অ্যাদোনিস-আমার কবি হয়ে ওঠার গল্প-ভাষান্তর: দিলওয়ার হাসান
আধুনিক আরবি কবিতার পথিকৃৎ বলে খ্যাত অ্যাদোনিসের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি, সিরিয়ার লাধকিয়া অঞ্চলের কাসাবিন গ্রামে। আরবি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ২০টিরও বেশি। তিন খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর রচনা সমগ্রের নাম ইফ অনলি দ্য সি কুড স্লিপ।
উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে পেজেস অব ডে অ্যান্ড নাইট, দ্য ব্লাড অব অ্যাদোনিস ও অ্যান ইনট্রোডাকশন টু অ্যারাব পোয়েটিক্স। তাঁর কবিতা আরবি থেকে ইংরেজিতে তরজমা করেছেন খ্যাতনামা অনুবাদক খালেদ মান্ডোয়া।
আমার জন্ম ১৯৩০ সালে, লাধকিয়া অঞ্চলের কাসাবিন নামের এক সাধারণ ও দরিদ্র গ্রামে। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই গ্রামটার অস্তিত্ব ছিল। গ্রামের ঘরবাড়িগুলো ছিল মাটি আর পাথরে তৈরি। বর্ষা এলেই মাটির ঘরে ফাটল ধরত আর আমরা খড় আর নতুন মাটি দিয়ে ঘরের চাল মেরামত করতাম। তার পরও অদৃশ্য সব ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ায় আমরা বাড়ির সবাই বাবা-মা, ভাইবোন ভিজে যেতাম। আমাদের বাড়িটা এত ছোট ছিল যে বাবা বড়সড় একটা কাঠের তক্তপোশ বানিয়ে উঁচুতে স্থাপন করেছিলেন। ওটাকে মনে হতো ঘরের মধ্যে ঘর। তক্তপোশের নিচের জায়গাটা আমরা নানা কাজে ব্যবহার করতাম। শীতের মৌসুমে যখন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ত, আমাদের একমাত্র গরুটা তার বাছুর নিয়ে ওটার নিচে ঘুমাত।
প্রতিদিন সকালে খালি পায়ে কুত্তাবে যেতাম। ‘কুত্তাব’ অর্থ গ্রামের শিক্ষকের বাড়ি, যেখানে বুড়ো মানুষ ছোট বাচ্চাদের লিখতে-পড়তে শেখাতেন। সুযোগ পেলেই আমি মাঠের দিকে চলে যেতাম আর ঘুরে বেড়াতাম এখানে-সেখানে। এ কারণে আমার শিক্ষক পড়ানোর সময় তাঁর বেতের অগ্রভাগ আমার হাঁটুর ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখতেন, যাতে আমি বেরিয়ে যেতে না পারি।
১২ বছর বয়সের আগে আমি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমরা যেখানে থাকতাম তার আশপাশে ওই জিনিসের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে যে স্কুলটা ছিল তার দূরত্ব এত বেশি ছিল যে আমার বয়সী বালকের পক্ষে হেঁটে রোজ সেখানে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। ওই বয়সটাতে আমি মোটরগাড়ি দেখিনি, রেডিও শুনিনি, বিদ্যুৎ জিনিসটা সম্পর্কেও জানা হয়নি। শহর? না, যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তখনো।
ওই বয়সটাতেই নিজের শরীর সম্পর্কে জানার সূত্রপাত হয়। নর-নারীর দেহমিলনের বিষয়ে প্রথম অভিজ্ঞতাটাও ওই বয়সেই হয় আমার। ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের গ্রামের বাইরে একটা উপত্যকায়, মেয়েটা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। ওই ব্যাপারটার পর আমি প্রায়ই মাটির ওপর আমার শরীর চেপে ধরতাম, যেন কোনো নারীকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলছি।
কুত্তাবের পড়ালেখা শেষ হলে আমার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে দূরের স্কুলে পাঠাবেন। এ কথা শুনে আমার মা উদ্বিগ্ন হয়ে একসময় অসুস্থই হয়ে পড়লেন। বাবা মাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে স্কুলে যেতে আমার তেমন অসুবিধা হবে না। কারণ আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে আব্বাস যে কি না বয়সে আমার চেয়ে বড়, আমার সঙ্গী হবে। একবার এক শীতের ঝোড়ো রাতে আমরা স্কুল থেকে ফিরছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুল আর আমাদের বাড়ির মাঝখানে একটা নদী ছিল, যার নাম ছিল আল-শিদ্ধা (ভয়ংকর প্রণালি)। নদীটি তখন ছিল কানায় কানায় ভরা। আব্বাস সাঁতরে নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আমি তীব্র বিরোধিতা করে বললাম, ‘এ নদী খুবই গভীর, সাঁতরে পার হতে গেলে আমরা ডুবে যাব। তার চেয়ে বরং আমরা অপেক্ষা করি।’
‘শোন, এখনো আলো আছে। অন্ধকার নামলে আর আমরা পার হতে পারব না, তখন পানি আরও বাড়তে পারে। এখনই পার হতে হবে, না হলে স্কুলে ফিরে যেতে হবে।’ বলেছিল আব্বাস।
আমার মনে হলো আব্বাস ওর সাহসের প্রমাণ দিতে চাইছে। আমার কাছে নয়, গ্রামবাসীর কাছে। কাজেই আব্বাসের ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না আমার।
নিজের কাছেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমরা নিরাপদে নদীর অপর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। আব্বাস একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল কত বড় ঝুঁকি আমরা নিয়েছিলাম। যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারতাম। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বইপত্র আর ব্যাগগুলো শুধু পানিতে ডুবে গিয়েছিল। আমরা গ্রামে পৌঁছালে সবাই উৎসবমুখরিত হয়ে ওঠে, খানাপিনার আয়োজন করা হয়।...
কিন্তু সেই গ্রাম এখন কোথায়? ৫০ বছর পরে যখন আবার ওই গ্রামে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল প্রাণহীন, মরা কোনো একটা জায়গায় আছি আমি। আরোহণ করছি একটা বায়ুর পর্বত। পিতৃভূমিতে গিয়েছিলাম, আসলে গিয়েছিলাম বাবাকে দেখতে। যিনি আর তখন বেঁচে ছিলেন না। তাঁর জানাজায়ও অংশ নিতে পারিনি। হয়তো অন্য সবার মতো জীবনের বাস্তবতার অংশভাগী হতে আর স্মৃতি ও কল্পনা পরীক্ষা করতে ওখানে আমার যাওয়া হয়েছিল। সময় অতিক্রান্ত হলেও আর তা আমাকে আমার জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেও কেন আমার মনে হয় যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল, তা কেবল একটা ভৌগোলিক ভূখণ্ড মাত্র নয়? কেন আমি অনুভব করি আমি আমার জন্মভূমি সৃষ্টি করতে পারি, যেমন করে সৃষ্টি করি কবিতা? আর কবিতার বিনির্মাণ তো কখনোই শেষ হয় না, তেমনি শেষ হয় না কোনো স্থানের নির্মাণ, যেখানে কারও জন্ম। হ্যাঁ, মানুষ একাধিকবার জন্ম নেয়, এক জায়গার চেয়ে বেশি জায়গায়।...
এক বৃষ্টিস্নাত সকালের কথা বলি। নীড়হারা একটা চড়ুইপাখির মতো কাঁপছিলাম। সিরিয়ার সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট আমাদের এলাকা সফরে আসছিলেন। তাঁর সংবর্ধনার দায়িত্বে ছিলেন যে গোত্রপ্রধান, আমার বাবার বিরুদ্ধ পক্ষের লোক ছিলেন। প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতা পাঠের কথা বললাম বাবাকে। তিনি আমার সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়ে কবিতা পাঠের ইচ্ছে ব্যক্ত করলে গোত্রপ্রধানের লোকজন আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। মনে মনে বললাম, যেকোনো মূল্যেই প্রেসিডেন্টের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে হবে আমাকে। জিবলা নামক স্থানটি ছিল প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানস্থল। আমি দ্রুত হেঁটে সেখানে পৌঁছালাম। গ্রামের চেয়ারম্যান ইয়াসিন আলী আদিবকে আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। তিনি সোজা প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বললেন, ‘প্রিয় প্রেসিডেন্ট, আপনাকে কবিতা পড়ে শোনানোর জন্য অনেকটা পথ হেঁটে একটা ছেলে এখানে এসে হাজির হয়েছে।’ তিনি কবিতা পাঠের অনুমতি দিলেন। সেই সময় আমার বয়স ১৩। তখন থেকেই ১৩ সংখ্যাটি আমার প্রিয়।...এই ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরে এক ফৌজি পুলিশ এসে বললেন, ‘তোমাকে তারতুস যেতে হবে স্কুলে পড়তে।’ ওখানে যাওয়ার পথে কেন জানি না গ্রামে থাকাকালে আমার জীবনের কিছু ঘটনার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছোট বোন সাকিনার দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য। তার কথা ভালো করে মনেও ছিল না, শুধু মায়ের বেদনা, অসহায়ত্ব আর নীরবতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।...
আমি যখন কল্পিত নাম হিসেবে নিজের নাম অ্যাদোনিস রাখি, তখন হাইস্কুলে পড়ি। বয়স ১৭। যেসব গদ্য ও পদ্য রচনা করতাম, তা শেষ করে নাম সই করতাম আমার আসল নাম অর্থাৎ আলি আহমদ সাঈদ। লেখাগুলো বিভিন্ন সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনে পাঠাতাম, কিন্তু কোনোটাই ছাপা হতো না। কিছু সময় এভাবে চলার পর আমি ক্রুদ্ধ ও হতাশ হয়ে পড়লাম। তখন একটা ম্যাগাজিনে (সম্ভবত লেবানন থেকে প্রকাশিত) অ্যাদোনিসের কাহিনি পাঠ করার সৌভাগ্য হয়। কেমন করে অ্যাদোনিস দেবী ইশতারের প্রেমে পড়েন, কী করে বন্য শূকরের হাতে মারা যান আর প্রতিবছর বসন্তে কী করে তাঁর পুনর্জন্ম হয়, এই সব আরকি। ওই কাহিনি আমাকে এত উদ্দীপিত করে যে মনে মনে ভাবি, এখন থেকে ওই নামে লিখব আমি। যেসব সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন আমার লেখা ছাপেনি তাদের অবস্থা ওই শূকরদের মতো হবে, যারা অ্যাদোনিসকে হত্যা করেছিল। অতএব অচিরেই একটা কবিতা লিখে ফেললাম আর নতুন নামে অর্থাৎ অ্যাদোনিস এই সইটা করে একটা সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দিলাম। এবার কিন্তু আমার লেখাটা ছাপা হলো। খুবই অবাক হলাম। আর একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম তাদের কাছে। এবার ওটি ছাপা হলো প্রথম পাতায়, সঙ্গে তাদের দপ্তরে যাওয়ার জন্য সম্পাদকের আমন্ত্রণ। লেখা প্রকাশিত হওয়ায় দারুণ উৎসাহিত হলাম। দেরি না করে লাধকিয়ায় অবস্থিত সংবাদপত্রের দপ্তরে গিয়ে হাজির হলাম। সম্পাদকের কক্ষে ঢুকে যখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আমি অ্যাদোনিস’, তিনি সাংঘাতিক হতাশ হলেন। মনে হলো তিনি একজন পরিণত মানুষকে আমার জায়গায় প্রত্যাশা করেছিলেন, একজন গ্রাম্য দরিদ্র তরুণকে নয়। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যিই কি তুমি অ্যাদোনিস?’ আমি বললাম, ‘কোনো সন্দেহ নেই।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ
আমার জন্ম ১৯৩০ সালে, লাধকিয়া অঞ্চলের কাসাবিন নামের এক সাধারণ ও দরিদ্র গ্রামে। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই গ্রামটার অস্তিত্ব ছিল। গ্রামের ঘরবাড়িগুলো ছিল মাটি আর পাথরে তৈরি। বর্ষা এলেই মাটির ঘরে ফাটল ধরত আর আমরা খড় আর নতুন মাটি দিয়ে ঘরের চাল মেরামত করতাম। তার পরও অদৃশ্য সব ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ায় আমরা বাড়ির সবাই বাবা-মা, ভাইবোন ভিজে যেতাম। আমাদের বাড়িটা এত ছোট ছিল যে বাবা বড়সড় একটা কাঠের তক্তপোশ বানিয়ে উঁচুতে স্থাপন করেছিলেন। ওটাকে মনে হতো ঘরের মধ্যে ঘর। তক্তপোশের নিচের জায়গাটা আমরা নানা কাজে ব্যবহার করতাম। শীতের মৌসুমে যখন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ত, আমাদের একমাত্র গরুটা তার বাছুর নিয়ে ওটার নিচে ঘুমাত।
প্রতিদিন সকালে খালি পায়ে কুত্তাবে যেতাম। ‘কুত্তাব’ অর্থ গ্রামের শিক্ষকের বাড়ি, যেখানে বুড়ো মানুষ ছোট বাচ্চাদের লিখতে-পড়তে শেখাতেন। সুযোগ পেলেই আমি মাঠের দিকে চলে যেতাম আর ঘুরে বেড়াতাম এখানে-সেখানে। এ কারণে আমার শিক্ষক পড়ানোর সময় তাঁর বেতের অগ্রভাগ আমার হাঁটুর ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখতেন, যাতে আমি বেরিয়ে যেতে না পারি।
১২ বছর বয়সের আগে আমি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমরা যেখানে থাকতাম তার আশপাশে ওই জিনিসের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে যে স্কুলটা ছিল তার দূরত্ব এত বেশি ছিল যে আমার বয়সী বালকের পক্ষে হেঁটে রোজ সেখানে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। ওই বয়সটাতে আমি মোটরগাড়ি দেখিনি, রেডিও শুনিনি, বিদ্যুৎ জিনিসটা সম্পর্কেও জানা হয়নি। শহর? না, যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তখনো।
ওই বয়সটাতেই নিজের শরীর সম্পর্কে জানার সূত্রপাত হয়। নর-নারীর দেহমিলনের বিষয়ে প্রথম অভিজ্ঞতাটাও ওই বয়সেই হয় আমার। ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের গ্রামের বাইরে একটা উপত্যকায়, মেয়েটা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। ওই ব্যাপারটার পর আমি প্রায়ই মাটির ওপর আমার শরীর চেপে ধরতাম, যেন কোনো নারীকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলছি।
কুত্তাবের পড়ালেখা শেষ হলে আমার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে দূরের স্কুলে পাঠাবেন। এ কথা শুনে আমার মা উদ্বিগ্ন হয়ে একসময় অসুস্থই হয়ে পড়লেন। বাবা মাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে স্কুলে যেতে আমার তেমন অসুবিধা হবে না। কারণ আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে আব্বাস যে কি না বয়সে আমার চেয়ে বড়, আমার সঙ্গী হবে। একবার এক শীতের ঝোড়ো রাতে আমরা স্কুল থেকে ফিরছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুল আর আমাদের বাড়ির মাঝখানে একটা নদী ছিল, যার নাম ছিল আল-শিদ্ধা (ভয়ংকর প্রণালি)। নদীটি তখন ছিল কানায় কানায় ভরা। আব্বাস সাঁতরে নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আমি তীব্র বিরোধিতা করে বললাম, ‘এ নদী খুবই গভীর, সাঁতরে পার হতে গেলে আমরা ডুবে যাব। তার চেয়ে বরং আমরা অপেক্ষা করি।’
‘শোন, এখনো আলো আছে। অন্ধকার নামলে আর আমরা পার হতে পারব না, তখন পানি আরও বাড়তে পারে। এখনই পার হতে হবে, না হলে স্কুলে ফিরে যেতে হবে।’ বলেছিল আব্বাস।
আমার মনে হলো আব্বাস ওর সাহসের প্রমাণ দিতে চাইছে। আমার কাছে নয়, গ্রামবাসীর কাছে। কাজেই আব্বাসের ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না আমার।
নিজের কাছেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমরা নিরাপদে নদীর অপর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। আব্বাস একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল কত বড় ঝুঁকি আমরা নিয়েছিলাম। যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারতাম। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বইপত্র আর ব্যাগগুলো শুধু পানিতে ডুবে গিয়েছিল। আমরা গ্রামে পৌঁছালে সবাই উৎসবমুখরিত হয়ে ওঠে, খানাপিনার আয়োজন করা হয়।...
কিন্তু সেই গ্রাম এখন কোথায়? ৫০ বছর পরে যখন আবার ওই গ্রামে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল প্রাণহীন, মরা কোনো একটা জায়গায় আছি আমি। আরোহণ করছি একটা বায়ুর পর্বত। পিতৃভূমিতে গিয়েছিলাম, আসলে গিয়েছিলাম বাবাকে দেখতে। যিনি আর তখন বেঁচে ছিলেন না। তাঁর জানাজায়ও অংশ নিতে পারিনি। হয়তো অন্য সবার মতো জীবনের বাস্তবতার অংশভাগী হতে আর স্মৃতি ও কল্পনা পরীক্ষা করতে ওখানে আমার যাওয়া হয়েছিল। সময় অতিক্রান্ত হলেও আর তা আমাকে আমার জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেও কেন আমার মনে হয় যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল, তা কেবল একটা ভৌগোলিক ভূখণ্ড মাত্র নয়? কেন আমি অনুভব করি আমি আমার জন্মভূমি সৃষ্টি করতে পারি, যেমন করে সৃষ্টি করি কবিতা? আর কবিতার বিনির্মাণ তো কখনোই শেষ হয় না, তেমনি শেষ হয় না কোনো স্থানের নির্মাণ, যেখানে কারও জন্ম। হ্যাঁ, মানুষ একাধিকবার জন্ম নেয়, এক জায়গার চেয়ে বেশি জায়গায়।...
এক বৃষ্টিস্নাত সকালের কথা বলি। নীড়হারা একটা চড়ুইপাখির মতো কাঁপছিলাম। সিরিয়ার সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট আমাদের এলাকা সফরে আসছিলেন। তাঁর সংবর্ধনার দায়িত্বে ছিলেন যে গোত্রপ্রধান, আমার বাবার বিরুদ্ধ পক্ষের লোক ছিলেন। প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতা পাঠের কথা বললাম বাবাকে। তিনি আমার সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়ে কবিতা পাঠের ইচ্ছে ব্যক্ত করলে গোত্রপ্রধানের লোকজন আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। মনে মনে বললাম, যেকোনো মূল্যেই প্রেসিডেন্টের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে হবে আমাকে। জিবলা নামক স্থানটি ছিল প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানস্থল। আমি দ্রুত হেঁটে সেখানে পৌঁছালাম। গ্রামের চেয়ারম্যান ইয়াসিন আলী আদিবকে আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। তিনি সোজা প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বললেন, ‘প্রিয় প্রেসিডেন্ট, আপনাকে কবিতা পড়ে শোনানোর জন্য অনেকটা পথ হেঁটে একটা ছেলে এখানে এসে হাজির হয়েছে।’ তিনি কবিতা পাঠের অনুমতি দিলেন। সেই সময় আমার বয়স ১৩। তখন থেকেই ১৩ সংখ্যাটি আমার প্রিয়।...এই ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরে এক ফৌজি পুলিশ এসে বললেন, ‘তোমাকে তারতুস যেতে হবে স্কুলে পড়তে।’ ওখানে যাওয়ার পথে কেন জানি না গ্রামে থাকাকালে আমার জীবনের কিছু ঘটনার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছোট বোন সাকিনার দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য। তার কথা ভালো করে মনেও ছিল না, শুধু মায়ের বেদনা, অসহায়ত্ব আর নীরবতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।...
আমি যখন কল্পিত নাম হিসেবে নিজের নাম অ্যাদোনিস রাখি, তখন হাইস্কুলে পড়ি। বয়স ১৭। যেসব গদ্য ও পদ্য রচনা করতাম, তা শেষ করে নাম সই করতাম আমার আসল নাম অর্থাৎ আলি আহমদ সাঈদ। লেখাগুলো বিভিন্ন সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনে পাঠাতাম, কিন্তু কোনোটাই ছাপা হতো না। কিছু সময় এভাবে চলার পর আমি ক্রুদ্ধ ও হতাশ হয়ে পড়লাম। তখন একটা ম্যাগাজিনে (সম্ভবত লেবানন থেকে প্রকাশিত) অ্যাদোনিসের কাহিনি পাঠ করার সৌভাগ্য হয়। কেমন করে অ্যাদোনিস দেবী ইশতারের প্রেমে পড়েন, কী করে বন্য শূকরের হাতে মারা যান আর প্রতিবছর বসন্তে কী করে তাঁর পুনর্জন্ম হয়, এই সব আরকি। ওই কাহিনি আমাকে এত উদ্দীপিত করে যে মনে মনে ভাবি, এখন থেকে ওই নামে লিখব আমি। যেসব সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন আমার লেখা ছাপেনি তাদের অবস্থা ওই শূকরদের মতো হবে, যারা অ্যাদোনিসকে হত্যা করেছিল। অতএব অচিরেই একটা কবিতা লিখে ফেললাম আর নতুন নামে অর্থাৎ অ্যাদোনিস এই সইটা করে একটা সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দিলাম। এবার কিন্তু আমার লেখাটা ছাপা হলো। খুবই অবাক হলাম। আর একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম তাদের কাছে। এবার ওটি ছাপা হলো প্রথম পাতায়, সঙ্গে তাদের দপ্তরে যাওয়ার জন্য সম্পাদকের আমন্ত্রণ। লেখা প্রকাশিত হওয়ায় দারুণ উৎসাহিত হলাম। দেরি না করে লাধকিয়ায় অবস্থিত সংবাদপত্রের দপ্তরে গিয়ে হাজির হলাম। সম্পাদকের কক্ষে ঢুকে যখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আমি অ্যাদোনিস’, তিনি সাংঘাতিক হতাশ হলেন। মনে হলো তিনি একজন পরিণত মানুষকে আমার জায়গায় প্রত্যাশা করেছিলেন, একজন গ্রাম্য দরিদ্র তরুণকে নয়। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যিই কি তুমি অ্যাদোনিস?’ আমি বললাম, ‘কোনো সন্দেহ নেই।’
ইংরেজি থেকে অনুবাদ
No comments