জীবন ও ফুটবল-ফুটবলে কী ঘটে by ফারুক ওয়াসিফ
ফুটবল যতটা খেলা ততটাই লীলা, জীবনের মতোই। জীবনের গোলপোস্টের সামনেও আমাদের নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাঠে খেলছে নানান খেলোয়াড়, তাদের পায়ে পায়ে ছুটছে আপনার জয়-পরাজয়। কেবল অপেক্ষা, কখন আপনার ভাগ্যকে লাথি দিতে দিতে প্রতিপক্ষ ছুটে আসবে। সব বাধা ডিঙিয়ে আসবেই তারা নিয়তির মতো।
আর আপনি জালের খাঁচার সামনে মহাকাব্যের বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন—একা। যেন দাঁড়িয়ে আছেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে।
জীবনে অনেকের অবদানই গোলকিপারের মতো স্কোরহীন। আপনার দুঃসাধ্য গোল ঠেকানো সবাই ভুলে যাবে, গোলদাতাই হবেন হিরো। রেফারিও স্বৈরাচারীর মতো অন্যের দোষে আপনাকেই ‘ফ্রি কিক’-এর সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে কিংবা দেবে পেনাল্টি। অথচ সাফল্য-ব্যর্থতা একা কারও নয়। কিন্তু টিভিতে দেখায়, দলের চেয়ে ব্যক্তি খেলোয়াড়ই বড়, সব কৃতিত্ব স্ট্রাইকারের। ক্লোজ-আপে, স্লো-মোশনে বারবার দেখিয়ে দর্শকের মনে তাঁর দেবোপম ছবি গেঁথে দেওয়া হয়। আর গোল যেন দীর্ঘ প্রেমের শেষে চরম পুলক, আধুনিক জীবনের মতো আধুনিক ফুটবলেও যা বিরল।
ফুটবল জীবনের মতোই ঘটন-অঘটনে ভরা। কখন কোথায় কোন তালপাতার সৈনিক বীর হয়ে উঠবে আর কোন বীরের পতন ঘটবে, কখন কোন পরাশক্তি গৌণ দলের কাছে হেরে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ফুটবলের বড় আকর্ষণ এই নাটকীয় অনিশ্চয়তা—যা কখনো কখনো ট্র্যাজেডি হয়ে যায়। এ জন্যই ক্রিকেটের বিশ্লেষণ ও কৌশল ঠিক করায় কম্পিউটার যতই জারিজুরি করুক, ফুটবল এখনো কম্পুযন্ত্রের আসরমুক্ত। ফুটবল এখনো মানবিক। এখনো পথের ছেলে পেলে বা ম্যারাডোনা বা রোনালদোর পক্ষে জনগণের রাজপুত্র হওয়া সম্ভব। এক মনোরোগ চিকিৎসকের মতে, বিষণ্ন ও হতাশ মানুষের উপযুক্ত চিকিৎসা হলো ফুটবল খেলা। দলবদ্ধ খেলা দেয় প্রাণশক্তি, দেয় আত্মবিশ্বাস। শেখায় নিজেকে ভালোবাসতে। যে মানুষটি এমনিতে আনস্মার্ট ও লাজুক, ফুটবলের আলোচনায় তিনিও মুখর। এই খেলা বৃদ্ধের মনে আনে কিশোরের উচ্ছ্বাস আর কিশোরকে করে ইঁচড়ে পাকা ক্রীড়া বিশ্লেষক। এমন জাদুকরী প্রভাবের জন্যই বলা হয়, ফুটবল হলো জনগণের জন্য আফিম। দরিদ্রদের জন্য প্রতিদিনকার একঘেঁয়েমি আর জীবনযন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকার মহৌষধ হলো এই খেলা।
বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্যও কিন্তু ফুটবল। ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ফুটবল-ভক্তি বিষয়ে উভয়ের একমত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বৈশ্বিক টেলিভিশনের কল্যাণে ফুটবল খেলা হয়ে উঠেছে আধুনিক ধর্ম। ফিফার প্রেসিডেন্ট হলেন তার পোপ। পেলে ও ম্যারাডোনারা হলেন আর দেবতা। রুদ খুলিত, জিদান, রোনালদো, মেসি, কাকা, দ্রগবারা হলেন দেবতাদের অবতার। স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠ হলো দেবতা আর অবতারদের লীলাতীর্থ। কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাস, ম্যারাডোনার দক্ষতা অতি মানবিক। এই বীরপূজায় আমির-ফকির, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ—সবারই অধিকার। ভ্যাটিকানে সোনার যিশু আর আমাদের মধুপুরের আদিবাসীদের কাঠের যিশু যেমন একই ভক্তি পান, তেমনি শত-কোটি ডলারে তৈরি স্টেডিয়াম কিংবা ধান-কাটা মাঠের এবড়োখেবড়ো জমি—সবখানেই ফুটবল স্বমহিমায় বিরাজমান। ফুটবল সর্বজনীন, সর্বগম্য ও অপ্রতিরোধ্য এবং ফুটবল বিপ্লবী।
আদিতে ফুটবল অভিজাত ও ঔপনিবেশিক শাসকদের খেলা হলেও তাদের হাত থেকে এটি চলে আসে সাধারণ মানুষের পায়ে পায়ে। সেজন্যই ব্রিটিশ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৯০২ সালে বলেছিলেন, ফুটবল হলো গেঁয়ো ভূতদের কাদামাখানো খেলা। কারণ, তত দিনে ফুটবলে তাঁদের দাপট শেষ। প্রথম ফুটবল ক্লাব গঠন করেছিলেন রেলশ্রমিক ও জাহাজঘাটার কুলিরা। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপজয়ী প্যারাগুয়েতেও একসময় খেলাটি অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল। ১৯১৫ সালে তাদের প্রকাশিত স্পোর্টস পত্রিকা লেখে, ‘আমরা যারা সমাজে উঁচু আসনের মানুষ, তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে খেলতে বাধ্য করা যাবে না...আজকাল খেলাধুলা যন্ত্রণা আর ত্যাগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ফুটবল সাধারণ মানুষের পায়ে আসার পর শুরু হয় পাল্টা খেলা। এরই চমৎকার উদাহরণ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। মাঠে ব্রিটেনকে হারিয়ে ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের শোধ নেয় আর্জেন্টিনা। ২০০৪ সালে ইতিহাসে প্রথম কোনো আরব দল ইসরায়েলের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০০ সালে বিদ্রোহী চেচনিয়া রাশিয়াকে হারায়। ২০০৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক অলিম্পিকের সেমিফাইনালে উঠে জানান দেয়, তারা হারিয়ে যায়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ সালের ক্রিসমাসের দিনে অবিষ্মরণীয় এক খেলা খেলেছিল জার্মানি আর ইংল্যান্ড। দুই পারে দুই পক্ষের সৈন্যরা। মাঝখানে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’। হঠাৎ কোত্থেকে সেখানে একটি ফুটবল এসে পড়ে। নিমেষেই যুদ্ধের ময়দান হয়ে যায় খেলার ময়দান। অস্ত্র ফেলে সৈন্যরা মাতে খেলায়। দু’পক্ষের অফিসারদের সেদিন অনেক কষ্টে সৈন্যদের বোঝাতে হয়েছিল, তোমরা বন্ধুর মতো খেলতে পারো না, তোমাদের উচিত পরস্পরকে ঘৃণা করা।
ফুটবলেরও শ্রেণীচরিত্র আছে। যেকোনো হালকা গোলাকার বস্তুকেই গরিবরা ফুটবল বানিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপে চলে বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাডিডাসের দামি বল। ইতালিতে ১২টি বৃহৎ শিল্প খাতের মধ্যে ফুটবল একটি। একমাত্র স্পেনের ভুবনবিখ্যাত বার্সেলোনা ছাড়া আর সব নামীদামি ক্লাবের মালিকানা ধনকুবেরদের হাতে। খেলোয়াড়দের তাঁরা কেনাবেচা করেন। পেশাদারির নামে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বানানো হয় সেসব ক্লাবের ‘কর্মচারী’। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফ জবাব, ‘ফিফা খেলোয়াড়দের সঙ্গে কারবার করে না, খেলোয়াড়েরা হলো ক্লাবের কর্মচারী।’ এভাবে বিপুল টাকার বিনিময়ে ‘জনগণের দেবতা’ বিক্রি হয়ে যান। পায়ের দামে তাঁরা আত্মা বিক্রি করে দেন এবং হারান স্বাধীনতা। পেশাদার ব্যবসায়ী বললে যেমন মুনাফার জন্য মরিয়াপনাকে বুঝি, পেশাদার সৈনিক বলতে যেমন নির্বিকার হত্যার পারদর্শিতা বোঝায়, তেমনি পেশাদার ফুটবলার কি কোনা হূদয়হীন গোলমেশিন? খেলোয়াড়ের নিজস্ব শৈলী কিছু নয়, যান্ত্রিক কৌশলই বড়?
বিশ্বকাপ একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, একই সঙ্গে আনন্দ আর বাণিজ্যের মেলা। বিশ্বকাপের মাঠে একই সঙ্গে চলে এই আনন্দ আর টানাপোড়েন। যাঁরা গত চার বছর ছিলেন আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ বা এসি মিলানের ‘পেইড কর্মচারী’, বিশ্বকাপে তাঁরাই হাজির হন জাতীয় জার্সি গায়ে জাতীয় পরিচয়ে—দেশপ্রেমের জয়গান গেয়ে। খেলোয়াড়েরা যখন এ রকম জাতীয় হয়ে ওঠেন, তখন আমাদের মতো ‘বিজাতীয়’ ভক্তরা হঠাৎ অতি আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠি। বাংলাদেশের অগণিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-সমর্থক যে পতাকা ওড়ায়, তা কোনো দেশের রাজনৈতিক পতাকা নয়, তা ভালোবাসার পতাকা। দেশ দুটিকে তারা তখন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উঠিয়ে মনের জমিনে বসায়। এই উদ্যম, এই সংগ্রাম, এই ভক্তি আর ভালোবাসার তলে-তলে চলে খেলোয়াড়দের বাজার যাচাই, চলে বিজ্ঞাপন কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল, স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি, পর্যটনসহ বহুপক্ষীয় রমরমা বাণিজ্য। বিশ্বকাপ শেষ হলে সফল খেলোয়াড়েরা আবার জাতীয় জার্সি খুলে ক্লাবের জার্সি পরবেন, আবার জনশক্তির মতো রপ্তানি হয়ে পদশক্তি বিক্রিতে নামবেন। দেবতারা তখন আবার মানুষ হবেন।
পেলের সময় এই পেশাদারি ছিল না। তখন খেলা হতো খেলার আনন্দে। আজ ফুটবল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মামলা। এই তথাকথিত পেশাদারিই আজ খেলোয়াড়দের স্বাধীনতাকে, খেলার স্টাইলকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপরও কোনো খেলোয়াড় যখন অবিস্মরণীয় কৌশলে গোল দেন, তখন অগণিত দর্শকের চিৎকার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিভার আসল পৃষ্ঠপোষক ক্লাব মালিক, স্পোর্ট ইন্ডাস্ট্রি, টিভি চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতা ও নির্মাতারা কিংবা ফিফাও নয়; বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীই এর প্রাণ। এই কয়েক শ কোটি জনসাধারণের উচ্ছ্বাসই খেলা চলার ৯০ মিনিটকে করে তোলে বিশ্বজনীন। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-জাতিনির্বিশেষে মানুষ যখন আফ্রিকান বীণা ভুভুজেলার মতো এক তালে বেজে ওঠে, তখনই জন্ম হয় এক বৈশ্বিক মুহূর্তের। এত কিছু সত্ত্বেও ফুটবল এখনো পুরুষদেরই খেলা। কার্যত বহু দেশে নারীরা ফুটবল খেলতে পারে না।
এই বীণার আবহেই মানবীয় খেলোয়াড়েরা ‘দেবতা’র মতো লোকাতীত দক্ষতা দেখাবেন। কিন্তু একজন এসেছেন যিনি আর কখনো খেলবেন না, কিন্তু এবার তাঁকে জিততেই হবে। অনেক ভক্ত তাঁকে দেবতার মতো ভালোবাসে। এবং দেবতাদের মতো তাঁরও পতন হয়েছিল। নেশা ও বিশৃঙ্খল জীবন তাঁকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর প্রেরণায় সেই মানুষটিই আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে মানুষের বেশে তিনি এসেছেন দেবতা হিসেবে পুনরুত্থানের লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর দেশও জাতীয় দলের কোচ করে সেই সুযোগ তাঁকে দিয়েছে। তাঁর নাম ডিয়েগো, মানে গড—বিশ্ব যাঁকে জানে ম্যারাডোনা বলে। আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে তাঁকে উৎসর্গ করা একটি গির্জা আছে। গির্জাটির নাম ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’—ভক্তরাও তাঁকে ‘ঈশ্বরের হাত’ বলেই ডাকে।
জীবনের খেলা আসলে ফুটবলের মতোই, কেবল মাঠটা এখানে অনেক বড় এবং গোলপোস্টটা অদৃশ্য।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
জীবনে অনেকের অবদানই গোলকিপারের মতো স্কোরহীন। আপনার দুঃসাধ্য গোল ঠেকানো সবাই ভুলে যাবে, গোলদাতাই হবেন হিরো। রেফারিও স্বৈরাচারীর মতো অন্যের দোষে আপনাকেই ‘ফ্রি কিক’-এর সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে কিংবা দেবে পেনাল্টি। অথচ সাফল্য-ব্যর্থতা একা কারও নয়। কিন্তু টিভিতে দেখায়, দলের চেয়ে ব্যক্তি খেলোয়াড়ই বড়, সব কৃতিত্ব স্ট্রাইকারের। ক্লোজ-আপে, স্লো-মোশনে বারবার দেখিয়ে দর্শকের মনে তাঁর দেবোপম ছবি গেঁথে দেওয়া হয়। আর গোল যেন দীর্ঘ প্রেমের শেষে চরম পুলক, আধুনিক জীবনের মতো আধুনিক ফুটবলেও যা বিরল।
ফুটবল জীবনের মতোই ঘটন-অঘটনে ভরা। কখন কোথায় কোন তালপাতার সৈনিক বীর হয়ে উঠবে আর কোন বীরের পতন ঘটবে, কখন কোন পরাশক্তি গৌণ দলের কাছে হেরে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ফুটবলের বড় আকর্ষণ এই নাটকীয় অনিশ্চয়তা—যা কখনো কখনো ট্র্যাজেডি হয়ে যায়। এ জন্যই ক্রিকেটের বিশ্লেষণ ও কৌশল ঠিক করায় কম্পিউটার যতই জারিজুরি করুক, ফুটবল এখনো কম্পুযন্ত্রের আসরমুক্ত। ফুটবল এখনো মানবিক। এখনো পথের ছেলে পেলে বা ম্যারাডোনা বা রোনালদোর পক্ষে জনগণের রাজপুত্র হওয়া সম্ভব। এক মনোরোগ চিকিৎসকের মতে, বিষণ্ন ও হতাশ মানুষের উপযুক্ত চিকিৎসা হলো ফুটবল খেলা। দলবদ্ধ খেলা দেয় প্রাণশক্তি, দেয় আত্মবিশ্বাস। শেখায় নিজেকে ভালোবাসতে। যে মানুষটি এমনিতে আনস্মার্ট ও লাজুক, ফুটবলের আলোচনায় তিনিও মুখর। এই খেলা বৃদ্ধের মনে আনে কিশোরের উচ্ছ্বাস আর কিশোরকে করে ইঁচড়ে পাকা ক্রীড়া বিশ্লেষক। এমন জাদুকরী প্রভাবের জন্যই বলা হয়, ফুটবল হলো জনগণের জন্য আফিম। দরিদ্রদের জন্য প্রতিদিনকার একঘেঁয়েমি আর জীবনযন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকার মহৌষধ হলো এই খেলা।
বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্যও কিন্তু ফুটবল। ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ফুটবল-ভক্তি বিষয়ে উভয়ের একমত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বৈশ্বিক টেলিভিশনের কল্যাণে ফুটবল খেলা হয়ে উঠেছে আধুনিক ধর্ম। ফিফার প্রেসিডেন্ট হলেন তার পোপ। পেলে ও ম্যারাডোনারা হলেন আর দেবতা। রুদ খুলিত, জিদান, রোনালদো, মেসি, কাকা, দ্রগবারা হলেন দেবতাদের অবতার। স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠ হলো দেবতা আর অবতারদের লীলাতীর্থ। কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাস, ম্যারাডোনার দক্ষতা অতি মানবিক। এই বীরপূজায় আমির-ফকির, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ—সবারই অধিকার। ভ্যাটিকানে সোনার যিশু আর আমাদের মধুপুরের আদিবাসীদের কাঠের যিশু যেমন একই ভক্তি পান, তেমনি শত-কোটি ডলারে তৈরি স্টেডিয়াম কিংবা ধান-কাটা মাঠের এবড়োখেবড়ো জমি—সবখানেই ফুটবল স্বমহিমায় বিরাজমান। ফুটবল সর্বজনীন, সর্বগম্য ও অপ্রতিরোধ্য এবং ফুটবল বিপ্লবী।
আদিতে ফুটবল অভিজাত ও ঔপনিবেশিক শাসকদের খেলা হলেও তাদের হাত থেকে এটি চলে আসে সাধারণ মানুষের পায়ে পায়ে। সেজন্যই ব্রিটিশ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৯০২ সালে বলেছিলেন, ফুটবল হলো গেঁয়ো ভূতদের কাদামাখানো খেলা। কারণ, তত দিনে ফুটবলে তাঁদের দাপট শেষ। প্রথম ফুটবল ক্লাব গঠন করেছিলেন রেলশ্রমিক ও জাহাজঘাটার কুলিরা। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপজয়ী প্যারাগুয়েতেও একসময় খেলাটি অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল। ১৯১৫ সালে তাদের প্রকাশিত স্পোর্টস পত্রিকা লেখে, ‘আমরা যারা সমাজে উঁচু আসনের মানুষ, তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে খেলতে বাধ্য করা যাবে না...আজকাল খেলাধুলা যন্ত্রণা আর ত্যাগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ফুটবল সাধারণ মানুষের পায়ে আসার পর শুরু হয় পাল্টা খেলা। এরই চমৎকার উদাহরণ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। মাঠে ব্রিটেনকে হারিয়ে ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের শোধ নেয় আর্জেন্টিনা। ২০০৪ সালে ইতিহাসে প্রথম কোনো আরব দল ইসরায়েলের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০০ সালে বিদ্রোহী চেচনিয়া রাশিয়াকে হারায়। ২০০৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক অলিম্পিকের সেমিফাইনালে উঠে জানান দেয়, তারা হারিয়ে যায়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ সালের ক্রিসমাসের দিনে অবিষ্মরণীয় এক খেলা খেলেছিল জার্মানি আর ইংল্যান্ড। দুই পারে দুই পক্ষের সৈন্যরা। মাঝখানে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’। হঠাৎ কোত্থেকে সেখানে একটি ফুটবল এসে পড়ে। নিমেষেই যুদ্ধের ময়দান হয়ে যায় খেলার ময়দান। অস্ত্র ফেলে সৈন্যরা মাতে খেলায়। দু’পক্ষের অফিসারদের সেদিন অনেক কষ্টে সৈন্যদের বোঝাতে হয়েছিল, তোমরা বন্ধুর মতো খেলতে পারো না, তোমাদের উচিত পরস্পরকে ঘৃণা করা।
ফুটবলেরও শ্রেণীচরিত্র আছে। যেকোনো হালকা গোলাকার বস্তুকেই গরিবরা ফুটবল বানিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপে চলে বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাডিডাসের দামি বল। ইতালিতে ১২টি বৃহৎ শিল্প খাতের মধ্যে ফুটবল একটি। একমাত্র স্পেনের ভুবনবিখ্যাত বার্সেলোনা ছাড়া আর সব নামীদামি ক্লাবের মালিকানা ধনকুবেরদের হাতে। খেলোয়াড়দের তাঁরা কেনাবেচা করেন। পেশাদারির নামে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বানানো হয় সেসব ক্লাবের ‘কর্মচারী’। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফ জবাব, ‘ফিফা খেলোয়াড়দের সঙ্গে কারবার করে না, খেলোয়াড়েরা হলো ক্লাবের কর্মচারী।’ এভাবে বিপুল টাকার বিনিময়ে ‘জনগণের দেবতা’ বিক্রি হয়ে যান। পায়ের দামে তাঁরা আত্মা বিক্রি করে দেন এবং হারান স্বাধীনতা। পেশাদার ব্যবসায়ী বললে যেমন মুনাফার জন্য মরিয়াপনাকে বুঝি, পেশাদার সৈনিক বলতে যেমন নির্বিকার হত্যার পারদর্শিতা বোঝায়, তেমনি পেশাদার ফুটবলার কি কোনা হূদয়হীন গোলমেশিন? খেলোয়াড়ের নিজস্ব শৈলী কিছু নয়, যান্ত্রিক কৌশলই বড়?
বিশ্বকাপ একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, একই সঙ্গে আনন্দ আর বাণিজ্যের মেলা। বিশ্বকাপের মাঠে একই সঙ্গে চলে এই আনন্দ আর টানাপোড়েন। যাঁরা গত চার বছর ছিলেন আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ বা এসি মিলানের ‘পেইড কর্মচারী’, বিশ্বকাপে তাঁরাই হাজির হন জাতীয় জার্সি গায়ে জাতীয় পরিচয়ে—দেশপ্রেমের জয়গান গেয়ে। খেলোয়াড়েরা যখন এ রকম জাতীয় হয়ে ওঠেন, তখন আমাদের মতো ‘বিজাতীয়’ ভক্তরা হঠাৎ অতি আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠি। বাংলাদেশের অগণিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-সমর্থক যে পতাকা ওড়ায়, তা কোনো দেশের রাজনৈতিক পতাকা নয়, তা ভালোবাসার পতাকা। দেশ দুটিকে তারা তখন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উঠিয়ে মনের জমিনে বসায়। এই উদ্যম, এই সংগ্রাম, এই ভক্তি আর ভালোবাসার তলে-তলে চলে খেলোয়াড়দের বাজার যাচাই, চলে বিজ্ঞাপন কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল, স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি, পর্যটনসহ বহুপক্ষীয় রমরমা বাণিজ্য। বিশ্বকাপ শেষ হলে সফল খেলোয়াড়েরা আবার জাতীয় জার্সি খুলে ক্লাবের জার্সি পরবেন, আবার জনশক্তির মতো রপ্তানি হয়ে পদশক্তি বিক্রিতে নামবেন। দেবতারা তখন আবার মানুষ হবেন।
পেলের সময় এই পেশাদারি ছিল না। তখন খেলা হতো খেলার আনন্দে। আজ ফুটবল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মামলা। এই তথাকথিত পেশাদারিই আজ খেলোয়াড়দের স্বাধীনতাকে, খেলার স্টাইলকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপরও কোনো খেলোয়াড় যখন অবিস্মরণীয় কৌশলে গোল দেন, তখন অগণিত দর্শকের চিৎকার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিভার আসল পৃষ্ঠপোষক ক্লাব মালিক, স্পোর্ট ইন্ডাস্ট্রি, টিভি চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতা ও নির্মাতারা কিংবা ফিফাও নয়; বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীই এর প্রাণ। এই কয়েক শ কোটি জনসাধারণের উচ্ছ্বাসই খেলা চলার ৯০ মিনিটকে করে তোলে বিশ্বজনীন। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-জাতিনির্বিশেষে মানুষ যখন আফ্রিকান বীণা ভুভুজেলার মতো এক তালে বেজে ওঠে, তখনই জন্ম হয় এক বৈশ্বিক মুহূর্তের। এত কিছু সত্ত্বেও ফুটবল এখনো পুরুষদেরই খেলা। কার্যত বহু দেশে নারীরা ফুটবল খেলতে পারে না।
এই বীণার আবহেই মানবীয় খেলোয়াড়েরা ‘দেবতা’র মতো লোকাতীত দক্ষতা দেখাবেন। কিন্তু একজন এসেছেন যিনি আর কখনো খেলবেন না, কিন্তু এবার তাঁকে জিততেই হবে। অনেক ভক্ত তাঁকে দেবতার মতো ভালোবাসে। এবং দেবতাদের মতো তাঁরও পতন হয়েছিল। নেশা ও বিশৃঙ্খল জীবন তাঁকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রোর প্রেরণায় সেই মানুষটিই আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে মানুষের বেশে তিনি এসেছেন দেবতা হিসেবে পুনরুত্থানের লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর দেশও জাতীয় দলের কোচ করে সেই সুযোগ তাঁকে দিয়েছে। তাঁর নাম ডিয়েগো, মানে গড—বিশ্ব যাঁকে জানে ম্যারাডোনা বলে। আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে তাঁকে উৎসর্গ করা একটি গির্জা আছে। গির্জাটির নাম ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’—ভক্তরাও তাঁকে ‘ঈশ্বরের হাত’ বলেই ডাকে।
জীবনের খেলা আসলে ফুটবলের মতোই, কেবল মাঠটা এখানে অনেক বড় এবং গোলপোস্টটা অদৃশ্য।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments