রাজধানীজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চরম জনদুর্ভোগ
লায়েকুজ্জামান: জনদুর্ভোগ। চরম ভোগান্তি। রাজধানীজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব চলছে। খোঁড়া হচ্ছে রাজধানীর ১৫০ কিলোমিটার পাকা সড়ক। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ সড়কের এক পাশ কাটা, অন্য পাশের প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা মাটির ঢিবি, বালুর স্তূপ, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যন্ত্রপাতি, বিশাল আকৃতির সব ক্যাবল ড্রাম। আর তীব্র যানজট নগরজুড়ে। বাতাসে শহরজুড়ে ধুলাবালি, বৃষ্টিতে কাদা। নাকাল নগরের মানুষ। চরম জনদুর্ভোগের অপর নাম উন্নয়ন, সংস্কারের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। প্রতি বছর পুরাতন বাজেট শেষের আগে নতুন বাজেট পাসের আগে, ঠিক বর্ষা মওসুম শুরুর সময়ে, নগরবাসীকে দেখতে হয় ওই জনদুর্ভোগের উন্নয়ন কাজ। এ কাজ শেষ মুহূর্তের দায়সারা কাজ হিসেবেই পরিচিত। গাবতলী থেকে সায়েদাবাদ, কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত থেকে এয়ারপোর্ট সড়ক, মিরপুরের অলিগলিতে রাস্তা কাটা হচ্ছে প্রতিযোগিতা করে। কোন সংস্থা সড়কের এক পাশ দিয়ে কাটা শুরু করলে অন্য সংস্থা কাটছে রাস্তার মাঝ বরাবর। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে বিরক্ত এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ। অনেকে জানিয়েছেন তাদের তীব্র ক্ষোভের কথা। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব চলছে। কোন কোন এলাকায় রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাউকে দেখা যায় না খোঁড়া সড়কের পাশে। সিটি করপোরেশনের আইন অনুসারে রাজধানী শহরে কোন রাস্তা খোঁড়া হলে ২৮ দিনের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করতে হবে। কিন্তু সে আইন মানার কোন বালাই নেই কারও মধ্যে। গত তিন মাস ধরে গাবতলী থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত সড়ক খুঁড়ে পানির লাইন বসানোর কাজ চলছে। এখনও কাজ সমাপ্ত হয়নি। গতকাল সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, কল্যাণপুর এলাকায় রাস্তার মাঝখানে ওয়াসা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে, ডাইভারশনের কাজ চলছে। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীতে কম করে হলেও ৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। খোঁড়াখুঁড়ি করছে ৬টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ওয়াসা, ডেসকো, বিটিসিএল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, সামিট গ্রুপ এবং ফাইবার অ্যাট হোম। ওয়াসা রাস্তা খুঁড়ে পানির লাইন বসাচ্ছে, আন্ডারগ্রাউন্ড বিদ্যুৎ লাইনের কাজ করছে ডেসকো ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি। টেলিফোনের কাজ করছে বিটিসিএল। এনটিটিএন-এর অধীনে ইন্টারনেট সেবাদানে নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ ও ফাইভার অ্যাট হোম রাস্তা খুঁড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার অপটিক ক্যাবল লাইনের কাজ করছে। গতকাল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গাবতলী থেকে শ্যামলী পর্যন্ত সড়কের মাঝখান বরাবর কেটে পানির লাইন বসিয়েছে ওয়াসা। তিন মাস ধরে চলছে ওই লাইন বসানোর কাজ। লাইন বসানো শেষে কাটা রাস্তায় কেবল মাটি ভরাট করলেও এখনও যান চলাচলে বন্ধ রাস্তায় বেড়া দিয়ে ওয়াসার নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তার মাঝখানে রাখা হয়েছে ক্যাবলের বিশাল বিশাল ড্রাম। রাস্তা বন্ধ থাকায় চরমভাবে ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকা থেকে ঢাকায় আসা লোকদের। কল্যাণপুর থেকে শ্যামলীর দিকে আসতে সড়কের দক্ষিণ পাশ খুঁড়ে পানির লাইনের কাজ চলছে ওয়াসার। রাস্তার এক পাশ পুরো বন্ধ। ওই এলাকার দোকানদার মালেক জানান, গত তিন মাস ধরে এখানে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। আমিনবাজার থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরো সড়কের উত্তর পাশ কেটে বসে আছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি। গাবতলী সড়ক থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিডের রাস্তা খোঁড়ার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সরু সড়কে রাস্তার পাশে বিশাল গর্ত করে বিদ্যুতের লাইন বসানো হচ্ছে। এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য বললেন, রাস্তা কাটার কারণে প্রতিদিন এখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত সড়কের উত্তর পাশ কেটে কাজ করছে ডেসকো, সামিট গ্রুপ ও ফাইবার অ্যাট হোম। এখানে পথচারীদের দুর্ভোগ ছাড়াও ১০ নম্বর থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত এলাকায় প্রায় সিকি শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের মিন্টু সরণি কেটে ফেলে রাখা হয়েছে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের বিশাল আকারের কয়েক ডজন ড্রাম। ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। সড়ক বন্ধ থাকায় প্রায় আধাকিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় তাদের। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করে খোঁড়া রাস্তা মেরামতের নামে ফেলে রাখা হয়েছে বালুর স্তূপ। সামান্য বাতাসে বিপাকে পড়তে হচ্ছে পথচারীদের। মালিবাগ থেকে রামপুরা, বাড্ডা হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত এলাকার রাস্তা খুঁড়ে পানির লাইন বসাচ্ছে ওয়াসা। তেজগাঁও থেকে গুলশান শুটিং ক্লাব পর্যন্ত সড়ক এখান পুরোপুরি যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। একদিকে রাস্তা কাটা অন্যদিকে রাস্তার পাশে রাখা বালু আর ধুলো মিশে এক দুঃসহ অবস্থা তৈরি হয়েছে এখানে। রাজধানীর অন্যতম ভিআইপি এলাকা গুলশানেও চলছে রাস্তা খোঁড়ার উৎসব। গুলশান ২-এ দেখা যায়, গুলশান বাড্ডা লিংক রোড, গুলশানের ৮৬, ৯৪, ১০৪, ১১৬ নম্বর সড়ক, আজাদ মসজিদের পেছনের সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। গতকাল দুপুর থেকে রাস্তা খোঁড়া শুরু হয়েছে কাওরানবাজারের পেট্রোবাংলার সামনে। শ্যামলী এলাকার সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, শ্যামলীতে কাজী অফিসের পেছনের সড়কটি কাটার কারণে গত সপ্তাহে এখানে অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে না পারায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় একটি বস্তি। মিরপুর মিন্টু সরণির বাসিন্দা আবদুস সালাম, রমেন বিশ্বাস বললেন, আমাদের মূল রাস্তার আসার সংযোগস্থল কেটে রাখায় এখন তো আমাদের বিপদ হলে হাসপাতালেও যাওয়ার উপায় নেই। যেসব সড়ক কাটা হয়েছে সেখানে স্তূপ করে রাখা বালুর কারণে চলাচলই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ধুলাবালিতে নাকাল অবস্থা মানুষের। সামান্য বৃষ্টি হলেই স্তূপ করে রাখা মাটি পরিণত হচ্ছে কাদায়। কাদা মাটি ধুলো বালুতে ছড়াচ্ছে নানা রোগ জীবাণু। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজধানী জুড়ে যে পরিমাণ ধুলোবালু, এতে শিশুদের শ্বাসকষ্টের সঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছে বয়স্করাও। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর প্রধান প্রকৌশলী আহসানুল হক বলেন, বিভিন্ন সংস্থা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিয়ে রাস্তা খুঁড়ে সেবামূলক কাজ করে। তিনি জানান, চলতি বছর ডিসিসি উত্তর থেকে মোট ৫৮ কিলোমিটার রাস্তা খোঁড়ার জন্য ওয়াসা, ডেসকো, বিটিসিএল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, সামিট গ্রুপ ও ফাইবার অ্যাট হোম অনুমতি নিয়েছে। তারা কাজ করছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেন আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলীরা। কতটুকু রাস্তা খোঁড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। এটা পরে একসঙ্গে মিলিয়ে দিতে হবে। ডিসিসি দক্ষিণে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে ১শ’ কিলোমিটার। দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীই জানান, সবচেয়ে বেশি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে ওয়াসা। কিন্তু ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী জানালেন, বর্তমানে শুধু সায়েদাবাদ ওয়াটার প্ল্যান্টের অধীনে তাদের রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মাত্র ১০ কিলোমিটার রাস্তা খোঁড়ার কাজ চলছে। বিটিসিএল নিজেও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে এবং তাদের কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়া ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ ও ফাইবার অ্যাট হোম রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। এ বিষয়ে বিটিসিএল-এর পরিচালক রক্ষণাবেক্ষণ রফিকুল মতিন বলেন, ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের বিষয় জানি না, বিটিসিএল এবার খুব কম রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির পরিচালক (অপারেশন) নাজিমউদ্দিন জানান, বর্তমানে আগারগাঁও থেকে ক্যান্টনমেন্ট এবং আগারগাঁও থেকে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড পর্যন্ত সড়ক খুঁড়ে আমাদের ভূগর্ভস্থ ক্যাবল বসানোর কাজ চলছে কিন্ত কাজ শেষ হতে আমাদের আরও ৬ মাস সময় লাগবে। কারণ বর্ষা মওসুমে কাজ করা নিষেধ আছে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কাজ হতে ৬ মাস লাগবে ওই পুরো সময় রাস্তা খোঁড়া অবস্থায় থাকবে কিনা? তিনি বলেন, আমরা এখন বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করে দেবো। রাস্তার পুরো মেরামত কাজ করবে সিটি করপোরেশন। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পরে সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে পাওয়ার গ্রিডের ওই সব খোঁড়া রাস্তা অ-মেরামতই থেকে যাবে আরও ৬ মাস। ন্যাশন ওয়াইড টেলিকম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন)’র আওতায় নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান জানান, ঢাকা শহরে রাস্তা খুঁড়ে তাদের ক্যাবল বসানোর কাজ চলছে। তবে বর্তমান পর্যায়ে কতটুকু রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে এটা তার জানা নেই। তিনি বলেন, পুরো দেশেই তাদের ক্যাবল বসানো হবে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ প্রতি বছর বর্ষা মওসুমের শুরুতে রাস্তা খোঁড়ায় তাদের ভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা শহরকে নিয়ন্ত্রণ করে ১৯টি মন্ত্রণালয়ের ৫২টি সংস্থা। এ ভাবে অবাধে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রশ্ন উঠেছে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা নিয়ে। সরজমিন দেখা গেছে, একই সড়ক ওয়াসা খুঁড়ে পানির লাইন বসানোর ক’দিনই পরেই ওই রাস্তার আরেক পাশ খুঁড়ে ক্যাবল বসাচ্ছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি। রাজধানীবাসীর দুর্ভোগের কথা চিন্তা না করেই নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বর্ষা মওসুমে দেদারছে রাস্তা খোঁড়ার অনুমতি দিয়ে চলছে সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের বিধান অনুসারে রাস্তা খোঁড়ার ২৮ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার বিধান থাকলেও তা দেখার কেউ নেই।
No comments