চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-মোনাফেক মধ্যবিত্ত ও বাংলাদেশের পাকিস্তানীকরণ by যতীন সরকার
দেশের মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল যাঁদের, তাঁদের গরিষ্ঠসংখ্যকই ছিলেন গ্রামের কৃষক সমাজের মানুষ। অর্থনৈতিক বিচারে তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন নিম্নবিত্ত গোষ্ঠীর, কারো কারো অবস্থান ছিল পুরোপুরি বিত্তহীনের কোটায়; কিন্তু সে সংগ্রামের নেতৃত্ব তাঁদের হাতে ছিল না।
মূলত মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। কারণ 'সবার পিছে সবার নিচে' অবস্থিত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা তো মূঢ়-ম্লান-মূক, ওদের 'ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনী', ওরা 'নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে।' ওদের বিপরীতে যাদের অবস্থান, সেই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাই আপন শ্রেণীস্বার্থ সচেতন ও স্বার্থরক্ষায় একান্ত তৎপর এবং সদা মুখর।
উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাঝামাঝি যাদের অবস্থান তাদেরই তো বলি মধ্যবিত্ত। পাকিস্তানি শাসনাধীন পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্তের সংখ্যা ছিল একেবারেই আণুবীক্ষণিক। তাই সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও ছিল মধ্যবিত্তের সোচ্চার ও সক্রিয় উপস্থিতি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্তের চিত্তে ছিল বঞ্চনার ব্যথা ও ঈর্ষার জ্বালা। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্তরা দেখতে পেয়েছিল যে পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যবিত্তরা যেন 'জাদুই চেরাগ' হাতে পেয়ে গেছে, তারা দ্রুতই মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হয়ে উচ্চতর সিঁড়ির দিকে ধাবমান হচ্ছে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্তের ঘটছে ক্রম-পশ্চাদপসরণ। ২২টি বৃহৎ ধনী পরিবারের উদ্ভব ঘটল পশ্চিম পাকিস্তানে, আর পূর্ব পাকিস্তানের কোনো পরিবার ১২২-এর মধ্যেও স্থান পেল না। পদমর্যাদাসম্পন্ন চাকরি-নোকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যায় গরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘু পশ্চিমাদের কনুইয়ের গুঁতোয় কেবলই কোণঠাসা হয়ে চলছিল। পশ্চিমারাই খেয়ে গেল সব মধু, আর পূর্বাঞ্চলের জন্য বুড়ো আঙুল চোষাই সার হলো কেবল। স্বভাবতই এ রকম দুরবস্থার হাত থেকে পরিত্রাণ চাইল পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্ত। সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটানো ছাড়া কোনোমতেই কাঙ্ক্ষিত অবস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটবে না- তাও তারা অচিরেই বুঝে গেল।
তবে মধ্যবিত্ত এ কথাও জানে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মেহনতি মানুষদের নামাতে না পারলে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু সেই মানুষরা যদি নিজেদের দুর্দশা মোচনের আশা ও আশ্বাস না পায়, তাহলে তারা কেন সংগ্রামে নামবে? এ কথা বুঝতে পেরে শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে কাজে লাগানোর জন্যই, আসলে তাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যই- মধ্যবিত্তরা সে সময় স্বাধীনতার মূল্যবোধ সম্পর্কে বড় বড় কথা বলেছে। ভাষা ও ঐতিহ্যভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাচ্চা গণতন্ত্র ও এমনকি সমাজতন্ত্রের কথাও বলে ফেলেছে। সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলে এ দেশটিতে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষের চির অবসান ঘটবে, মেহনতি মানুষদেরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এখানে কোনো শোষক বা শোষণ ব্যবস্থারই অস্তিত্ব থাকবে না- সবার মনে এ রকম স্বপ্ন সঞ্চারিত করে দেওয়ার প্রয়াসেই মধ্যবিত্তরা ছিল উচ্চকণ্ঠ। তবে কণ্ঠের উচ্চারণে ওরা যা প্রকাশ করত, মনের গভীরে পোষণ করত তার সম্পূর্ণ বিপরীত মতলব। আসলে ওরা ছিল পাক্কা মোনাফেক।
