সময়ের প্রতিবিম্ব-হরতাল হয়েছে বা হয়নি, তাতে হয়েছেটা কী by এবিএম মূসা
ক্ষমতা হারানো দল হরতাল ডাকবে, ক্ষমতাসীন দল বিরোধিতা করবে। সরকারনিয়ন্ত্রিত সংস্থা ও অনুগত অঙ্গসংগঠনগুলো বলবে, প্রতিহত করা হবে। বিরোধী দল বলবে, প্রতিহত করলে বাধবে লড়াই। তার পরও হরতাল হয় অথবা হয়ে যায়, জনগণ করে অথবা করানো হয়।
কোনো সংবাদপত্রের পাতায় শিরোনাম থাকে সর্বাত্মক হরতাল হয়েছে। কেউবা লেখেন, আংশিক হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালের দুই দিন আগে একটুখানি খবর, পরদিন থাকে ছবিসহ সফলতা-বিফলতার পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন, সরকারি ও বিরোধী দলের ভাষ্য এবং সফল বা প্রতিহত করার সচিত্র বিবরণী। উভয় পদ্ধতি মাত্রাতিরিক্ত হলে খবরের মধ্যে উত্তেজনাও থাকে বৈকি।
এত সব সত্ত্বেও একটি ব্যাপারে মিল থাকে, সরকার ও বিরোধী দল জনগণকে অভিনন্দন জানায়। সরকারি দল হরতাল উপেক্ষা করায় সন্তোষ প্রকাশ করে। বিরোধী দল জনগণের ‘অভূতপূর্ব সাড়া’ পেয়ে অভিনন্দন জানায়। তবে জনগণ কোনো পক্ষের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয় না। যা দেখার, বোঝার ও করার, তা প্রত্যক্ষ করে। এমন হরতাল-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের অনেক বছরের পরিচিতি। রোববারের হরতাল সেই পরিচিতির গণ্ডির বাইরে ছিল না।
এসব দেখেশুনে সাংবাদিক নির্মল সেন একসময়ে একটি শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘হরতাল হয়েছে, হরতাল হয়নি’। রোববারের বিরোধী দলের হরতালের সংবাদ পরিবেশনে সংবাদপত্রে এমন বৈচিত্র্যের শিরোনামই আমার মতে যথার্থ হতো। তাই আমি হরতাল হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি শুধু অবাক হয়ে আগে-পিছে ভেবেছি, ভাবছি, আগে তো কখনো দেখিনি, পড়িনি বা শুনিনি, হরতাল নিয়ে এক মাস আগে থেকে এত তোলপাড়। ‘হবেই আর হতে দেব না’—এমন ঘোষণা-পাল্টা ঘোষণা আগেও শুনেছি। তবে মাসব্যাপী এত আলোচনা, বক্তব্য-বিবৃতি, হুঁশিয়ারি আর হুংকার কখনো এভাবে মাঠ গরম করেনি। অবাক করা ব্যাপার হলো, হরতাল নিয়ে এখন গবেষণা ও ইতিহাসচর্চা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা হচ্ছে হরতালের আদি পর্ব থেকে বর্তমানে রূপান্তরের কাহিনি। শেষ কবে হরতাল হয়েছিল, গত সাড়ে তিন বছর কেন হয়নি—এ নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন ও অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। হিসাব-নিকাশ হয়েছে অর্থনীতির ওপর এক দিনের হরতালের প্রভাবের ওপর। মন্তব্য প্রতিবেদনে হরতালবিরোধীরা লিখছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। অবশ্য গত দু-চার বছরে যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তার তুলনায় এখন বৃদ্ধির মাত্রা কতখানি কত হবে অথবা গত সাড়ে তিন বছর কোনো হরতাল হয়নি, তবু কেন চাল-ডাল-নুন-তেলের দাম বাড়ল, সে সম্পর্কে এসব গবেষণা, পরিসংখ্যান ও উপাত্তে কিছু বলা হয়নি। আবার বর্তমানে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেড় দিন বন্ধ, সাতটা না বাজতেই আলো নেভানোর বিষয়টিও হরতালের কারণে ব্যবসায়ের লাভক্ষতি হিসাবে স্থান পায়নি।
মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে হরতালের সূচনাটি ছিল শাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ। তারপর ক্রমবিকাশের ধারায় ধর্মঘট, কর্মবিরতি, চাকা বন্ধ আর দোকানপাটে তালা লাগানো। অপরদিকে হরতাল ‘প্রতিরোধে’ রাজপথে আধাসামরিক বাহিনী আর পুলিশের লাঠি পেটানো, বাসে আগুন, এমনকি নারীর বস্ত্র হরণ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবার দেখলাম হরতাল প্রতিরোধ এক ধাপ এগিয়েছে। হরতাল ‘কর্মসূচি’ রাজপথে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রতিরোধকারীরা বাড়ির ভেতর পর্যন্ত ‘প্রতিরোধ’ কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। আমার সক্রিয় সাংবাদিকতাকালে এত সব খবর জোগাড় করতাম না। আমাদের বিষয়বস্তু ছিল—(১) হরতাল হয়েছে, জনগণ করেছে অথবা করানো হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে অথবা ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের মনে ভয়ভীতির সঞ্চার করে হরতাল ‘সফল’ করা হয়েছে। পিকেটারেরা বাধা দিয়েছে, পুলিশ তাদের পিটিয়েছে। হরতাল যখন বিক্ষোভে গণ-আন্দোলন ও সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে, তখন টিয়ারগ্যাস-গুলি চলেছে। অতঃপর শাসনব্যবস্থার বদল, ক্ষমতাধরদের পতন, রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতনের সব ঐতিহাসিক ঘটনা।
সেসব অভূতপূর্ব, পরবর্তী সময়ে গা-সহা সব হরতাল, আটষট্টি-ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে অথবা একাত্তরের মার্চে জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ‘হরতাল’ ছিল ভিন্ন ধরনের খবর। তবে একটি বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিতাম, তা হলো জনগণের যেকোনো অহিংসা বা হিংস্র পদ্ধতিতে অসন্তোষ প্রকাশের কারণ ছিল কি না। যাঁরা সম্প্রতি হরতাল নিয়ে তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরা এই মূল বিষয়টি পুরোপুরিভাবে আলোচনায় আনেননি। ‘হরতাল’ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যেসব বক্তব্য সুধীজন দিয়েছেন অথবা উত্তপ্ত বাক্য-বিবৃতি বিনিময় করেছেন, তাঁরা বলেননি শাসকের গণবিরোধী শাসনের প্রতিবাদে আন্দোলনের সূচনা হয় হরতালের মাধ্যমে। জনগণের প্রতিবাদের প্রাথমিক পর্যায় হলো সর্বাত্মক ধর্মঘট ও অসহযোগিতা। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর যে একটি সফল-বিফল হরতাল হয়ে গেল, তা হয়তো নিছক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। আবার এও ভাবতে হবে সর্বাত্মক বা যতটুকু হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের কতিপয় ব্যর্থতা অথবা অকর্মণ্যতা নিয়ে অসন্তোষের প্রকাশ কি না। তাই যদি হয়, প্রকাশটি শুরুতেই ‘হরতাল’ না হয়ে ধাপে ধাপে হতে পারত। অথবা সন্ত্রাস, দখলদারি, চাঁদাবাজি, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই যদি হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা হলে বিরোধী দলের হরতালের সফলতা-বিফলতা নয়, কর্মসূচি প্রদানের যথার্থতাকেও প্রাধান্য দিতে হবে। যাঁরা এবারের হরতাল নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা এ প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন অথবা পুরোপুরি আলোচনা করেননি।
হরতালবিরোধীদের কেউ কেউ আগেও বলেছেন, এবারও বলছেন, ‘বিকল্প’ খুঁজে বের করুন। সেই বিকল্প কী, তা কেউ বলছেন না, ব্যাখ্যাও করেননি। কেউ কেউ অবশ্য মানববন্ধন, গণ-অনশন, পদযাত্রা বিকল্প বলতে পারেন, কিন্তু সেসব প্রতীকী প্রতিবাদে কি কারও টনক নড়ে? তবে এবার পরোক্ষে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে, তাদের নিজেদের অথবা দলীয় নেতা-কর্মীদের দেড় বছরের অপারগতা অথবা ব্যর্থতা কিংবা জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যর্থতার প্রতিবাদ করার কারণ রয়েছে। তবে এও বলেছে, ‘হরতাল’ করে নয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে করতে হবে। তাদের সঠিক যুক্তি হচ্ছে, স্বৈরতান্ত্রিক, সামরিক অথবা গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরাচারী শাসনামলের যেভাবে প্রতিবাদ জানানো হতো, একটি নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশের ধারার আরম্ভটি ভিন্নতর হতে হবে। অর্থাৎ হঠাৎ হরতাল, আন্দোলন, অভ্যুত্থান, সহিংস বিক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে নয়। জনগণের প্রতিনিধিদের গণবিরোধী শাসনের প্রতিবাদ জানানোর সূচনা হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। বর্তমান সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দলীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটি জানাতে বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করেনি। যদি সেই পদ্ধতিটি ব্যর্থ হতো, তবেই বলতে পারত, হরতাল-আন্দোলন-গণবিস্ফোরণের কোনো বিকল্প ছিল না। হরতালপন্থীরা সেই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেনি বলেই রোববার জনগণ সত্যিই তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হরতাল পালন করেছে বা করানো হয়েছে—এই বিতর্কের উদ্ভব হতো না।
অপরদিকে সরকারকেও বিরোধী দলের একটি নিছক কর্মসূচির বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি না করে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হতো, তাদের আড়াই বছরের শাসনামলে জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েছে। তারা পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছে, জনগণের হয়ে, তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে বিরোধী দলের বলার রয়েছে অনেক কিছু। দেড় বছরের শাসনামলে যদি গণ-অসন্তোষের মাত্রা বেড়ে থাকে তা ‘সংসদে এসে বলুন’ কথাটার গূঢ়ার্থ হচ্ছে, আপনাদের জনগণের হয়ে বলার আছে অনেক কিছু। সংসদীয় সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বলে প্রতিকার বা প্রতিবিধান না পেলেই হরতাল করার প্রয়োজনীয়তা জনগণকে সহজেই জানাতে পারত। তখন প্রতিবাদটি অহিংস হরতাল না সহিংস গণ-অভ্যুত্থান হবে, তা জনগণই নির্ধারণ করবে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে তা-ই হয়েছে। কথা বলার জন্য স্থান খুঁজে না পেয়েই অবশেষে জনগণ সংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে রাস্তায় নেমেছিল। বিরোধী দল শেষটি দিয়ে শুরু করল কেন, এ প্রশ্ন অনেকের।
তবে স্বীকার করতে হবে রোববারের হরতাল মোটামুটি ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ জনগণ করেছে বা তাদের করানো হয়েছে। ঘটনা-অঘটন ব্যতিরেকেই পালিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। উভয় সংজ্ঞা ধর্তব্যে এনে বলব, ‘ব্যতিক্রমী’ হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার ধৈর্য ও সহনশীলতার সম্যক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তবে তাদের সহনশীলতা, ধৈর্য ও প্রজ্ঞা সামগ্রিক হতো, অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ হতো না, যদি বিরোধী দলের নেতা মির্জা আব্বাসের বাড়ির অন্দরে ঢুকে তাদের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অহেতুক তাণ্ডব না করত। নেতা-কর্মীদের ওপর রাজপথে স্বল্প মাত্রার ‘অ্যাকশনের’ প্রয়োজন ছিল না। প্রায় জনশূন্য রাস্তায় বিরোধীদলীয় কর্মীদের একটু-আধটু লাফালাফি মিছিল করে কিছুক্ষণ হইচই করতে দিলেই কী এসে-যেত? সরকার র্যাব-পুলিশ মোতায়েন না করলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটত বলে মনে হয় না। সর্বশেষটি হচ্ছে একটি ছাত্রবাহিনীর হরতাল প্রতিরোধের উদ্যোগ, একটি হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া হরতাল-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা নিরুত্তাপ হরতালের দিনে জনমনে একটুখানি উত্তাপ সৃষ্টি করেছিল। এ ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ‘দায়ভার’ অস্বীকার করলেও তাঁর দল বা সরকার পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে পারে না। তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ, পুলিশের মহাপরিচালকের অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি হরতালের দিনের সরকারি বাড়াবাড়ি নিয়ে জনগণের অসন্তুষ্টি অনেকখানি লাঘব করেছে। ব্যতিক্রমধর্মী বলে প্রশংসিতও হয়েছে। তার পরেও টেলিভিশনে জনগণ একটি বাড়িতে এলিট বাহিনীর অহেতুক ভাঙচুর আর বাড়াবাড়ির যে দৃশ্য দেখেছে, তা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
যা-ই হোক, রোববারের সফল-বিফল হরতাল সরকারকে একটুখানি হলেও ধাক্কা দিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই পূর্বাভাস পেয়েছে, ভবিষ্যতে হরতাল একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট ও নিষ্ফল না-ও হতে পারে। আমার এই আশঙ্কা দূর হবে যদি সিন্ডিকেট ‘আমাদের আর্থিক ক্ষতি হবে’ বলে আর্তি না করে, হরতালের কারণ তৈরির সুযোগ করে না দেয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়াকে থামাতে পারে। তেমনি ক্ষমতাসীন সরকারকেও নিশ্চয়তা দিতে হবে, ‘আটকাবস্থায় নির্যাতনে মৃত্যু হবে না, নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও দখলদারি করবে না। ভবিষ্যতে এসব আর করব না।’ বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সমস্যা মেটানোর প্রচেষ্টা যেভাবে শম্বুকগতিতে চলছে, তার চেয়ে আরও বেগবান হবে। ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারক ও উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব যিনি পরিচালনা করেন তাঁকে অনুরোধ করব, রোববারের ‘সফল-বিফল হরতাল’কে যথাযথ গুরুত্ব দিন। ‘হয়েছে-হয়নি’ নয়, নিকট ভবিষ্যতে ‘হলে’ কী রূপে আত্মপ্রকাশ করবে, তা নিজেদের অতীতের কর্মপন্থার ও অভিজ্ঞতার আলোকে, ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন আর ভাবুন। তাহলে বুঝবেন, প্রথম হরতাল-তথা একটি নিস্তেজ প্রতিবাদ প্রকাশে জনগণ সাড়া দিয়েছে কি দেয়নি, তা ভেবে আত্মপ্রসাদের কারণ ঘটেনি। বিরোধী দলের নিস্তেজ হরতাল শেষাস্ত্র যেন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সূচনা না হয়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এত সব সত্ত্বেও একটি ব্যাপারে মিল থাকে, সরকার ও বিরোধী দল জনগণকে অভিনন্দন জানায়। সরকারি দল হরতাল উপেক্ষা করায় সন্তোষ প্রকাশ করে। বিরোধী দল জনগণের ‘অভূতপূর্ব সাড়া’ পেয়ে অভিনন্দন জানায়। তবে জনগণ কোনো পক্ষের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয় না। যা দেখার, বোঝার ও করার, তা প্রত্যক্ষ করে। এমন হরতাল-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের অনেক বছরের পরিচিতি। রোববারের হরতাল সেই পরিচিতির গণ্ডির বাইরে ছিল না।
এসব দেখেশুনে সাংবাদিক নির্মল সেন একসময়ে একটি শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘হরতাল হয়েছে, হরতাল হয়নি’। রোববারের বিরোধী দলের হরতালের সংবাদ পরিবেশনে সংবাদপত্রে এমন বৈচিত্র্যের শিরোনামই আমার মতে যথার্থ হতো। তাই আমি হরতাল হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি শুধু অবাক হয়ে আগে-পিছে ভেবেছি, ভাবছি, আগে তো কখনো দেখিনি, পড়িনি বা শুনিনি, হরতাল নিয়ে এক মাস আগে থেকে এত তোলপাড়। ‘হবেই আর হতে দেব না’—এমন ঘোষণা-পাল্টা ঘোষণা আগেও শুনেছি। তবে মাসব্যাপী এত আলোচনা, বক্তব্য-বিবৃতি, হুঁশিয়ারি আর হুংকার কখনো এভাবে মাঠ গরম করেনি। অবাক করা ব্যাপার হলো, হরতাল নিয়ে এখন গবেষণা ও ইতিহাসচর্চা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা হচ্ছে হরতালের আদি পর্ব থেকে বর্তমানে রূপান্তরের কাহিনি। শেষ কবে হরতাল হয়েছিল, গত সাড়ে তিন বছর কেন হয়নি—এ নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন ও অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। হিসাব-নিকাশ হয়েছে অর্থনীতির ওপর এক দিনের হরতালের প্রভাবের ওপর। মন্তব্য প্রতিবেদনে হরতালবিরোধীরা লিখছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে। অবশ্য গত দু-চার বছরে যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তার তুলনায় এখন বৃদ্ধির মাত্রা কতখানি কত হবে অথবা গত সাড়ে তিন বছর কোনো হরতাল হয়নি, তবু কেন চাল-ডাল-নুন-তেলের দাম বাড়ল, সে সম্পর্কে এসব গবেষণা, পরিসংখ্যান ও উপাত্তে কিছু বলা হয়নি। আবার বর্তমানে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেড় দিন বন্ধ, সাতটা না বাজতেই আলো নেভানোর বিষয়টিও হরতালের কারণে ব্যবসায়ের লাভক্ষতি হিসাবে স্থান পায়নি।
মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে হরতালের সূচনাটি ছিল শাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ। তারপর ক্রমবিকাশের ধারায় ধর্মঘট, কর্মবিরতি, চাকা বন্ধ আর দোকানপাটে তালা লাগানো। অপরদিকে হরতাল ‘প্রতিরোধে’ রাজপথে আধাসামরিক বাহিনী আর পুলিশের লাঠি পেটানো, বাসে আগুন, এমনকি নারীর বস্ত্র হরণ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবার দেখলাম হরতাল প্রতিরোধ এক ধাপ এগিয়েছে। হরতাল ‘কর্মসূচি’ রাজপথে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রতিরোধকারীরা বাড়ির ভেতর পর্যন্ত ‘প্রতিরোধ’ কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। আমার সক্রিয় সাংবাদিকতাকালে এত সব খবর জোগাড় করতাম না। আমাদের বিষয়বস্তু ছিল—(১) হরতাল হয়েছে, জনগণ করেছে অথবা করানো হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে অথবা ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের মনে ভয়ভীতির সঞ্চার করে হরতাল ‘সফল’ করা হয়েছে। পিকেটারেরা বাধা দিয়েছে, পুলিশ তাদের পিটিয়েছে। হরতাল যখন বিক্ষোভে গণ-আন্দোলন ও সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে, তখন টিয়ারগ্যাস-গুলি চলেছে। অতঃপর শাসনব্যবস্থার বদল, ক্ষমতাধরদের পতন, রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতনের সব ঐতিহাসিক ঘটনা।
সেসব অভূতপূর্ব, পরবর্তী সময়ে গা-সহা সব হরতাল, আটষট্টি-ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে অথবা একাত্তরের মার্চে জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ‘হরতাল’ ছিল ভিন্ন ধরনের খবর। তবে একটি বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিতাম, তা হলো জনগণের যেকোনো অহিংসা বা হিংস্র পদ্ধতিতে অসন্তোষ প্রকাশের কারণ ছিল কি না। যাঁরা সম্প্রতি হরতাল নিয়ে তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরা এই মূল বিষয়টি পুরোপুরিভাবে আলোচনায় আনেননি। ‘হরতাল’ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যেসব বক্তব্য সুধীজন দিয়েছেন অথবা উত্তপ্ত বাক্য-বিবৃতি বিনিময় করেছেন, তাঁরা বলেননি শাসকের গণবিরোধী শাসনের প্রতিবাদে আন্দোলনের সূচনা হয় হরতালের মাধ্যমে। জনগণের প্রতিবাদের প্রাথমিক পর্যায় হলো সর্বাত্মক ধর্মঘট ও অসহযোগিতা। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর যে একটি সফল-বিফল হরতাল হয়ে গেল, তা হয়তো নিছক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। আবার এও ভাবতে হবে সর্বাত্মক বা যতটুকু হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের কতিপয় ব্যর্থতা অথবা অকর্মণ্যতা নিয়ে অসন্তোষের প্রকাশ কি না। তাই যদি হয়, প্রকাশটি শুরুতেই ‘হরতাল’ না হয়ে ধাপে ধাপে হতে পারত। অথবা সন্ত্রাস, দখলদারি, চাঁদাবাজি, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই যদি হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা হলে বিরোধী দলের হরতালের সফলতা-বিফলতা নয়, কর্মসূচি প্রদানের যথার্থতাকেও প্রাধান্য দিতে হবে। যাঁরা এবারের হরতাল নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা এ প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন অথবা পুরোপুরি আলোচনা করেননি।
হরতালবিরোধীদের কেউ কেউ আগেও বলেছেন, এবারও বলছেন, ‘বিকল্প’ খুঁজে বের করুন। সেই বিকল্প কী, তা কেউ বলছেন না, ব্যাখ্যাও করেননি। কেউ কেউ অবশ্য মানববন্ধন, গণ-অনশন, পদযাত্রা বিকল্প বলতে পারেন, কিন্তু সেসব প্রতীকী প্রতিবাদে কি কারও টনক নড়ে? তবে এবার পরোক্ষে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে, তাদের নিজেদের অথবা দলীয় নেতা-কর্মীদের দেড় বছরের অপারগতা অথবা ব্যর্থতা কিংবা জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যর্থতার প্রতিবাদ করার কারণ রয়েছে। তবে এও বলেছে, ‘হরতাল’ করে নয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে করতে হবে। তাদের সঠিক যুক্তি হচ্ছে, স্বৈরতান্ত্রিক, সামরিক অথবা গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরাচারী শাসনামলের যেভাবে প্রতিবাদ জানানো হতো, একটি নির্বাচিত সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশের ধারার আরম্ভটি ভিন্নতর হতে হবে। অর্থাৎ হঠাৎ হরতাল, আন্দোলন, অভ্যুত্থান, সহিংস বিক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে নয়। জনগণের প্রতিনিধিদের গণবিরোধী শাসনের প্রতিবাদ জানানোর সূচনা হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। বর্তমান সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দলীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটি জানাতে বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করেনি। যদি সেই পদ্ধতিটি ব্যর্থ হতো, তবেই বলতে পারত, হরতাল-আন্দোলন-গণবিস্ফোরণের কোনো বিকল্প ছিল না। হরতালপন্থীরা সেই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেনি বলেই রোববার জনগণ সত্যিই তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হরতাল পালন করেছে বা করানো হয়েছে—এই বিতর্কের উদ্ভব হতো না।
অপরদিকে সরকারকেও বিরোধী দলের একটি নিছক কর্মসূচির বিরুদ্ধে হম্বিতম্বি না করে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হতো, তাদের আড়াই বছরের শাসনামলে জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েছে। তারা পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছে, জনগণের হয়ে, তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে বিরোধী দলের বলার রয়েছে অনেক কিছু। দেড় বছরের শাসনামলে যদি গণ-অসন্তোষের মাত্রা বেড়ে থাকে তা ‘সংসদে এসে বলুন’ কথাটার গূঢ়ার্থ হচ্ছে, আপনাদের জনগণের হয়ে বলার আছে অনেক কিছু। সংসদীয় সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বলে প্রতিকার বা প্রতিবিধান না পেলেই হরতাল করার প্রয়োজনীয়তা জনগণকে সহজেই জানাতে পারত। তখন প্রতিবাদটি অহিংস হরতাল না সহিংস গণ-অভ্যুত্থান হবে, তা জনগণই নির্ধারণ করবে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে তা-ই হয়েছে। কথা বলার জন্য স্থান খুঁজে না পেয়েই অবশেষে জনগণ সংগঠিত বা অসংগঠিতভাবে রাস্তায় নেমেছিল। বিরোধী দল শেষটি দিয়ে শুরু করল কেন, এ প্রশ্ন অনেকের।
তবে স্বীকার করতে হবে রোববারের হরতাল মোটামুটি ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ জনগণ করেছে বা তাদের করানো হয়েছে। ঘটনা-অঘটন ব্যতিরেকেই পালিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। উভয় সংজ্ঞা ধর্তব্যে এনে বলব, ‘ব্যতিক্রমী’ হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার ধৈর্য ও সহনশীলতার সম্যক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তবে তাদের সহনশীলতা, ধৈর্য ও প্রজ্ঞা সামগ্রিক হতো, অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ হতো না, যদি বিরোধী দলের নেতা মির্জা আব্বাসের বাড়ির অন্দরে ঢুকে তাদের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অহেতুক তাণ্ডব না করত। নেতা-কর্মীদের ওপর রাজপথে স্বল্প মাত্রার ‘অ্যাকশনের’ প্রয়োজন ছিল না। প্রায় জনশূন্য রাস্তায় বিরোধীদলীয় কর্মীদের একটু-আধটু লাফালাফি মিছিল করে কিছুক্ষণ হইচই করতে দিলেই কী এসে-যেত? সরকার র্যাব-পুলিশ মোতায়েন না করলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটত বলে মনে হয় না। সর্বশেষটি হচ্ছে একটি ছাত্রবাহিনীর হরতাল প্রতিরোধের উদ্যোগ, একটি হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া হরতাল-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা নিরুত্তাপ হরতালের দিনে জনমনে একটুখানি উত্তাপ সৃষ্টি করেছিল। এ ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ‘দায়ভার’ অস্বীকার করলেও তাঁর দল বা সরকার পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে পারে না। তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ, পুলিশের মহাপরিচালকের অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি হরতালের দিনের সরকারি বাড়াবাড়ি নিয়ে জনগণের অসন্তুষ্টি অনেকখানি লাঘব করেছে। ব্যতিক্রমধর্মী বলে প্রশংসিতও হয়েছে। তার পরেও টেলিভিশনে জনগণ একটি বাড়িতে এলিট বাহিনীর অহেতুক ভাঙচুর আর বাড়াবাড়ির যে দৃশ্য দেখেছে, তা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
যা-ই হোক, রোববারের সফল-বিফল হরতাল সরকারকে একটুখানি হলেও ধাক্কা দিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই পূর্বাভাস পেয়েছে, ভবিষ্যতে হরতাল একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট ও নিষ্ফল না-ও হতে পারে। আমার এই আশঙ্কা দূর হবে যদি সিন্ডিকেট ‘আমাদের আর্থিক ক্ষতি হবে’ বলে আর্তি না করে, হরতালের কারণ তৈরির সুযোগ করে না দেয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়াকে থামাতে পারে। তেমনি ক্ষমতাসীন সরকারকেও নিশ্চয়তা দিতে হবে, ‘আটকাবস্থায় নির্যাতনে মৃত্যু হবে না, নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও দখলদারি করবে না। ভবিষ্যতে এসব আর করব না।’ বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সমস্যা মেটানোর প্রচেষ্টা যেভাবে শম্বুকগতিতে চলছে, তার চেয়ে আরও বেগবান হবে। ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারক ও উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্ব যিনি পরিচালনা করেন তাঁকে অনুরোধ করব, রোববারের ‘সফল-বিফল হরতাল’কে যথাযথ গুরুত্ব দিন। ‘হয়েছে-হয়নি’ নয়, নিকট ভবিষ্যতে ‘হলে’ কী রূপে আত্মপ্রকাশ করবে, তা নিজেদের অতীতের কর্মপন্থার ও অভিজ্ঞতার আলোকে, ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন আর ভাবুন। তাহলে বুঝবেন, প্রথম হরতাল-তথা একটি নিস্তেজ প্রতিবাদ প্রকাশে জনগণ সাড়া দিয়েছে কি দেয়নি, তা ভেবে আত্মপ্রসাদের কারণ ঘটেনি। বিরোধী দলের নিস্তেজ হরতাল শেষাস্ত্র যেন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সূচনা না হয়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments