প্রতিক্রিয়া-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল
সম্প্রতি ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল, ২০০৯’ পরীক্ষাকরণ-সংক্রান্ত সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি বিলের কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য সুপারিশ করে। এগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো, ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল, ২০০৯’-এর স্থলে এ বিলটির নাম হবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল, ২০১০’।
এ বিলটি আইনে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ পাওয়া গেছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল, ২০১০’ প্রণয়নের কথা বিলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিলের নামকরণ নিয়ে আমাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা এই বিলের সঙ্গে যুক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমরা কয়েকজন আমাদের পরামর্শ দিয়ে বিল প্রণয়নে সহায়তা করেছি এবং এ কারণেই সবার কাছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ বিলের নামকরণসহ এর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুতিতে আমরা জড়িত ছিলাম, কিন্তু আমরা স্পষ্টতই খোলাসা করতে চাই, এ বিলটি যে নামে হয়েছে, সেটি আমাদের পরামর্শের প্রতিফলন কোনোভাবেই নয়। আমরা সরকারকে এ বিষয়ে অবশ্য বাহবা দিতে চাই, এ বিলটি নিয়ে সরকার বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে কথা বলেছে (যদিও বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী জনগণের সঙ্গে নয়), যা বিগত সরকারের সঙ্গে এই সরকারের শাসনপ্রক্রিয়ায় একটি ইতিবাচক ফারাক তৈরি করে। দেখা গেছে, বিলটির নামকরণের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো পরামর্শ সরকার গ্রহণ করা হয়নি। তাই আমরা জানাতে চাই, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির একটি সভায় আমরা উপস্থিত ছিলাম। সেই সভায় আমরা বিলটির নাম ‘আদিবাসী প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ হওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলাম। বিলটির নামকরণ বিষয়ে সেদিন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আরেকবার বৈঠক হওয়ার প্রস্তাবসহ সেই সভা সেদিন শেষ হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈঠক আর হয়নি।
বৈঠক না-ও হতে পারে, আমাদের মতামত আর না-ও শোনা যেতে পারে, সেটি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা নয়। চিন্তার জায়গাটি হলো, আমাদের প্রদত্ত মতামতের কোনো ধরনের প্রতিফলনই বিলটির নামকরণে নেই। সরকার হয়তো আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতার বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বিলটি প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে ‘গণতান্ত্রিক’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে মাত্র; কিন্তু দুঃখজনক, এই আলাপচারিতা-উত্তর বিল কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া ফলাফলকে সামনে আনেনি।
বিলটি নিয়ে আরও কয়েকটি জায়গায় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এটিতে আছে বিস্ময়কর অসংগতির নানা নমুনা। বিলটির প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৫০-৬০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে।’ আরও উল্লেখ আছে, ‘পার্বত্য জেলাগুলো এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল ব্যতিরেকে অন্যান্য অঞ্চলে এসব নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বেশি নয়।’ কিন্তু এই বক্তব্যের বিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায়, যখন এ বিলটিতে মাত্র ২৭টি জনগোষ্ঠীর কথা অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় মাত্র ২৭টি জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হলো আর অন্যরা বাদ গেল, সেটির কোনো উৎস বা উত্তর পাওয়া যায় না এ বিলটি থেকে। এ ছাড়া ‘মং’ (তালিকার ২২ নম্বরে স্থান পাওয়া) পরিচয়ের কারও উপস্থিতি এই প্রথম কোনো দলিলে মিলেছে। তালিকাটির উৎস অনুল্লিখিত থাকায় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মুশকিল। তার চেয়ে বড় আগ্রহের জায়গা হলো, ময়মনসিংহ অঞ্চলে নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি বলা হলেও গারো, হাজং এবং কোচ ছাড়া ওই অঞ্চলের অন্য কোনো জাতি এই তালিকায় স্থান পায়নি (বৃহত্তর ময়মনসিংহে সাতটি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে—গারো, হাজং, বর্মণ, কোচ, ক্ষত্রিয়, ডালু ও হদি)। বাদ পড়েছে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের সাতটি জাতিগোষ্ঠী (বাগদি, রাজবংশী, বুনো, ভূমিজ, কর্মকার, মালি, ঘাসিয়া)। বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া উপাত্ত থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জাতি রয়েছে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে, কিন্তু বিলটিতে বাদ পড়েছে এদের বেশির ভাগই। এই অঞ্চলের পাহান, মাহাতো, মালো, কুর্মি, রাজোয়ার, মাহালি, তুরি, ভুঁইয়ালি, রাই, তেলি, খয়রা, লুরা, মুসহর, রুথিয়া, লহোড়া, রামদাস, মিখির প্রভৃতি জাতি স্থান পায়নি এই বিলের তালিকায়। আরও স্থান পায়নি বৃহত্তর পাবনার শিসং, বসাক, সিরাজগঞ্জের বেদিরা ও বক্তি। বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরি এবং খাসি (যদিও ‘খাসিয়া’ লেখা হয়েছে) তালিকায় এলেও বাদ পড়েছে খন্দ, খাড়িয়া, সোরা, পাত্রসহ আরও কয়েকটি জাতি। এই তালিকা একাধারে ১৯৯৮ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে উল্লিখিত তালিকা এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ (বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্যানুসারে, বাঙালি বাদে কমপক্ষে ৪৫টি জাতি রয়েছে)।
সেদিন আমাদের সঙ্গে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছিল বিলটির নামকরণ প্রসঙ্গ। সেদিন আমরা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিলটির নাম ‘আদিবাসী প্রতিষ্ঠান বিল’ হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলাম। বিলের সংজ্ঞায়ন অধ্যায় ২ নম্বর ধারার ২ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ’। বিল প্রণেতাদের একটি সবিনয় প্রশ্ন, বিলের ভেতরে যদি ‘আদিবাসী’ শব্দটি যুক্ত থাকতে পারে, তাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, তাহলে বিলের প্রারম্ভে ‘আদিবাসী’ যুক্ত থাকলে কী সমস্যা হতো? সেটা করা হলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি মিলত নিঃসন্দেহে।আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মহাজোট সরকারের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’ শব্দটিই উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছাবাণীতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সদ্য পাস হওয়া বাজেটেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি রাখা হয়েছে। তাহলে বিলটিতে হঠাৎ করে কেন সেটি বাদ দেওয়া হলো?
লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আদিবাসীবিষয়ক গবেষক।
No comments