কিন্তু ভুললে চলবে না যে সব ধরনের মোনাফিকির উর্ধ্বে অবস্থান ছিল যাঁদের, যাঁরা ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, তাঁরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল নেতৃত্বে। প্রলেতারিয়েতের সর্বাধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মতো বিপ্লবী ভাবনা তাঁদের ছিল না যদিও, তবু তাঁরা মধ্যবিত্ত হয়েও অনেক পরিমাণেই ছিলেন র্যাডিকেল। এ রকম র্যাডিকেল নেতৃত্বের শীর্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'- বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রকণ্ঠের ঘোষণায় এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রকৃত প্রত্যাশাই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত যারা, সেই মতলববাজ দেশদ্রোহী ও গণশত্রুরা তো গণঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অকপট অনুসারী প্রথম সারির নেতারাও অবশ্যই মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। প্রকৃত শ্রেণীচ্যুতও তাঁদের বলা যায় না। তবু তাঁদের চিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের কপটতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতার উৎসাদন ঘটিয়ে বঞ্চিত-অপমানিত-শোষিত নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্ত মানুষের আশা-আর্তির সঙ্গে তাঁরা অনেকটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। আগে আমি যে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মোনাফেক মধ্যবিত্তদের কথা বলেছি, তাদের থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল মুক্তিসংগ্রামের মূল নেতাদের অবস্থান।
কিন্তু সুবিধাভোগী পশ্চিমাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়াই উদ্দেশ্য ছিল যাদের, সুবিধা অন্বেষণরত পূর্বাঞ্চলীয় সেই মধ্যবিত্তরা বিপ্লবী বোলচাল ঝেড়ে ঝেড়ে সংগ্রামের মূল নেতৃত্বকেই পেছনে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে নানা কায়দা-কানুনের আশ্রয় নেয়, সংগ্রামীদের একেবারে ভেতর মহলে ঢুকে পড়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের নিশ্চয়তা বিধান করে ফেলতে সমর্থ হয়। এদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছিল বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল। খন্দকার মোশতাক চক্রের অবস্থানটি ছিল সবচেয়ে দৃঢ় ও সংহত। সশস্ত্র সংগ্রামকালীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েই মোশতাক স্বাধীন বাংলার মূল শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগসাজশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের মূল লক্ষ্যকে বিপরীতমুখী করে দেওয়ার সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করে ফেলে। অন্যদিকে সরাসরি যারা সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যোগযুক্ত হয়নি, তাদের কয়েকটি চক্রের চক্রান্তের পথ-পদ্ধতি ছিল ভিন্ন ধরনের। সংগ্রামের বিজয়ের ফলটি কোনোমতেই যাতে বিপ্লবী প্রগতিশীল শক্তির করায়ত্ত না হতে পারে সে লক্ষ্যেই ছিল তারা নিবেদিতপ্রাণ। এ ব্যাপারে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মিত্রদেশ ভারতেরই একটি বিশেষ চক্রের সক্রিয় সহায়তা পেয়ে গিয়েছিল তারা, ওই সহায়তাই ছিল তাদের শক্তির মূল উৎস।
