেছে তাঁর (জাহাঙ্গীরের) নিজের পকেট থেকে। সঞ্জয় রায়ের আরও টাকা দেওয়া উচিত বলে জাহাঙ্গীর মনে করেন। সঞ্জয় রায় অবশ্য মনে করেন, দুর্ঘটনার দায় তাঁর নিয়োজিত ঠিকাদার ইউনুস মিয়ার; ক্ষতিপূরণও তাঁরই দেওয়া উচিত। কিন্তু জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, ঠিকাদার আগাগোড়াই দূরে দূরে থেকেছেন। জাহাঙ্গীর তাঁর নাগাল পাননি। আমি অনেকবার মুঠোফোনে সঞ্জয় রায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, তাঁর নাম্বারটি বন্ধ। ইউনুস মিয়ার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে মনে হলো, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে নিয়োগকারীর জন্য বাধ্যতামূলক—এ বিষয়টি তাঁর জানাই নেই।
নজরুলের অকালমৃত্যু একটি দুর্ঘটনা বটে, কিন্তু সে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার ফলে। এর দায় অবশ্যই নিতে হবে বাড়ির মালিক বা তাঁর নিয়োজিত ঠিকাদারকে। আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁরা বাধ্য। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সংক্রান্ত বিধান মেনে চলার গাফিলতির কারণে শ্রমিকের মৃত্যু হলে নিয়োগকারীর চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু নজরুলের জন্য এখন মামলা-মোকদ্দমা করতে যাবে কে? তার চেয়েও বড় কথা, নজরুলের তরুণী স্ত্রী (২২) ও দুধের বাচ্চাটির (এক বছর ১০ দিন) ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার হয়ে গেল, এর জবাব কী?
এবং আরও বড় জিজ্ঞাসা: সারা দেশে এভাবে প্রতিদিন কতজন নজরুল ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে মজুরি বিক্রি করতে করতে প্রাণ হারায়, কিন্তু সংবাদ শিরোনাম হয় না?
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
৬ জুনের পর থেকে প্রতিদিন টেলিফোনে নজরুলের খোঁজ নিয়েছি তার খালাতো ভাই জাহাঙ্গীরের কাছে। ভোলার লালমোহন থেকে আসা নজরুলের এই এক খালাতো ভাই ছাড়া ঢাকায় তার আর কেউ নেই। জাহাঙ্গীর জানাচ্ছিলেন, নজরুলের অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটছে। ৯ জুন তিনি জানালেন, তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে। ১০ জুন দুপুরে বার্ন ইউনিটে আবার গিয়েছিলাম; তখন আইসিইউতে নজরুলকে দেখেছি দুই চোখ বন্ধ। ঘুমাচ্ছিল সে। ১২ তারিখ বিকেল তিনটায় জাহাঙ্গীরকে ফোন করে জানতে চাই, ‘নজরুলের অবস্থা কী?’ জাহাঙ্গীর বললেন, ‘ভালো না, মারা গেছে। ডেড।’
বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম জাহাঙ্গীরের কাছে। তাঁর কণ্ঠে অবশ্য বিস্ময় ছিল না, তিনি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলেন, দিনরাত অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে তিলে তিলে মারা যাচ্ছে তাঁর খালাতো ভাইটি, যার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর, যার সামনে পড়ে ছিল জীবনের দীর্ঘ পথ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যেসব পোড়া রোগী চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ নজরুলের মতো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট রোগী। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা বিভিন্ন রকম। নজরুল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিল একটি বাড়ি তৈরির কাজ করতে করতে। ভূমি থেকে লোহার রড তিনতলার ছাদে তোলার সময় ৪৪০ কেভি বিদ্যুতের লাইনের সঙ্গে রডের স্পর্শের ফলে তার পরনের জামা-লুঙ্গি তো বটেই, গায়ের চামড়াও পুড়ে গিয়েছিল। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল সে। তাকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করিয়েছিলেন সেই বাড়ির মালিক। ৬ জুন বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে তার সংজ্ঞা ছিল, সে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন ধারণা করতে পারিনি, সে বাঁচবে না। কিন্তু সে সময় এইচডিইউতে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স তপন কুমার আমাকে বলেছিলেন, নজরুলের পোড়া ৪১ শতাংশ, তাও ফ্লেম বার্ন বা আগুনে পোড়া নয়, ইলেকট্রিক বার্ন। এমন রোগীকে বাঁচানো খুব কঠিন।
তার পাঁচ দিনের মাথায় নজরুল বিদায় নিল। অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে গেল এক বছর ১০ দিন বয়সী একটি শিশুসন্তান আর তার অসহায় মাকে। নজরুল চলে গেল নীরবে, কোনো সংবাদ শিরোনাম হলো না সে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের শিকার জীবিত, চিকিৎসারত রোগীদের চেয়ে নজরুল অনেক অভাগা। কারণ, নিমতলীর রোগীরা কেমন আছেন সে খবর এখনো নেওয়া হচ্ছে। নজরুলের খবর কেউ নিতে যায়নি। যেসব মানুষ নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত, তাদের অনেকেই এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। কেবল তখনই তারা সংবাদ শিরোনাম হতে পারে, যখন একসঙ্গে অনেকে দুর্ঘটনায় পড়ে প্রাণ হারায়। কিন্তু যদি সারা দেশে গড়ে দৈনিক একজন করেও মারা যায়, তাহলে এক বছরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৫। নিমতলীর মৃতের তালিকার (এ পর্যন্ত ১২৩) চেয়ে কিন্তু ঢের লম্বা হয়ে যায় এই ভাবে মৃতদের তালিকা। কিন্তু নিমতলীর মতো দুর্ঘটনা ঘটে খুব কদাচিৎ, নজরুলের মতো নীরব মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন।
১৩ জুন বেলা ১১টায় বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক সামন্তলাল সেনের সঙ্গে হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখার পর তাঁর কক্ষে বসে আলাপের একপর্যায়ে তিনি মন্তব্য করলেন, পোড়া রোগীদের চিকিৎসা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রিভেনশান—পোড়া ঠেকানো। কারণ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে, আগুনে বা এসিডে পুড়লে কেউ যদি মারা না-ও যায়, পুরোপুরি সুস্থ আর সে কখনোই হয় না। একটি অ্যালবাম খুলে তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট অনেক রোগীর ছবি দেখালেন, যাদের চিকিৎসা দিয়ে, অস্ত্রোপচার করে তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু তাদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই। আগুনে ও এসিডে পোড়া রোগীদেরও বেশির ভাগই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় না। সারা জীবন যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়; কর্মক্ষমতা হারিয়ে তারা বেঁচে থাকে পরিবারের ওপর একটা বোঝার মতো।
তাই দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ডা. সামন্তলাল সেন। তিনি দেখেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের শ্রমিকেরা খালি হাতে, বিপজ্জনক উচ্চতায় উঠে প্রয়োজনীয় প্রিকশান বা সতর্কতাপূর্ণ ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করেন; এবং শুধু শ্রমিকেরা নয়, প্রকৌশলীদেরও অনেকে হাতে গ্লাভস না পরেই কাজ করেন। ডা. সেন আরও জানালেন, বিভিন্ন কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের শিকার হয়ে অনেক শ্রমিক বার্ন ইউনিটে আসেন। অর্থাৎ যেসব কারখানায় বয়লার থাকে, সেগুলোতে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। বয়লার নির্মাণে ও ব্যবহারেও নিশ্চয়ই ত্রুটি থাকে, নইলে কেন সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ডেকে আনবে, তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন করে দেবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে মাঝেমধ্যেই বার্ন ইউনিটে যেতে হয়। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা দীর্ঘ দিন ধরে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। সেখানকার শ্রমিকেরা প্রায়ই কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে (প্রাণ না হারালে) বার্ন ইউনিটে আসেন চিকিৎসা নিতে। জাহাজভাঙা শিল্প কেবল সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে না; প্রতিবছর অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি, অঙ্গহানি ও স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। কারণ, সেখানেও শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই। সেখানকার শ্রমিকেরা বিষাক্ত পুরোনো জাহাজের লোহা কাটেন মুখে মুখোশ না পরে, হাতে গ্লাভস না পরে, খালি পায়ে, খালি গায়ে। বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের নীরব বিষক্রিয়া তো আছেই, সরবে ট্যাংকার বিস্ফোরণে একসঙ্গে অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও সেখানে মাঝেমধ্যেই ঘটে।
ডা. সামন্তলাল সেন জোর দিয়ে বলেন: দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। বাংলাদেশে যত ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তা নিয়মিত মনিটর করার জন্য সরকারের একটি সংস্থা থাকা উচিত। তৈরি পোশাকশিল্পের মতো আনুষ্ঠানিক শিল্পখাত ছাড়াও অনেক পেশা রয়েছে যেগুলো ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। নজরুলের মতো নির্মাণশ্রমিকেরা বাঁশ-দড়ির সাহায্যে বহুতল ভবনের অনেক উঁচুতে উঠে দেয়াল প্লাস্টার করেন, রং লাগান। তাঁদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এই শ্রমিকেরা এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন কেবল সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে (একজন তরুণ শ্রমিকের ভাষ্য: আল্লাহ আছে, কিছু হইব না)।
নজরুলের খালাতো ভাই বাংলাদেশ বিমানে মোটর ট্রান্সপোর্ট অপারেটর হিসেবে কর্মরত জাহাঙ্গীরকে আবার যখন ফোন করি (১৫ জুন), সেদিন নজরুলের মিলাদ। তার লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামে, ভোলার লালমোহনে। সেখানে নজরুলের মা আছেন। লাশ পাঠানোর খরচ বাবদ ১৪ হাজার টাকা দিয়েছেন নজরুল যে বাড়ি নির্মাণের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন, তার মালিক ১০২ মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার সঞ্জয় রায় বাবু। তিনি নজরুলের চিকিৎসার সময় ১৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর জানালেন, চিকিৎসা বাবদ মোট খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা, এ টাকা গেছে তাঁর (জাহাঙ্গীরের) নিজের পকেট থেকে। সঞ্জয় রায়ের আরও টাকা দেওয়া উচিত বলে জাহাঙ্গীর মনে করেন। সঞ্জয় রায় অবশ্য মনে করেন, দুর্ঘটনার দায় তাঁর নিয়োজিত ঠিকাদার ইউনুস মিয়ার; ক্ষতিপূরণও তাঁরই দেওয়া উচিত। কিন্তু জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, ঠিকাদার আগাগোড়াই দূরে দূরে থেকেছেন। জাহাঙ্গীর তাঁর নাগাল পাননি। আমি অনেকবার মুঠোফোনে সঞ্জয় রায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, তাঁর নাম্বারটি বন্ধ। ইউনুস মিয়ার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে মনে হলো, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে নিয়োগকারীর জন্য বাধ্যতামূলক—এ বিষয়টি তাঁর জানাই নেই।
নজরুলের অকালমৃত্যু একটি দুর্ঘটনা বটে, কিন্তু সে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার ফলে। এর দায় অবশ্যই নিতে হবে বাড়ির মালিক বা তাঁর নিয়োজিত ঠিকাদারকে। আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁরা বাধ্য। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সংক্রান্ত বিধান মেনে চলার গাফিলতির কারণে শ্রমিকের মৃত্যু হলে নিয়োগকারীর চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু নজরুলের জন্য এখন মামলা-মোকদ্দমা করতে যাবে কে? তার চেয়েও বড় কথা, নজরুলের তরুণী স্ত্রী (২২) ও দুধের বাচ্চাটির (এক বছর ১০ দিন) ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার হয়ে গেল, এর জবাব কী?
এবং আরও বড় জিজ্ঞাসা: সারা দেশে এভাবে প্রতিদিন কতজন নজরুল ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে মজুরি বিক্রি করতে করতে প্রাণ হারায়, কিন্তু সংবাদ শিরোনাম হয় না?
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments