নারী ও সংস্কৃতি-‘ইভ টিজিং’ আসলে যৌন হয়রানি-নির্যাতন by মনজুর রশীদ খান

সম্প্রতি বখাটেদের জ্বালাতনে অসহ্য হয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কয়েকজন কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। নির্যাতন-নিপীড়নে বাধ্য হয়ে নারীদের আত্মহননের খবর আসছে প্রায়ই। এসিড নিক্ষেপ, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুনে পোড়ানো, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের মতো ভয়াবহ খবর তো আছেই।


ইভ টিজিং নামক উপদ্রবও বেড়ে চলছে। গণমাধ্যম ও বিভিন্ন ফোরামে বিশিষ্ট নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন এই অপতৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তারা সরকার তথা প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মেয়েদের উত্ত্যক্তকারী বখাটেদের অপকর্মকে ইভ টিজিং বলা হলেও আসলে এটি যৌন হয়রানি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্যাতন। উত্যক্তকারীদের বড় অংশ উঠতি বয়সী হলেও বেশি বয়সীও যে থাকে না তা নয়। কালক্রমে এদের কেউ কেউ যে মাদকসেবী, ধর্ষণকারী, সন্ত্রাসী বা খুনি হয়ে উঠতে পারে। ‘ইভ টিজিং’ শব্দবন্ধটির উৎপত্তি এই উপমহাদেশে। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশের অভিধানে শব্দটি নেই। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে এমন অপরাধ যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে। সুতরাং ইভ টিজিং নাম দিয়ে উত্ত্যক্তকারীদের বখাটেপনা, যা আসলে যৌন হয়রানি, তাকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়।
উত্ত্যক্তকারী তা অল্প বয়সী হোক বা অধিক বয়সী হোক, তাদের বিচরণ সর্বত্র। স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস, যানবাহন, বিপণিবিতান এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এমন হয়রানির অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে, মুম্বাই সিনেমা জগৎ ইভ টিজিংয়ের মতো অপকর্মের উৎপত্তিস্থল। হিন্দি সিনেমায় মূল আকর্ষণ হলো ফাইটিং ও ফ্লার্টিং (চটুল আচরণ)। ইভ টিজিং এর মাধ্যমে সেখানে নায়কেরা নায়িকাদের মন জয়ের চেষ্টা করে। নায়কের অসংযত, প্রশ্রয়পূর্ণ হাসিঠাট্টামূলক আচরণকে বাহবা দিয়ে উপভোগ করা হয়। তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েরা এসব দেখে নায়ক-নায়িকাদের মতো হতে চায়, তাঁদের মতো পোশাক পরা ও আচরণ করতে চায়। বখাটে রোমিওরা জুলিয়েট খোঁজে নিজ অবস্থানের আশপাশে। হয়তো কাছে পায় নিরীহ স্কুলগামী একটি ছাত্রী। চলে রাস্তাঘাটে হয়রানি, জ্বালাতন, ঠাট্টা-মশকরা ও উত্ত্যক্ত করা। মধ্য ও নিম্নবিত্তদেরই এই জ্বালাতন বেশি সহ্য করতে হয়। আজকাল স্কুলগামী ছাত্রী, কর্মজীবী মহিলা ও নানা কাজের জন্য বের হওয়া নারীর সংখ্যা বাড়ছে। নারী নির্যাতন ও হয়রানিও বাড়ছে। ভারতীয় ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, এই দুষ্কর্মের বিস্তৃতি সেখানের গ্রামগঞ্জে সর্বত্র, বিশেষ করে শহর ও শহরতলিতে। সারা ভারতেই নারী যৌন হয়রানির শিকার। গবেষকদের মতে, টিভি চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠান, নাটক, বিজ্ঞাপন ও হিন্দি সিনেমার নেতিবাচক প্রভাবে সেখানে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন মহামারির রূপ নিতে যাচ্ছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর মতে, সে দেশে নারীর বিরুদ্ধে হিংস্রতাজনিত অপরাধ সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। ২০০৭ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যৌন হয়রানি বাড়ার হার ১০ শতাংশ; সে বছর প্রায় দুই লাখ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। আমাদের দেশে এ বিষয়ে সমীক্ষা বা পরিসংখ্যান জানা থাকলে বোঝা যেত আমাদের অবস্থা কী। তবে আন্দাজ করা যায়, তা কমের দিকে নয়।
যৌন হয়রানি ও অপরাধ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল। এখানে ভারতের অনেক কিছুরই অন্ধ অনুকরণ চলে, ইভ টিজিং তারই একটি। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে হিন্দি গান, সিনেমা, সিরিয়ালসহ বিচিত্র সব বিনোদন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর এ আগ্রাসনে অনেকেই উদ্বিগ্ন। এর সঙ্গে আছে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোর কিছু বিজ্ঞাপন অতি অরুচিকর। এ দেশের টিভি চ্যানেলগুলোও এর অনুকরণের চেষ্টায় পিছিয়ে নেই। শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা যে চলছে, তা একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়। বিজ্ঞাপন বাণিজ্য এখন সারা বিশ্বেই রমরমা। পণ্যকে বাজারজাত করায় গুণগত মান নয়, বিজ্ঞাপনে নারীর আকর্ষণীয় উপস্থাপনাই কৌশল।
অন্যান্য শিল্পপণ্যের সঙ্গে এ দেশেও বেড়ে উঠছে ফ্যাশন ডিজাইন, ফ্যাশন শো, পোশাকব্যবসা, যার বাজারজাতের প্রধান মাধ্যম চটকদারি ও যৌন আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। উন্নত বিশ্বের সমাজবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন ফ্যাশন-শিল্প এবং বিজ্ঞাপনের অসাধারণ ও ভয়ংকর শক্তির কথা। ফ্যাশনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত পোশাকব্যবসার প্রধান টার্গেট হলো নারী, ছোট ছেলেমেয়ে ও তরুণ-তরুণীরা। তাদের জন্য তৈরি হয় অতি আকর্ষণীয় জামাকাপড়।
সব মিলিয়ে তরুণীরা বিশেষ করে অল্প বয়সীরা বেশি নাজুক। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণ-তরুণীদের একটি অংশের চিত্তবিনোদনসহ আধুনিকতার উপকরণ পেতে হয়তো অসুবিধা হয় না। কিন্তু অন্যদের উপায় কী? নিম্নবিত্ত বা নিম্ন বা অল্প আয়ের পরিবারের তরুণদের কথা ভাবুন, যাদের সংখ্যা লাখ লাখ। তাদের কেউ ছাত্র, কেউ বেকার ভবঘুরে, করার কিছু নেই। কিছুদিন আগেও দেশে রক্ষণশীল বা মধ্যমপন্থী মনোভাবেরই প্রাধান্য ছিল। তা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহের উপকরণসমৃদ্ধ আধুনিকায়ন, বিশ্বায়ন ও মুক্তবাণিজের সঙ্গে মুক্ত সমাজ নামের ঢেউয়ের তোড়ে বিলীন হতে চলছে। এসবের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ না হলে সমাজকে চরম মূল্য দিতে হবে। পরিবেশ দূষণের মতো সাংস্কৃতিক দূষণের ফলও কিন্তু মারাত্মক।
নারী নির্যাতন-নিপীড়ন নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? যে উপকরণ-উপাদান একজন উঠতি বয়সী ছেলেকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করতে প্রলুব্ধ করছে সেগুলো দূর করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসার লক্ষ্যে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও মনমানসিকতা বদলানোর যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তার প্রধান লক্ষ্য তরুণ-তরুণীরা। দেশি-বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের কাছে দেশপ্রেম, নৈতিকতা, ধর্মীয় বোধ দেশের অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি বিবেচ্য নয়। তাঁদের বিবেচ্য নয় নারীর মর্যাদা, নারীর নিরাপত্তা বা পারিবারিক ও সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা। নারীর স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের নামে উসকে দেওয়া হচ্ছে এমন কিছু উপাদান, যা আমাদের দেশ, সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সমাজকে ইভ টিজিং নামেই হোক বা যৌন নির্যাতন-নিপীড়নই হোক, তা থেকে রক্ষা করতে হলে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আইনি ব্যবস্থা যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনি প্রয়োগ করাও সহজ নয়। কাজেই বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়নের সঙ্গে যে ধ্বংসাত্মক নেতিবাচক দিকগুলো আসছে, তা বয়কট-বর্জন করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সঙ্গে অতি রক্ষণশীলতা ও অতি উদারতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের ভাষা সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধকে। আশা করি এ ক্ষেত্রেও আমাদের গণমাধ্যম যথাযথ ভূমিকায় নামতে বিলম্ব করবে না।
মেজর জেনারেল (অব.) মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।
mnzr23¦gmail.com

No comments

Powered by Blogger.