এ রকম নানামুখী চক্রান্তকারী তথা উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অব্যবহিত পরে অনেক পরিমাণেই আশাহত হয়ে পড়ে। সংগ্রামের কালে গণপ্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা যেসব বিপ্লবী বুলি আওড়াত, সেগুলোই যে স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়ে যাবে- এমনটি তারা ভাবতে পারেনি। কিন্তু হায়! বাস্তবে যে তেমনটিই ঘটে গেল। কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হলো। আবার শোনা গেল, জমির মালিকানায় থাকবে সিলিং। কৃষিতে সমবায় এবং 'লাঙল যার জমি তার' স্লোগানের বাস্তব প্রতিষ্ঠার কথাও শোনা গেল। এসবের ফলে উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তরা ক্ষোভে-ক্রোধে ফুঁসে উঠল। পাকিস্তানি আদমজী বাওয়ানিদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনিক হয়ে ওঠার লক্ষ্যেই পাকিস্তান ভাঙার ঝুঁকি নিয়েছিল তারা। আর এখন কি না সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলতে শুরু করেছে স্বাধীন বাংলার গদিনশিনরাই। কী সাংঘাতিক আপদ।
এই আপদ থেকে মুক্ত হওয়ার পথই এই ধূর্তরা খুঁজে বের করল। এদের এক গোষ্ঠী ক্ষমতার মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে পরিণত হলো 'চাটার দলে'। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকেও সক্ষোভে বলতে হলো- 'আমার চারপাশের চাটার দলই সব খেয়ে শেষ করে ফেলল।' যারা এই চাটার দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল না, তারা উচ্চারণ করে চলল উগ্র বামপন্থার বুলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ভারতই এই দেশটি দখল করে নিয়ে জনগণের মাথার ওপর একটি পুতুল সরকারকে বসিয়ে দিয়েছে, রুশ-ভারতের এই দালালদের উৎখাত করতে হবে- এমন ধরনের কথা সর্বত্র প্রচার করে এবং নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে দেশটিতে অস্থির ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। সে সময়ে সংঘটিত দুর্ভিক্ষাবস্থাকেও তারা নিজেদের অনুকূলে ব্যবহারের সুযোগ করে নিল।
এ রকম বিরূপ পরিস্থিতির সুযোগে খন্দকার মোশতাক চক্র পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে মোক্ষম আঘাতটি হানে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। কারাবন্দি করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতাদের প্রায় সবাইকে এবং কারাভ্যন্তরেই নিহত হন চার নেতা। এ রকম সব নির্মমতার মধ্য দিয়েই মতলববাজ মধ্যবিত্তরা ক্ষমতার মঞ্চটিকে দখল করে নেয়, রাষ্ট্রীয় সংবিধানটিকে কাটাছেঁড়া করে এর অন্তঃসারকে লোপাট করে দেয়, বাংলাদেশের নামটি বহাল রেখেও এর পাকিস্তানীকরণ ঘটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানীকরণের সে ধারা চলছে তো চলছেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ
উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাঝামাঝি যাদের অবস্থান তাদেরই তো বলি মধ্যবিত্ত। পাকিস্তানি শাসনাধীন পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্তের সংখ্যা ছিল একেবারেই আণুবীক্ষণিক। তাই সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও ছিল মধ্যবিত্তের সোচ্চার ও সক্রিয় উপস্থিতি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্তের চিত্তে ছিল বঞ্চনার ব্যথা ও ঈর্ষার জ্বালা। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্তরা দেখতে পেয়েছিল যে পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যবিত্তরা যেন 'জাদুই চেরাগ' হাতে পেয়ে গেছে, তারা দ্রুতই মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হয়ে উচ্চতর সিঁড়ির দিকে ধাবমান হচ্ছে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্তের ঘটছে ক্রম-পশ্চাদপসরণ। ২২টি বৃহৎ ধনী পরিবারের উদ্ভব ঘটল পশ্চিম পাকিস্তানে, আর পূর্ব পাকিস্তানের কোনো পরিবার ১২২-এর মধ্যেও স্থান পেল না। পদমর্যাদাসম্পন্ন চাকরি-নোকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যায় গরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘু পশ্চিমাদের কনুইয়ের গুঁতোয় কেবলই কোণঠাসা হয়ে চলছিল। পশ্চিমারাই খেয়ে গেল সব মধু, আর পূর্বাঞ্চলের জন্য বুড়ো আঙুল চোষাই সার হলো কেবল। স্বভাবতই এ রকম দুরবস্থার হাত থেকে পরিত্রাণ চাইল পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্ত। সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটানো ছাড়া কোনোমতেই কাঙ্ক্ষিত অবস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটবে না- তাও তারা অচিরেই বুঝে গেল।
তবে মধ্যবিত্ত এ কথাও জানে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মেহনতি মানুষদের নামাতে না পারলে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু সেই মানুষরা যদি নিজেদের দুর্দশা মোচনের আশা ও আশ্বাস না পায়, তাহলে তারা কেন সংগ্রামে নামবে? এ কথা বুঝতে পেরে শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে কাজে লাগানোর জন্যই, আসলে তাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যই- মধ্যবিত্তরা সে সময় স্বাধীনতার মূল্যবোধ সম্পর্কে বড় বড় কথা বলেছে। ভাষা ও ঐতিহ্যভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাচ্চা গণতন্ত্র ও এমনকি সমাজতন্ত্রের কথাও বলে ফেলেছে। সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলে এ দেশটিতে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষের চির অবসান ঘটবে, মেহনতি মানুষদেরই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এখানে কোনো শোষক বা শোষণ ব্যবস্থারই অস্তিত্ব থাকবে না- সবার মনে এ রকম স্বপ্ন সঞ্চারিত করে দেওয়ার প্রয়াসেই মধ্যবিত্তরা ছিল উচ্চকণ্ঠ। তবে কণ্ঠের উচ্চারণে ওরা যা প্রকাশ করত, মনের গভীরে পোষণ করত তার সম্পূর্ণ বিপরীত মতলব। আসলে ওরা ছিল পাক্কা মোনাফেক।
কিন্তু ভুললে চলবে না যে সব ধরনের মোনাফিকির উর্ধ্বে অবস্থান ছিল যাঁদের, যাঁরা ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, তাঁরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল নেতৃত্বে। প্রলেতারিয়েতের সর্বাধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মতো বিপ্লবী ভাবনা তাঁদের ছিল না যদিও, তবু তাঁরা মধ্যবিত্ত হয়েও অনেক পরিমাণেই ছিলেন র্যাডিকেল। এ রকম র্যাডিকেল নেতৃত্বের শীর্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'- বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রকণ্ঠের ঘোষণায় এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রকৃত প্রত্যাশাই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার অপপ্রয়াসে লিপ্ত যারা, সেই মতলববাজ দেশদ্রোহী ও গণশত্রুরা তো গণঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অকপট অনুসারী প্রথম সারির নেতারাও অবশ্যই মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। প্রকৃত শ্রেণীচ্যুতও তাঁদের বলা যায় না। তবু তাঁদের চিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের কপটতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতার উৎসাদন ঘটিয়ে বঞ্চিত-অপমানিত-শোষিত নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্ত মানুষের আশা-আর্তির সঙ্গে তাঁরা অনেকটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। আগে আমি যে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মোনাফেক মধ্যবিত্তদের কথা বলেছি, তাদের থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল মুক্তিসংগ্রামের মূল নেতাদের অবস্থান।
কিন্তু সুবিধাভোগী পশ্চিমাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়াই উদ্দেশ্য ছিল যাদের, সুবিধা অন্বেষণরত পূর্বাঞ্চলীয় সেই মধ্যবিত্তরা বিপ্লবী বোলচাল ঝেড়ে ঝেড়ে সংগ্রামের মূল নেতৃত্বকেই পেছনে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে নানা কায়দা-কানুনের আশ্রয় নেয়, সংগ্রামীদের একেবারে ভেতর মহলে ঢুকে পড়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের নিশ্চয়তা বিধান করে ফেলতে সমর্থ হয়। এদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছিল বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল। খন্দকার মোশতাক চক্রের অবস্থানটি ছিল সবচেয়ে দৃঢ় ও সংহত। সশস্ত্র সংগ্রামকালীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েই মোশতাক স্বাধীন বাংলার মূল শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগসাজশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের মূল লক্ষ্যকে বিপরীতমুখী করে দেওয়ার সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করে ফেলে। অন্যদিকে সরাসরি যারা সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যোগযুক্ত হয়নি, তাদের কয়েকটি চক্রের চক্রান্তের পথ-পদ্ধতি ছিল ভিন্ন ধরনের। সংগ্রামের বিজয়ের ফলটি কোনোমতেই যাতে বিপ্লবী প্রগতিশীল শক্তির করায়ত্ত না হতে পারে সে লক্ষ্যেই ছিল তারা নিবেদিতপ্রাণ। এ ব্যাপারে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মিত্রদেশ ভারতেরই একটি বিশেষ চক্রের সক্রিয় সহায়তা পেয়ে গিয়েছিল তারা, ওই সহায়তাই ছিল তাদের শক্তির মূল উৎস।
এ রকম নানামুখী চক্রান্তকারী তথা উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অব্যবহিত পরে অনেক পরিমাণেই আশাহত হয়ে পড়ে। সংগ্রামের কালে গণপ্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা যেসব বিপ্লবী বুলি আওড়াত, সেগুলোই যে স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়ে যাবে- এমনটি তারা ভাবতে পারেনি। কিন্তু হায়! বাস্তবে যে তেমনটিই ঘটে গেল। কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হলো। আবার শোনা গেল, জমির মালিকানায় থাকবে সিলিং। কৃষিতে সমবায় এবং 'লাঙল যার জমি তার' স্লোগানের বাস্তব প্রতিষ্ঠার কথাও শোনা গেল। এসবের ফলে উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তরা ক্ষোভে-ক্রোধে ফুঁসে উঠল। পাকিস্তানি আদমজী বাওয়ানিদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনিক হয়ে ওঠার লক্ষ্যেই পাকিস্তান ভাঙার ঝুঁকি নিয়েছিল তারা। আর এখন কি না সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলতে শুরু করেছে স্বাধীন বাংলার গদিনশিনরাই। কী সাংঘাতিক আপদ।
এই আপদ থেকে মুক্ত হওয়ার পথই এই ধূর্তরা খুঁজে বের করল। এদের এক গোষ্ঠী ক্ষমতার মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে পরিণত হলো 'চাটার দলে'। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকেও সক্ষোভে বলতে হলো- 'আমার চারপাশের চাটার দলই সব খেয়ে শেষ করে ফেলল।' যারা এই চাটার দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল না, তারা উচ্চারণ করে চলল উগ্র বামপন্থার বুলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ভারতই এই দেশটি দখল করে নিয়ে জনগণের মাথার ওপর একটি পুতুল সরকারকে বসিয়ে দিয়েছে, রুশ-ভারতের এই দালালদের উৎখাত করতে হবে- এমন ধরনের কথা সর্বত্র প্রচার করে এবং নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে দেশটিতে অস্থির ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। সে সময়ে সংঘটিত দুর্ভিক্ষাবস্থাকেও তারা নিজেদের অনুকূলে ব্যবহারের সুযোগ করে নিল।
এ রকম বিরূপ পরিস্থিতির সুযোগে খন্দকার মোশতাক চক্র পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে মোক্ষম আঘাতটি হানে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। কারাবন্দি করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতাদের প্রায় সবাইকে এবং কারাভ্যন্তরেই নিহত হন চার নেতা। এ রকম সব নির্মমতার মধ্য দিয়েই মতলববাজ মধ্যবিত্তরা ক্ষমতার মঞ্চটিকে দখল করে নেয়, রাষ্ট্রীয় সংবিধানটিকে কাটাছেঁড়া করে এর অন্তঃসারকে লোপাট করে দেয়, বাংলাদেশের নামটি বহাল রেখেও এর পাকিস্তানীকরণ ঘটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানীকরণের সে ধারা চলছে তো চলছেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ
No comments